২০১১ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বও পেরোতে পারেনি আয়ারল্যান্ড। কিন্তু তাতে কি! টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রান তাড়া করে জেতার রেকর্ডটা যে তারাই গড়েছিল। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬৩ বলে ১১৩ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে কেভিন ও’ব্রায়েন জন্ম দিয়েছিলেন এক রোমাঞ্চকর আইরিশ রূপকথার!
২০১১ সালের দুই মার্চ, ব্যাঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচে ইংল্যান্ডকে তিন উইকেটে হারিয়ে টুর্নামেন্টের প্রথম আপসেটের জন্ম দিয়েছিল আয়ারল্যান্ড। প্রতিবেশী দুই পুরোনো শত্রুর ‘অসম’ লড়াই। শক্তির বিচারে দুদলের পার্থক্যটা ছিল বিশাল। তবে ম্যাচটা সেদিন মোটেও একপেশে ছিল না। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ জমজমাট এক লড়াই উপহার দিয়েছিল দুই দল।
২০০৭ বিশ্বকাপেই টেস্ট খেলুড়ে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানকে হারিয়ে ‘জায়ান্ট কিলার’ উপাধি পাওয়া আইরিশরা সেদিন দেখিয়েছিল যে ইংল্যান্ডের মত পরাশক্তির বিপক্ষে ৩২৭ রান চেজ করে ম্যাচ জেতার সামর্থ্য তাদের ভালভাবেই আছে। কিন্তু ম্যাচের প্রথমার্ধটা একেবারেই অনুকূলে ছিল না আইরিশদের। টসে জিতে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ডের শুরুটা ছিল দারুণ। দুই ওপেনার স্ট্রাউস এবং পিটারসেনের উদ্বোধনী জুটিতে আসে ৯১ রান। আগের ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ১৫৮ রানের ইনিংস খেলা স্ট্রাউসের (৩৪) বিদায়ে ভাঙে সেই জুটি।
স্টার্লিংয়ের অফ স্পিনে ৫০ বলে ৫৯ রান করা পিটারসেন ফিরে গেলে ২ উইকেটে ১১১ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড। অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস আর কেভিন পিটারসেনের গড়ে দেওয়া প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে ইনিংস বিল্ড আপের দায়িত্ব নেন জোনাথন ট্রট আর ইয়ান বেল। তৃতীয় উইকেট জুটিতে ১৬৭ রান যোগ করে ইংল্যান্ডকে নিয়ে যান বড় সংগ্রহের দিকে। তবে মাত্র ১০ রানের ব্যবধানে ট্রট এবং বেল দুজনকেই ফিরিয়ে দেন জন মুনি। মাত্র ৮ রানের জন্য বঞ্চিত হন সেঞ্চুরি-বঞ্চিত হন ট্রট (৯২)। আর বেল ফেরেন ৮৫ বলে ৮১ রানের ইনিংস খেলে।
২৮৮ রানে ৪ উইকেট হারানো ইংল্যান্ডের পরের দিকের ব্যাটসম্যানরা প্রত্যাশা অনুযায়ী রান তুলতে পারেননি। শেষ ৩৫ বলে কলিংউড, প্রায়র, ব্রেসনানরা মিলে তোলেন মাত্র ৩৯ রান! এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কলিংউডের ১১ বলে ১৬ রান। তারপরও ৫০ ওভার শেষে ইংল্যান্ডের স্কোর গিয়ে পৌঁছে ৮ উইকেটে ৩২৭ রানে। ৬৩ রানে চার উইকেট নিয়ে মুনিই ছিলেন আয়ারল্যান্ডের পক্ষে সেরা বোলার।
৩২৮ রানের বিশাল টার্গেট দেখে মনে হচ্ছিল ম্যাচ বুঝি এখানেই শেষ। আগের ম্যাচে বাংলাদেশের দেয়া ২০৬ রানের টার্গেটেই মুখ থুবড়ে পড়া আয়ারল্যান্ডের পক্ষে এত বড় টার্গেট টপকে ম্যাচ জেতার স্বপ্ন দেখাটা রীতিমত দুঃসাহসের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু কথায় আছে না ‘এভরি ডে ইজ নট সানডে’। আর প্রচলিত ধারণার বাইরেও অনেক কিছু ঘটে বলেই তো ক্রিকেটকে বলা হয় গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। ক্রিকেট নিয়ে প্রচলিত এই চিরন্তন প্রবাদ বাক্যটি ভুলে গেলে তো চলবে না। আইরিশদের সৌজন্যে সেদিন আরো একবার যার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল।
বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ইনিংসের প্রথম বলেই আইরিশ অধিনায়ক উইলিয়াম পোর্টারফিল্ডের স্টাম্প ভেঙে ছত্রখান করে দেন ইংলিশ পেসার জিমি অ্যান্ডারসন। তবে শুরুর ধাক্কা দ্রুতই সামলে নিয়ে ৬২ রানের জুটি গড়ে ফাইটব্যাকের সূচনা করেন পল স্টার্লিং আর এড জয়েস। ৩২ রান করা স্টার্লিংকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙ্গেন ব্রেসনান। তৃতীয় উইকেট জুটিতে দুই বাঁ-হাতি জয়েস এবং নিয়াল ও’ব্রায়েন মিলে যোগ করেন আরো ৪১ রান। অফ স্পিনার গ্রায়েম সোয়ানের ঘূর্ণিতে নিয়াল ও’ব্রায়েন (২৯) আউট হতেই ছোটখাট একটা ধস নামে আইরিশ ইনিংসে। সোয়ানের আঘাতে জয়েস (৩২) ও গ্যারি উইলসনও (৩) দ্রুত ফিরে গেলে ২৪.২ ওভারে ১১১ রানে ৫ উইকেটে পরিণত হয় আয়ারল্যান্ড।
ম্যাচের অর্ধেকের বেশি তখনও বাকি। শেষ ৫ উইকেট হাতে নিয়ে জয়ের জন্য বাকি ২৫.৪ ওভারে চাই ২১৭ রান। অ্যালেক্স কুসাককে সাথে নিয়ে এখান থেকেই শুরু কেভিন ও’ব্রায়েনের ইতিহাস গড়ার মিশন! হার্ডহিটার হিসেবে আগে থেকেই বেশ নামডাক ছিল এই আইরিশম্যানের। সেই নামের প্রতি সুবিচার করতেই বুঝি উইকেটে নেমেই সেদিন শুরু করলেন আক্রমণ। মুখোমুখি হওয়া দ্বিতীয় বলেই মারলেন বাউন্ডারি! এরপর গ্রায়েম সোয়ানকে মারলেন টানা দুই ছক্কা, মাইকেল ইয়ার্ডিকে টানা দুই বাউন্ডারি, ব্রেসনানকে পর পর দুই বলে এক চার ও এক ছয়, অ্যান্ডারসনের এক ওভারে তিন বাউন্ডারিতে নিলেন ১৪।
জিমি অ্যান্ডারসনকে সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলে ফিফটি পূর্ণ করলেন ৩০ বলে! তবে পরের ৫০ করতে খরচ করেছিলেন মাত্র ২০ বল! ও’ব্রায়েনের দানবীয় আগ্রাসী ব্যাটিং তান্ডবে ব্রড, সোয়ান, অ্যান্ডারসন, ব্রেসনানদের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! দেখতে না দেখতেই ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরিটা তুলে নিলেন মাত্র ৫০ বলে! এর আগে বিশ্বকাপের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ছিল ম্যাথু হেইডেনের, ৬৬ বলে।
ইয়ার্ডির বলে ২ রান নিয়ে ও’ব্রায়েন যখন তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছালেন, গ্যালারির কোলাহল তখন রূপ নিল সমুদ্রের গর্জনে। যেন ভারত নয়, নিজেদের দেশেই খেলছে আয়ারল্যান্ড!
কেভিন ও’ব্রায়েনের বিস্ফোরক ইনিংসটি যে একেবারে চান্সলেস ছিল, তা অবশ্য বলা যাবে না। ৯১ রানের সময় স্ট্রাউসের হাতে ‘একবার’ জীবন ফিরে পেয়েছিলেন তিনি। ১৩ চার আর ৬ ছক্কায় সাজানো ‘অতিমানবীয়’ ইনিংসটাতে খুঁত বলতে কেবল ওইটুকুনই।
ষষ্ঠ উইকেটে অ্যালেক্স কুসাকের সাথে মাত্র ১০৩ বলে ১৬৩ রানের দুর্দান্ত জুটিটাই সেদিন গড়ে দিয়েছিল ম্যাচের ভাগ্য। ২৭৩ রানের মাথায় কুসাকের রান আউটে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ইংলিশরা। ও’ব্রায়েনকে যোগ্য সঙ্গ দেয়া কুসাকের খেলা ৫৮ বলে ৪৭ রানের (৩ চার ও ১ ছক্কা) ইনিংসটাকেও বলতে হবে অসাধারণ।
দলীয় ৩১৭ রানের মাথায় ও’ব্রায়েন নিজেও কাটা পড়েন রান আউটের খাঁড়ায়। রূপকথার গল্পের পূর্ণতা দিতে তখনও চাই ১১ বলে ১১ রান! হাতে মাত্র ৩ উইকেট! ইতিহাসের এই হাতছানি কী করে উপেক্ষা করেন ও’ব্রায়েনের সতীর্থরা! হ্যাঁ, বাকি কাজটুকু ঠিকঠাক মতই করতে পেরেছিলেন দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান জন মুনি আর ট্রেন্ট জন্সটন। আর তাতেই কেভিন ও’ব্রায়েনের ৬৩ বলে ১১৩ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংসটি পেয়েছিল অমরত্ব!
জিমি অ্যান্ডারসনের করা শেষ ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারি মেরে ৫ বল বাকি থাকতেই জয় নিশ্চিত করা জন মুনিও উপহার দিয়েছিলেন ৩০ বলে ৩৩ রানের দারুণ একটি ‘ক্যামিও’।
সেবারের বিশ্বকাপে কোন অঘটন ঘটছে না বলে অনেকেই হা হুতাশ করছিলেন। তবে আইরিশদের জয়টাকে যদি আপসেট বলা হয় তাহলে হয়ত তাদের প্রতি অন্যায় করা হবে। কারণ এক ম্যাচে যে দল বিশ্বকাপের এতগুলো নতুন রেকর্ডের জন্ম দেয় সে ম্যাচটাকে অঘটন বলা মানে জয়ী দলকে খাটো করা। বিশ্বকাপের সবচাইতে বেশি রান তাড়া করে ম্যাচ জয়, বিশ্বকাপের দ্রুততম সেঞ্চুরি, সব মিলিয়ে ‘ফেভারিট’ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘আন্ডারডগ’ আয়ারল্যান্ডের ৩ উইকেটের এই জয়টা বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য একটি ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবেই ধরে নেয়া উচিত।