ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ধাঁধা হয়ে থাকবেন ওয়াসিম জাফর।
২৪ বছরের প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারে তিনি করেছেন ১৯৪১০ রান। করেছেন ৫৭ শতক এবং ৯১ টি অর্ধশতক। বিদর্ভের হয়ে জিতেছেন দুইটি রঞ্জি ট্রফির শিরোপা। কিন্তু ভারতের এই ঘরোয়া কিংবদন্তির বলার মত আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নেই। ৩১টি টেস্ট আর দু’টি ওয়ানডেতেই থমকে গেছে তাঁর যাত্রা। টেস্টে ৩৪.১০ গড়ে ১৯৪৪ রান মোটেও ওয়াসিম জাফরকে চেনাতে পারে না। এখানেই তাঁকে নিয়ে রহস্যটা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেক ২০০০ সালে। কিন্তু সেই সিরিজিটিকে নিশ্চই ভুলে যেতে চাইবেন তিনি। অভিষেক সিরিজে তিনি বলার মত কিছুই করতে পারেননি। শুধু অভিষেক সিরিজ নয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বলার মত কোনো সাফল্যই নেই তাঁর। অথচ তিনি কিনা হতে পারতেন ভারতের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে ফার্স্ট পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি যখন চা বিরতিতে আসি তখন জানতে পারি আমি জাতীয় দলের জন্য নির্বাচিত হইনি। আমি ৭৪ রানে ব্যাটিং করছিলাম। আর আমি ব্যাটিং এ বেশ ভালো করছিলাম। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে আমি কি করতে পারি? আমি শুধু তাই করতে পারি যা আমি করছিলাম। তা হল প্রচুর রান করতে পারি আমি। সাথে আমি আশা রাখতে পারি আমি জাতীয় দলে ডাক পাব। আমি যদি প্রচুর রান করতে পারি তাহলেই আমি সুযোগ পাব।’
এই কথার মাধ্যমে নিজের হতাশাকে তুলে ধরেছিলেন ওয়াসিম জাফর। ২০১৩ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রচুর রান করার পরও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে সিরিজের দলের জন্য বিবেচিত না হওয়ার পর এই ভাবেকে নিজের হতাশাকে তুলে ধরেন ওয়াসিম জাফর। তাঁর পরিবর্তে দলে নেয়া হয়েছিলো শিখর ধাওয়ানকে যিনি কিনা রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর অর্ধেক রান করেছিলেন।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াসিম জাফরকে দিলীপ ট্রফিতে পশ্চিম অঞ্চলের অধিনায়ক করা হয়। অথচ আগের দুই বছর মুম্বাইয়ের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করার পরও তাঁকে জোনাল টুর্নামেন্টের জন্য বিবেচনা করা হয়নি।
তখন ডিনএ ইন্ডিয়াকে ওয়াসিম জাফরক বলেন, ‘সত্যিই আমি জানি না, কেন আমাকে সর্বশেষ দুই বছর আমাকে তারা বিবেচনা করেনি। আমার মনে হয় আমার বয়স এখন দুই বছর বেশি। বয়স আমার পক্ষে না। ভারত দল হেরে যাচ্ছিল, তখন তারা আমাকে বিবেচনা করে নি। আমার পরিবর্তে শিখরকে (শিখর ধাওয়ান) নিয়েছিল। অভিযোগ করার কোনো উপায় নেই, কারণ সে ভাল করেছে। কিন্তু বিবেচনা করার জন্য আমি তাদের বেশ কাছেই ছিলাম।’
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াসিম জাফর যখন মুম্বাই ছাড়েন তখন অনেক বার্তা সংস্থায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল কেন তাঁকে বিদায় অনুষ্ঠান করে বিদায় দেয়া হল না। তখন জাফর জানান, তিনি শচীন না যে তাঁকে বিদায় অনুষ্ঠান করে বিদায় দিবে। ২০১৫ সালে যখন মুম্বাই ছেড়ে বিদর্ভে পাড়ি জমান তখন মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে কোনো বিদায় অনুষ্ঠান করে বিদায় দেয়নি। অথচ, মুম্বাইয়ের হয়ে ১৯ বছরে প্রায় ১০,০৫৬ রান করেছিলেন। তার বিপরীতে মুম্বাইয়ের সেরা ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার মুম্বাইয়ের হয়ে ২৫ বছরে করেছেন মাত্র ৪২৮১ রান।
এই বক্তব্যে দুইটি বিষয় পাওয়া যায়, প্রথমত জাতীয় দলের জন্য বারবার উপক্ষিত হওয়ার ক্রোধ। আর দ্বিতীয়ত ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করার পরও বারবার দলে সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ।
ওয়াসিম জাফর প্রথম বারের মত শিরোনাম হন, ১৫ বছর বয়সে; যখন তিনি গিলস শিল্ড ক্রিকেট টুর্নামেন্টে স্কুল দলের হয়ে ৪০০ রানের একটি ইনিংস খেলেন। এরপর অতি দ্রুতই বোম্বে অনুর্ধ্ব-১৬ এবং অনুর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান। আর সেখানেও রানের ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি। ১৯৯৬-৯৭ সেশনে মুম্বাইয়ের হয়ে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট অভিষেক হয় ওয়াসিম জাফরের।
মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তাঁকে তুলনা করা হত শচীন টেন্ডুলকার এবং বিনোদ কাম্বলির সাথে। নিজের দ্বিতীয় প্রথম শ্রেণির ম্যাচে সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে ত্রিশতক হাঁকানোর পর এই তুলনা শুরু হয় তাঁকে নিয়ে।
১৯৯৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মুম্বাই দলে খেলার পর সিদ্ধান্ত নেন মুম্বাই ত্যাগ করার। অধিনায়ক হিসেবে মুম্বাইকে দুই বার রঞ্জি ট্রফি জিতিয়েছিলেন তিনি। ২০১৬ থেকে পরবর্তীতে ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত খেলেছেন বিদর্ভের হয়ে।
২০১৭-১৮ সেশনে প্রথম বারের মত রঞ্জি ট্রফি জিতে বিদর্ভ। সেই বিদর্ভ দলে খেলেছিলেন ওয়াসিম জাফর। করেছিলেন ৫৪.০৯ গড়ে ৫৯৫ রান। ৪০ বছর বয়সে এসেও দুর্দান্ত পারফর্ম করে হয়েছিলেন ২০১৭-১৮ সেশনের পঞ্চম সেরা রান সংগ্রাহক।
রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে ১৮,০০০ রানেই মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। ওয়াসিম জাফর একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান যিনি কিনা ৪০ বছর বয়সেও ২৫০ ইনিংস খেলেন।
বেশ কয়েকটি প্রোলিফিক সেশন কাটানোর পর ২০০০ সালে প্রথম বারের মত জাতীয় দলে সুযোগ পান জাফর। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে মাত্র ৪ ইনিংসে করেন মাত্র ৪৬ রান। আর এর ফল স্বরূপ বাদ পড়েন দল থেকে। এরপর আবারো দলে সুযোগ পান ২ বছর পর।
ওয়াসিম জাফরের ক্যারিয়ারে দুইটি বিষয় কখনো পরিবর্তন হয়নি। প্রথমত জাতীয় দলে নিয়মিত হতে না পারা এবং দ্বিতীয়ত রঞ্জি ট্রফিতে মুম্বাইয়ের হয়ে নিয়মিত রান করেন।
২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ৩১ টি টেস্ট খেলেছেন ওয়াসিম জাফর। একেবারে কিছুই করতে পারেননি, তা অবশ্য নয়। ৫টি সেঞ্চুরি করেছেন; যার মধ্যে দুটি ছিল ডাবল সেঞ্চুরি। ৩১ টেস্টে ৩৪ গড়ে করেছেন ১৯৪৪ রান।
তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্মেন্সের সাথে মিলানো সম্ভব হবে না তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। বাংলাদেশের বিপক্ষে দুই টেস্ট ছাড়া সব টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রকা, অস্ট্রেলিয়ার মত প্রতিপক্ষের সাথে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সেরা সময় কেটেছে ২০০৭ সালে। সেইবার ভারতের হয়ে করেছেন পাঁচটি শতক এবং সাতটি অর্ধশতক। ২০০৭ সালে কলকাতায় চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে করেছিলেন দ্বি শতক। এর আগে এই রেকর্ড করছিলেন সুনীল গাভাস্কার এবং ভিনু মানকাড়।
এই কলকাতা টেস্টের পর আর মাত্র সাতটি টেস্ট খেলা সুযোগ পান ওয়াসিম জাফর। এই সাত ম্যাচে মাত্র একটি অর্ধ শত রানের ইনিংস খেলেন জাফর। কলকাতা টেস্টের বেশ কিছুদিন জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন তিনি। এরপর ২০০৮ সালে আবারো জাতীয় দলে ডাক পান। কিন্তু বলার মত কিছু করতে না পারার কারণে আবারো দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। এরপর আর কখনোই জাতীয় দলে সুযোগ পাননি তিনি।
জাফরের খেলার ধরন আধুনিক ক্রিকেটের সাথে মিলে না। শান্ত, অবিচল থেকে ক্রিকেট খেলতেন তিনি। তাঁর ওপেনিং সঙ্গী বীরেন্দ্র শেবাগ ছিলেন তাঁর পুরো উল্টো। দূর্দান্ত সব স্ট্রোক দর্শকদের মন কেড়ে নিত। শেবাগের ছায়ায় পড়েছিলেন জাফর। দর্শকরা শেবাগের বোলারদের বুকে কাপুনি উঠিয়ে দেয়া ব্যাটিং দেখে বেশ আনন্দ পেত। কিন্তু বিপরীতে জাফরের সেই ঐতিহ্যবাহীব্যাটিং দেখে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো না।
২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে শিখর ধাওয়ান এবং মুরালি বিজয়কে দলে ডাকা হয়। তখন নির্বাচকরা একটি বেশ তরুণ দল গঠন করতে মনোনিবেশ করে। ধাওয়ানের অন্তর্ভুক্তি ছিল ভালো পারফর্মেন্সের কারণে। অপরদিকে, মুরালি বিজয়ের খুব বেশি ঘরোয়া রেকর্ড ছিল না। পরবর্তীতে বিজয়কে শুধুমাত্র রিজার্ভ ওপেনার হিসেবে খেলানো হত।
ওয়াসিম জাফর ২০১১-১২ সালে যখন ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন তখন জাতীয় দলে ছিলেন গৌতম গম্ভীর। প্রত্যেকবার জাফরের পরিবর্তে কিছু মারকাটারি ব্যাটসম্যানকে দলে নেয়া হয়েছিল। যারা ওয়াসিম জাফরের মত ক্লাসিক্যাল ক্রিকেট খেলতে পারতো না। তারা ছিল টেকনিক্যালি জাফরের থেকে বেশ পিছিয়ে।
সব মিলিয়ে জাফর ভারতীয় ক্রিকেটে এক রহস্যই হয়ে রইলেন।