১.
খুব রোমান্টিক ধরণের একটা কাঠের বাড়ি ছিল আমাদের।
এক বড় ভাই বেড়াতে গিয়ে বলেছিলেন – জীবনানন্দের কবিতার মত ঘর। বৃষ্টির সময় কাঠের বেড়া বেয়ে জল পড়তো, জানালা দিয়ে তাকালে পাতাদের দুলুনি দেখা যেতো। তবে আমার কাছে ঘরটার সেরা আকর্ষন ছিলো কতগুলো পোস্টার।
খুলনা থেকে কিনে কিনে এনেছিলাম পোস্টার।
কোথাও আজাহারউদ্দিন আমার দিকে চেয়ে আছেন গম্ভীর হয়ে, কোথাও শচীন টেন্ডুলকার আমাকে ব্যাট উচিয়ে দেখাচ্ছেন, কোথাও অরবিন্দ ডি সিলভা দাড়িয়ে পুল করছেন। আর সেরা ব্যাপারটা ছিলো ওয়াসিম আকরামের হাসি।
বিশাল একটা পোস্টার ছিলো ওয়াসিমের। মাঠের ভেতর শুয়ে আমার দিকে চেয়ে হাসছেন।
আমি তখন সুলতান অব সুইংয়ের যারপরনাই ভক্ত। তাকে এক পলক দেখার জন্য দামোদর পাড়ি দিতে পারি। কথার কথা নয়, দামোদর না হলেও পদ্মা পাড়ি দিয়েছিলাম তো।
সেটা ২০০২ সালের ঘটনা।
বাংলাদেশে সিরিজ খেলতে এলো পাকিস্তান। পত্রপত্রিকা মারফত জানলাম, ওয়াসিমও আসছেন। এক বড় ভাইকে ধরলাম-একটু ওয়াসিমের সাথে দেখা করিয়ে দিতে হবে। তিনি বললেন, ঢাকায় আসো, দেখা যাক।
আমি বাড়িতে কিছু না বলে কয়ে, পকেটে সামান্য কিছু সম্বল নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। উঠলাম মেজো ভাইয়ের এক বন্ধুর মেসে। তারপর তোড়জোড় করে সেই এলাকার বড় ভাই, বিখ্যাত সাংবাদিকের অফিসে চললাম।
তখন সন্ধে বেলা। পরদিন টেস্ট শুরু।
আজ বুঝি, ওই সময় কেউ ‘ওয়াসিমকে দেখবো’ আবদার নিয়ে এলে কতটা মেজাজ খারাপ হতে পারে। তারপরও আমার সেই বড় ভাই বললেন, ‘কাল থেকে তো টেস্ট। প্র্যাকটিসের দিনে এলে হয়তো দেখতে পেতেন। এখন মাঠে দেখা ছাড়া উপায় নেই।’
তাই হোক।
চল্লিশ টাকা টিকিট ছিলো বোধহয়। আমি আর মেজদার বন্ধু; দুটো টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। একেবারে দিনের শুরুতেই বল করতে এলেন আমার স্বপ্নের নায়ক। বয়সটা তখন পড়তির দিকে। খুব ভালো কিছু করেছিলেন কী? মনে নেই।
তবে পরের ওভারেই চমৎকার ঘটে গেলো।
সাধারণত ওপেনিং বোলার, তারপর এতো বড় কাল্ট ফিগার ওয়াসিম আকরামের বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করার কথা না। কিন্তু কী এক কারণে দ্বিতীয় ওভারেই আমরা যেখানে বসেছি, তাঁর ঠিক সামনেটায় এসে দাড়ালেন ফিল্ডিং করতে। মন ভরে দেখলাম মানুষটাকে।
ওই দিনই ট্রাজেডি হয়ে গেলো। ১৬ বল করার পরই ইনজুরিতে পড়লেন। ওই সিরিজেই আর খেলা হলো না ওয়াসিমের। আমার প্রথম ওয়াসিম দর্শন ওখানেই শেষ।
তবে এই ম্যাচে আমি আরেক জন লোককে প্রথম কাছ থেকে দেখেছিলাম।
আমরা যেখানে বসেছি, তার সামনে বাউন্ডারির বাইরে একটা চেয়ারে এসে খোড়াতে খোড়াতে বসলেন কিশোর এক দীর্ঘাকায় মানুষ। হ্যাঁ, আমাদের মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেই প্রথম কাছ থেকে দেখা।
২.
ততোদিনে সাংবাদিকতা শুরু করে দিয়েছি।
ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ভারোত্তল; সব মাঠে যাই। এর মধ্যে একটা টেলিফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানের চিঠি এলো-তারা একটা নতুন সার্ভিস শুরু করতে যাচ্ছে। আর এটা উদ্বোধন করবেন ওয়াসিম আকরাম।
এই অনুষ্ঠান থেকে খেলার পাতায় খবর হবে না। তারপরও অফিসে বলে চললাম অনুষ্ঠানে। সাথে বিখ্যাত ফটো সাংবাদিক শামসুল হক টেংকু ভাই।
টেংকু ভাইয়ের সাথে ওয়াসিমের আলাপ ছিলো। তিনিই আগে আগে নিয়ে গেলেন। অনুষ্ঠান শুরুর তখনও অনেক বাকী। লবিতে ওয়াসিম কার সাথে যেনো কথা বলছিলেন। টেংকু ভাই গিয়ে বললেন, আমি একটু কথা বলতে চাই।
ওয়াসিম চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘নো ইন্টারভিউ।’
আমি বললাম, ইন্টারভিউতে কাজ নেই। আপনার কাছে একটু দাড়াতে চাই। ভদ্রলোক মুগ্ধ হলেন। কাঁধে হাত রেখে গল্প শুরু করলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট, পাকিস্তানের ক্রিকেট; অনেক কিছু বললেন। আমি ফাঁকে আমার ওয়াসিম প্রেমের গল্পটা বলে ফেললাম।
মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘সাংবাদিক হয়ে গেছেন। এখন তো দেখা হবেই।’
৩.
বাংলাদেশেই কয়েক বার দেখা হলো। তিনি এসে ধারাভাষ্যকারদের ঘরে বসেন। আমরা প্রেসবক্সে।
শেন ওয়ার্ন, সুনীল গাভাস্কার; কত লোকের সাথে বাথরুমের মুখে দেখা হয়ে যায়। সেখানে ওয়াসিমকেও দেখি। কিন্তু একবারের জন্যও আমার বুকের কাপুনি কমে না। মনে হয়, প্রথম দেখছি মানুষটাকে। মনে হয়, এখনও গ্রহের সেরা নায়ক।
৪.
২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় গেলাম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে। সেই আমার একমাত্র ক্রিকেটীয় সফর।
দ্বিতীয় পর্ব থেকে খেলা কলম্বোয়। আর এখানেই আবার রোজকার সঙ্গী হয়ে গেলেন ওয়াসিম। একদিন চুটিয়ে আড্ডা হলো বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে। ওখানেই বলে ফেললেন, সাকিবের অধিনায়ক থাকা উচিত ছিলো।
৫.
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে একটা বই করছি।
সাকিবকে যারা চেনেন, জানেন; এমন বিখ্যাত, অখ্যাত সবার সাক্ষাৎকারের সংকলন। তখন মনে পড়লো ওয়াসিম আকরামের কথা। তিনি তো সাকিবের সাথে মিশেছেন, কলকাতা নাইট রাইডার্সে দু’জন এক সাথে ছিলেন। সাকিবকে খুব মূল্যায়নও করেন। তাঁর একটা সাক্ষাৎকারের জন্য চেষ্টা করা যাক।
ভারতীয় এক সাংবাদিক ফোন নম্বর দিলেন।
কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করলাম। ফোন রিসিভ হলো। আমার প্রয়োজন বলতেই একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘ফোনে তো ইন্টারভিউ দেই না। কিন্তু আপনাকে দেবো। এক সপ্তাহ পরে ফোন করুন। দুবাই থাকবো। ওখানে বসে কথা বলবো।’
এক সপ্তাহ পরে আবার ফোন দিলাম। ফোন ধরলেন। মনে করিয়ে দিতেই বললেন, ‘শরীর খুব খারাপ। দু চার দিন পরে যেনো ফোন করি।’
আন্দাজে দু চার দিনে পরে ফোন দিলাম। ফোনের ওপার থেকে হইচইয়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘আজ তো এখানে ঈদ। তারপরও আমি একটু পাশে যাচ্ছি। আপনি ইন্টারভিউ করে ফেলুন।’
ইন্টারভিউ শেষে বললেন, দেখেন, ‘এমনিতেই ফোনে ইন্টারভিউ দেই না। তারপর ঈদের দিন। তাহলে কেন দিলাম ইন্টারভিউ?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
‘কারণ, আমি আপনাদের দেশটাকে ভালোবাসি। সাকিব আল হাসানকে ভালোবাসি।’