আশির দশকে মাঝামাঝি সময়ে অজি কিংবদন্তি বব সিম্পসন অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া দল নিউ সাউথ ওয়েলস এর কোচের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওয়াহ যমজ ভাইদের কপাল দারুণ ভাল ছিল কেননা ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে ক্লাবের হয়ে তারা ট্রেইনিং করার সুযোগ পায়।
দুই ভাই ন্যাচারাল ট্যালেন্ট হলেও তারা ছিল আনকাট হিরার মতন, বিশেষ করে মার্ক ওয়াহ। ওদিকে বব সিম্পসন ছিলেন পাক্কা জহুরী। তিনি যত্নের সাথে দুই ভাইকে ঘষে ঘষে চকচকে করে তোলেন। তবে কাজটি সহজ ছিল না, কেননা কাগজে কলমে দুই ভাই যমজ হলেও তাদের চেহারা, ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ, খেলার ধরণ, এমন কী চুলের স্টাইলও ছিল আলাদা!
বব সিম্পসনের ভাষায়, ‘I saw these two contrasting players. People had to tell me they were twins because I never would have picked it.’
সত্যি কথা বলতে দুই ভাই এর ভিন্নতা শুরু হয়েছে সেই জন্ম থেকেই, যখন তারা ৪ মিনিটের ব্যবধানে জন্ম নিলো। জন্মের পর সেই ভিন্নতা কমে নি, বরং বেড়েই চলেছে। মার্ক ওয়াহ’র আত্ম জীবনী পড়তে গিয়ে দুজনের বেড়ে ওঠার সময়ের বেশ কিছু তথ্য জানতে পেরেছি। আমার মনে হয় দুই ভাই এর স্বতন্ত্র সত্ত্বা গড়ে তুলতে এসব ফ্যাক্টরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
১. স্টিভের জন্ম হয়েছে রাত ৮ টা ১৪ মিনিটে। মাথায় কালো ঘন চুল ছিল, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল। ওজন ছিল স্বাভাবিক।
মার্কের জন্ম হয় ঠিক চার মিনিট পর। মাথা ছিল প্রায় ন্যাড়া এবং চোখ ছিল প্রায় ঘুমে বোজা। ওজন ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, প্রায় ৪ কেজি! উল্লেখ্য, তারা নন-আইডেন্টিক্যাল টুইন ছিলেন, অর্থাৎ চেহারায় হুবহু মিল ছিল না।
২. জন্মের পর থেকেই মার্কের দুটো কাজ ছিল- খাওয়া এবং ঘুম। একেবারে ছোট থেকেই মার্ক ছিল ঘুমকাতুরে। শুধু ক্ষুধা পেলে ঘুম থেকে জেগে উঠত। বড় হবার পরও ওর স্বভাব বদলায় নি।
৩. ওদের বাবা ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। যমজ ভাইদের বয়স যখন ৬ সপ্তাহ তখন মাকে কর্মস্থলে যোগ দিতে হয়। কপাল ভাল এই যে ওদের দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ি কাছাকাছিই ছিল। দিনের বেলায় বাসায় অন্য কেউ থাকত না বলে সে সময় দুই ভাইকে দাদা-দাদী, নানা-নানীর কাছে রেখে যেতেন।
মার্ককে দেখে রাখতেন নানী ডরোথি বার্ন এর কাছে এবং স্টিভকে দেখাশুনা করতেন ওদের দাদী এলা ওয়াহ। ছোটবেলায় ওদের দাদীর পোলিও হয়েছিল বলে তুলনামূলক ছোট গড়নের স্টিভকে সামলাতে পারতেন, মার্ককে নয়!
শৈশবে বেশি সময় কাটাবার কারণে বড় হয়ে মার্কের মাঝে নানা এবং স্টিভের মাঝে দাদার ছোঁয়া বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
৪. দুজনের মধ্যে প্রথম হাঁটা শুরু করে মার্ক। তখন তাদের বয়স ৯ মাসের সামান্য বেশি। স্টিভের হাঁটি-হাঁটি-পা-পা শুরু হয় এর প্রায় দেড় মাস পর।
৫. প্রায় ১৮ মাস বয়সে দুজনের কথা বলা শুরু করে। তবে, স্টিভ বেশ জোরে কথা বলত। মার্ক শুরু থেকেই স্বল্প ও মৃদুভাষী।
৬. প্রতিদিন মার্ককে প্রথমে গোসল করানো হত। কারণ, ওকে আগে খাওয়ানোর তাড়া থাকত। খাওয়ার ব্যাপারে স্টিভের অত আগ্রহ ছিল না।
৭. ছোটবেলা থেকেই স্টিভ বেশ ডানপিটে ছিল। হৈচৈ করতে পছন্দ করত। অন্যদিকে মার্ক কাজে-কর্মে খুবই সাবধানী ও স্বভাবের দিক দিয়ে কিছুটা ভীতু ছিল। এ ব্যাপারে ওদের মায়ের ভাষ্য, ‘It just amazes me to think he was so scared of so many things, and yet now he goes out and faces the fastest bowlers in the world.’
৮. সকল কাজে স্টিভই নেতৃত্ব দিত। মার্ক সব কাজে অংশ নিতে অতটা ইচ্ছুক না থাকলেও ক্রিকেট খেলার সময় দ্বিতীয়বার বলতে হত না।
৯. স্কুলে দুই ভাই এর মধ্যে মার্ককে শিক্ষকগণ বেশি পছন্দ করতেন। কেননা, সে যত্ন সহকারে সব হোমওয়ার্ক করত এবং নির্দিষ্ট সময়ে জমা দিত।
১০. দুই ভাইই নানা খেলাধুলায় পারদর্শী ছিল। ফুটবল, টেনিস এবং ক্রিকেটে তারা উভয়েই ভাল ছিল। তবে এসবের পাশাপাশি মার্ক স্কোয়াশ এবং অ্যাথলেটিক্স এ ও অংশ নিত। স্কুলে সে ৮০০ মিটার দৌড়ে নিয়মিত অংশ নিত। পাশাপাশি গোলক নিক্ষেপও করত। বেশ হালকা গড়ন থাকা সত্ত্বেও গোলক নিক্ষেপে ভাল হওয়াটা বেশ অবাক করার মতন বিষয় ছিল।
১১. কিশোর বয়সেই দুজনের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট হবার পর মার্ক অসগুড-শ্ল্যাটার নামক এক হাঁটুর ইনজুরিতে ভোগা শুরু করে। ফলে,ওর উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে কয়েক মাসের মধ্যেই দুজনের মধ্যে উচ্চতার বেশ পার্থক্যের সৃষ্টি হয়।
সিডনির এক ডাক্তার এ সময় মার্ককে পরীক্ষা করে জানায় সে আর লম্বা হতে পারবে না! তবে, সবাইকে অবাক করে ১৬ বছর পূর্ণ হবার পর দ্রুতই ফুট খানেক লম্বা হয়ে ৬ ফুটের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ওয়াহ পরিবারের বড় একটি দুশ্চিন্তার অবসান ঘটে।
১২. ব্যাটিং এর সময় দুর্দান্ত হ্যান্ড-আই–কোঅর্ডিনেশন থাকা সত্ত্বেও গাড়ি চালাবার সময় মার্কের কী জানি হত। ফলে সে ম্যানুয়াল গাড়ি চালাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করত না। ওদিকে স্টিভ ধপাধপ গিয়ার বদলে, এক্সেলারেটর চেপে গতি বাড়ানো-কমানোয় ওস্তাদ ছিল।
১৩. প্রথম শ্রেণি, টেস্ট ও ওয়ানডে ম্যাচে স্টিভের অভিষেক হয়েছে যথাক্রমে ১৯৮৪, ১৯৮৫ এবং ১৯৮৬ সালে। অপরপক্ষে, মার্কের প্রথম শ্রেণি, টেস্ট ও ওয়ানডে ম্যাচে অভিষেক হয়েছে যথাক্রমে ১৯৮৫, ১৯৯১ এবং ১৯৮৮ সালে।
এভাবে নানা ফ্যাক্টর নানা ভাবে দুজনের জীবনে প্রভাব ফেলে দু’জনকে দুইটি স্বতন্ত্র্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। অনেকেই মনে করেন মার্ক খুব সহজেই সব কিছু পেয়ে গেছে, আর স্টিভকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আসলে ব্যাপারটি হয়েছে অনেকটাই উলটো। জাতীয় দলে ঢোকার জন্য মার্ককেই বেশি স্ট্রাগল করতে হয়েছে। আর পরিশ্রম করেছে দুজনই। কঠোর পরিশ্রম। কারণ পরিশ্রম ছাড়া শুধু মেধা দিয়ে ক্রিকেটের কিংবদন্তি হওয়া যায় না। শুধু ক্রিকেটই বা বলি কেন, জীবনের কোন ক্ষেত্রেই সফল হওয়া যায় না।