২০১৪ সালের ডিসেম্বরের শীতল এক সকাল। ভারতীয় টেস্ট দলের অধিনায়কত্বের সিংহাসনে বসেন বিরাট কোহলি। তবে তার অধিনায়ক হবার ব্যাপারটা যদিও বেশ নাটকীয়। কারণ তখনকার নিয়মিত অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনি চোটের জন্য খেলতে পারবেন না। অগত্যা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে সামলানোর পুরো দায়িত্বটা এসে পড়ে তরুণ কোহলির কাঁধে।
সেবারের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি শুরু হল অ্যাডিলেড ওভালে। প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করে জানিয়ে দিলেন, এ যাত্রা যে কেবল শুরু। যদিও ধোনি ফিরে আসেন দ্বিতীয় টেস্টেই, কিন্তু ফর্মহীনতা এবং সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মনোযোগ দিতে টেস্ট থেকে অবসরে চলে যান তিনি। সেই সিরিজেই চতুর্থ টেস্টে আবার অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নেমেই হাঁকালেন আরেক সেঞ্চুরি।
এরপরে প্রায় একটি দশক যেন ছিল স্বপ্নের মতো। কোহলির অধীনে ভারত টেস্ট ক্রিকেটে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছাল। ৬৮ টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে জিতেছেন ৪০ টি, এশিয়ান কোন অধিনায়ক হিসাবে যা সর্বোচ্চ। ঘরের মাঠে ২৪ ম্যাচ, আর এশিয়ার মাটিতে ২৯ টি জিতেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, এশিয়ার বাইরেও ১১টি টেস্ট জিতেছেন তিনি, যা একজন এশিয়ান অধিনায়ক হিসেবেও সর্বোচ্চ। কাগজে কলমে হয়ে উঠলেন উপমহাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক।
২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত টানা তিন বছর তিনি ছিলেন ‘আইসিসি টেস্ট টিম অব দ্য ইয়ারের’ অধিনায়ক। আর পুরো দশকের সেরা টেস্ট অধিনায়ক হিসেবেও আইসিসি তাকে সম্মানিত করেছে। তাঁর নেতৃত্বে ভারত ঘরের মাঠে হারেনি একটি টেস্ট সিরিজও। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের টানা তিনটি মেস জয় সেই আধিপত্যেরই নিদর্শন।
কিন্তু কোহলির নেতৃত্ব মানে শুধু পরিসংখ্যান নয়। আগ্রাসন, সাহস, এবং জয়ের জন্য অসীম ক্ষুধা—কোহলির এসব গুণ ভারতকে পরিণত করেছিল এক অদম্য দলে। পেস বোলারদের প্রতি তার আস্থা, প্রতিটি ম্যাচে জেতার জন্য তার আপসহীন মনোভাব, দলকে গড়ে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য এক শক্তিতে। সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের মুখেও তাই কোহলি বন্দনা।
তিনি একবার বলেছিলেন, ‘কোহলি ভারতীয় ক্রিকেটে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। তার নেতৃত্বে ভারতীয় দলকে স্পর্শ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।’ বলবেনই না কেন! অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে টেস্ট সিরিজ জিতে আসা প্রথম এশিয়ান অধিনায়ক তো কোহলিই।
তবুও, ২০১৩ সালের পর আইসিসির কোনো বড় শিরোপা না জেতার কারণে বরাবরই সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে কোহলিকে। ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর তিনি প্রথমে টি-টোয়েন্টি, পরে টেস্ট এবং ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন। কিন্তু তার বিদায়ের পর থেকে ভারতীয় টেস্ট দল যেন পথ হারিয়েছে। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স সেই নেতৃত্বশূন্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
শীতল সেই ডিসেম্বরের এক সকালে শুরু হওয়া অধিনায়ক কোহলির গল্প, শেষ হয় আরেক শীতল ডিসেম্বরেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার আজও অমলিন। তিনি কি সঠিক সময়েই সরে দাঁড়ালেন, নাকি তাকে সরিয়ে দেওয়াই ছিল ভুল—এই প্রশ্ন আজও ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটে এক গভীর ছায়া ফেলে রেখেছে।