আহা কি দেখিলাম!

শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের বলা একটা কথা খুব মনে পড়ছে আজ। ব্রায়ান লারা, অ্যালান বোর্ডারদের টপকে যেদিন মোহালিতে টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হলেন, সেদিন সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন কথাটা, ‘তোমার দিকে যদি কেউ পাথর ছুঁড়ে মারে, সেটাকে মাইলফলকে পরিণত করো।’ তা এবার আজিঙ্কা রাহানের ভারতকে দেখে মনে হচ্ছিলো, অ্যাডিলেড থেকে মেলবোর্ন, সিডনি হয়ে ব্রিসবেন, এই আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ জুড়ে পুরোটাই তারা মাইলফলকে ঢেকে দিয়েছে।

কম পাথর তো ধেয়ে আসেনি অ্যাডিলেডের সেই অভিশপ্ত দুপুরের পর। এবং এখন বলতে বাধা নেই, এই অধমও তাদের মধ্যেই ছিল, যারা পাথর-আধলা ইঁট-থান ইট কিছুই ছুড়তে বাকি রাখেনি। তার ওপর বিরাট কোহলি, জাসপ্রিত বুমরাহ, রবিচন্দ্রন অশ্বিন ইত্যাদি সকলেই বাইরে। এরপর তো ধবলধোলাইয়ের ধ্বংসস্তূপে আটকে পরা সময়ের অপেক্ষা। তাও তো জিতলো রাহানের ভারত। মাইলফলক গুলো যেন ঠিক এই কারণেই আর পাথরের মাইলফলক দেখাচ্ছে না, মনে হচ্ছে হাইওয়ের ধারের সুন্দর হ্যালোজেন।

আজ খুব মনে পড়ছে কমল গুহর কথা। কোন কমল গুহ? মতি নন্দীর ‘স্টপার’ উপন্যাসটা। রিক্ত, শূন্য, ছাড়খার হয়ে যাওয়ার পরেও কোনোভাবে লড়াই দিয়ে যুগের যাত্রীকে লিগ না জিততে দেওয়ার লড়াইটা। হনুমা বিহারি, রবিচন্দন অশ্বিন, চেতেশ্বর পূজারার ভারতও কি মতি নন্দীর উপন্যাসের নায়ক নন? কারোর গায়ে তকমা লাগা খুব স্লো খেলেন, কেউ আবার কঠিন টেস্ট বাঁচিয়ে আসার পরেও ব্যঞ্জনা শোনেন, ‘আরে ও যে জয়ের সুযোগটাই হাতছাড়া করলো।’

কেউ আবার যথেষ্ট তাড়াতাড়ি দৌড়োতে পারেননা বলে দর্শককুলের কাছে অপ্রিয়। তাঁরাও তো সকলেই কোথাও না কোথাও গিয়ে রিক্ত, শূন্য, দেহে লাল বলের দাগে ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু তাও লড়াই ছাড়েননা, অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট জিততে দেননা।

আজ খুব মনে পড়ছে ‘লাগান’। ওই যে রহমান সাহেবের রক্ত গরম করা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের তালে ভুবন আর ইসমাইল ব্যাট করছেন। ‘রে ভাইয়া ছুটে লাগান।’ একজন দলের তারকা, আরেকজন ভাঙা পা নিয়ে খেলেই চলেছে। লালমুখো ইংরেজরা আর কিছু না পেয়ে শেষে মানকাডিং করে আউট করছে তাকে। আজকে ব্রিসবেনেও কি ভুবন ও ইসমাইল কে দেখিনি আমরা?

ভুবন রুপি ঋষভ পান্ত একদিকে নিজের তারাবাজি দেখাচ্ছেন, তো আরেকদিকে মাথায়, গায়ে, পিঠে, আঙুলে খেয়েও দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছেন ‘চে’ পূজারা। ওদিকে একটু একটু করে নিজেদের হারিয়ে ফেলছে লালমুখো অহংকারী অসির দল।

আজ খুব মনে পড়ছে টনি গ্রেগের কথা। সেই ১৯৭৬ সালে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছিলো ইংল্যান্ড সফরে। সফরের আগে ইংল্যান্ড অধিনায়ক গ্রেগ বলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নতজানু করবো। লয়েডের দল এমন তেতে যায়, যে ইংল্যান্ডকে নিজেদের মাঠেই চোখে তারা দেখিয়ে দেয়। হোল্ডিংয়ের বাউন্সারে এমন অবস্থা হয় তাদের, যে বাধ্য হয়ে বৃদ্ধ ব্রায়ান ক্লোসকে ফিরিয়ে আনতে হয়।

টিম পেনের অশ্বিনকে বলা ‘গ্যাবায় এসো, দেখে নিচ্ছি’ কি টনি গ্রেগের সেই কুখ্যাত মন্তব্যের সমতুল্য নয়? যা শুধু অশ্বিন না, গোটা টিমকে তাতিয়ে দেয়। অস্ট্রেলিয়াকে হয়তো পন্টিংকে ফিরিয়ে আনতে হয়নি। কিন্তু ব্যাটিংয়ের যা অবস্থা করে ছাড়লো আনকোড়া থাঙ্গারাসু নটরাজন, মোহাম্মদ সিরাজ, শার্দুল ঠাকুর, ওয়াশিংটন সুন্দররা তাতে সেই সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিলো না।

আজ মনে পড়ছে ১৯ ডিসেম্বরের কথা। কি মন খারাপটাই না ছিল। কি রাগ। এখন মনে হচ্ছে সেদিন রাতে ঘুমিয়েই কোনো অলীক সুস্বপ্ন দেখছি। রোববার সকালে ঘুমটা ভাঙলেই আবার ৩৬ অল-আউটের খারাপ স্মৃতিগুলো গিলতে আসবে। পরক্ষণেই চিমটি কেটে দেখছি, আরে এটা তো বাস্তব। এটাও বাস্তব আমার পাশের সিটের সহকর্মী, যিনি কদিন আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘কি সারাক্ষণ টেস্ট ম্যাচ চালিয়ে দেখছো?’ তিনি আজ শেষ একঘন্টা নিষ্পলক চোখে আমার সাথে বসে ম্যাচ দেখলেন। ওই যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কি একটা বলেছিলেন না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link