আসলেই আমাদের দিয়ে হচ্ছে না

আমার খুব ২০০৩ বিশ্বকাপের কথা মনে পড়ছে।

এমন নয় যে, সেই বিশ্বকাপের আগে পরে বাংলাদেশ দল অমন খারাপ ফলাফল আর করেনি। করেছে। তারপরও ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেট মাঠে ও মাঠের বাইরে এমন সব কীর্তিকলাপ করেছিলো, যার কোনো তুলনা হয় না। সত্যিকারের কলঙ্কের এক অধ্যায়। মনে হয়েছিলো, বাংলাদেশের ক্রিকেট একেবারেই পথ হারিয়ে ফেলেছিলো।

এই ২০২১ সালে এসে আরেকবার সেই অনুভূতি হবে, এটা কখনো কল্পনা করিনি আমরা। কিন্তু সেই অবস্থাই হয়েছে।

না, বাংলাদেশ কেনিয়া-কানাডার কাছে হেরে যায়নি। চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে পাঁচ ম্যাচে তিনটি হেরেছে। এর মধ্যে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হারটা বাদ দিলে বাকি দুটো হারই প্রত্যাশিত ছিলো। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভেন্যুতে টি-টোয়েন্টির এমন দল নয় যে, তারা বলে কয়ে শ্রীলঙ্কা বা ইংল্যান্ডকে হারাবে। ফলে খেলার পরিস্থিতি খুব খারাপ, তা নয়।

কিন্তু ফলাফলটাই তো সব নয়। ফলাফলের বাইরে অনেক কিছু আছে। আর সেগুলোই এতো বেশি হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে ২০০৩ সাল ফিরে এসেছে।

প্রথমত খেলোয়াড়দের বডি ল্যাংগুয়েজের কথা বলবো।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যেমনটা দেখলাম, এতো বাজে, হতাশ, হতশ্রী বডি ল্যাংগুয়েজ বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের কখনো দেখেছি বলেই মনে হয় না। প্রতিটা খেলোয়াড়কে দেখে মনে হচ্ছিলো, জোর করে তাদের মাঠে নামানো হয়েছে। কারো এতোটুকু খেলার ইচ্ছে নেই যেন!

ডাগআউটে কোচ ও বেঞ্চ খেলোয়াড়দের দেখে মনে হলো, বাধ্যবাধকতা না থাকলে তারা মাঠে আসতেন না। এর চেয়ে হোটেল রুম অনেক পছন্দ করতেন হয়তো।

হ্যাঁ, দীর্ঘ কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশনের একটা প্রভাব পড়তে পারে। তারপরও সেটা অজুহাত বলে আমার মনে হচ্ছে না। ভারত-পাকিস্তানের খেলোয়াড়রাও লম্বা সময় ধরে বায়ো বাবলে আছেন; তাদের তো এর থেকে অনেক বেশি উজ্জীবিত মনে হলো।

এবার আসুন খেলোয়াড়দের, বিশেষ করে সিনিয়র খেলোয়াড়দের আচরণ নিয়ে।

মুশফিকুর রহিম একটা ফিফটি করেই গর্জে উঠলেন। নিজের সবটুকু হতাশা ঝেড়ে দিয়ে তিনি বললেন, সমালোচকদের আয়নাতে মুখ দেখা উচিত। মানে কী!

মাঠে না খেললে বা মুশফিকদের মানে না উঠলে তিনি খেলোয়াড়দের সমালোচনা করতে পারবেন না?

শুনুন মুশফিক, দিনশেষে আপনি এই সাধারণ মানুষগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন। এই আয়নাতে সরল ছাপ পড়া লোকগুলো এতো উত্তেজনা দেখায় বলেই আপনাদের খেলায় টাকা আছে এবং সেই টাকাতে আজ আপনাদের শান শওকত। এই লোকগুলোকে ছোট করে বড় হতে পারবেন না।

এরপর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বললেন, তারা পেইনকিলার নিয়ে মাঠে নামেন, তাও তাদের সমালোচনা হয়। ফাইন।

এই ক্ষেত্রে দুটো পয়েন্ট আছে। আমরা জানি যে, খেলোয়াড়রা দলকে অনেক ভালো বাসেন বলেই শরীরের সামান্য চোট আঘাতকে অগ্রাহ্য করে ওষুধ খেয়ে মাঠে লড়াই করেন। কিন্তু এটা গর্ব করার মত কোনো কথা নয়। সব পেশাতেই আঘাত যন্ত্রণা সহ্য করে চলতে হয়। এটা প্রফেশনাল হ্যাজার্ড। এটাকে অজুহাত বানাবেন না। তাহলে আমরা আপনাদের নিয়ে গর্ব করতে পারবো না। আপনি তো গর্বের আগেই ধ্বসে পড়লেন।

কেবল খেলোয়াড়রা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলছেন, তাই নয়।

সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা এই বিশ্বকাপ চলা অবস্থায় জাতীয় দলের কোচিং স্ট্যাফকে ধুয়ে দিলেন। কোচিং দলকে দক্ষিণ আফ্রিকার রিহ্যাব সেন্টার বলেও অবিহিত করলেন।

মাশরাফির কথা মিথ্যে না। গ্যারি কার্স্টেন কোচ নিয়োগের উপদেষ্টা করার পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার যোগ্য অযোগ্য লোকে ভরে গেছে আমাদের কোচিং প্যানেল। কিন্তু মাশরাফি, এটা বলার কী এখন উপযুক্ত সময়?

২০১৯ বিশ্বকাপের কথা স্মরণ করে দেখুন।

সে সময় মাশরাফির যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো। লোকে সমালোচনাও করছিলো। কিন্তু আমরা কী বিশ্বকাপ চলা অবস্থায় বলেছি যে, মাশরাফি চলে না? এটা বলা যায় না। বিশ্বকাপ শেষ হোক, এই কথা বলার অনেক সুযোগ পাবেন।

মাশরাফি সদ্য সাবেক অধিনায়ক, দলের সবাই তার ঘনিষ্ঠ, তিনি একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। তাঁকে সময় ও পরিস্থিতি অবশ্যই বুঝে কথা বলা উচিত।

আসলে মুশফিক, রিয়াদ বা মাশরাফিকে ‘উচিত’ দেখিয়ে লাভ কী? সবচেয়ে বেশি এই সময়ে যার ‘উচিত’ মনে রাখা উচিত ছিলো, সেই বোর্ড সভাপতিও তো সৌজেন্যের ধার ধারছেন না। তিনি সরাসরি খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের সমালোচনা করছেন, অধিনায়ককে আক্রমণ করে কথা বলছেন। কে খেলতে চায়, চায় না; এসব বলে দিচ্ছেন।

বোর্ড সভাপতির উচিত ছিলো এই সময় খেলোয়াড়দের পাশে থাকা। সেটা তিনি থাকতে পারলেন না।

কে-ই বা নিজের কাজটা করতে পারলো?

এই সময় চুপ থাকা উচিত ছিলো খেলোয়াড়দের ঘনিষ্ঠ লোকেদের। কিন্তু আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম একজন শীর্ষ তারকার স্ত্রী ও একজন সাবেক খেলোয়াড়ের ভাই আজে বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলছেন।

সবার কথা বললাম, নিজেদের কথা বললাম না।

আমরা, সাংবাদিকরাও এই অবস্থার সুযোগ নিচ্ছি। আমরা এই সময়ে একের পর এক সেনসেশনাল শিরোনাম করছি। ক্রিকেট থেকে দূরে চলে যাচ্ছি; আরও দূরে যাচ্ছি।

এমনকি দেশের মাটিতে যখন যাচ্ছেতাই উইকেট বানিয়ে আমরা জিতছিলাম, তখন আমরা সত্যিকারের সমালোচনাটা করতে পারিনাই। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমরা আসলে এই জয় যে আমাদের জন্য উল্টো ক্ষতিকর হচ্ছে, সেটা আমরা সেভাবে তুলে ধরতে পারিনাই।

সব মিলিয়ে সময়টা ঘোরতর খারাপ যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। এখন নাসুমের মত আমাদের সবারই স্বীকার করা দরকার – আমাদের দিয়ে হচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link