অগ্নিবানে অসহায় অন্তযাত্রা

সতীর্থদের কাছে ‘বিগ ক্যাট’ নামেই পরিচিত ছিলেন কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান তারকা ক্লাইভ লয়েড। ৬ ফুট ৫ ইঞ্চির এই ক্যারিবিয়ান অধিনায়কের ডায়েরিতে অলরাউন্ডার শব্দটা ছিল না বললেই চলে। পাঁচ বোলার, পাঁচ ব্যাটার আর এক উইকেটরক্ষক – এগারো জনের দল। সত্তরের দশকে ক্রিকেটে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বেশ প্রতাপ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দাপটের সামনে প্রতিপক্ষের জন্য টেকা ছিল বড় দায়।

সাল ১৯৭৬। সেবার বিষাণ সিং বেদির নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায় ভারত। অপরদিকে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ হেরে কিছুটা ব্যাকফুটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাই ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জিততে মরিয়া ছিল ক্লাইভ লয়েডের দল। প্রথম টেস্টে ক্যারিবিয়ানদের দাপটের সামনে পাত্তাই পায়নি ভারত। দ্বিতীয় টেস্টে সুনীল গাভাস্কারের ব্যাটে ভারতের দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনে পোর্ট অব স্পেন টেস্টটা ড্র করে ভারত।

তৃতীয় টেস্টেও জয়ের হাতছানি ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে। ৪০৩ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ভারতের সামনে। ক্লাইভ লয়েড হয়ত মনে মনে ভেবে ফেলেছিলেন এই টেস্টেও বড় জয়ের দেখা পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু চতুর্থ ইনিংসে সুনিল গাভাস্কার, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের দুই দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে ৬ উইকেটে ম্যাচটিতে জিতে নেয় ভারত!

সেই ক্ষোভটা লয়েড ঝেড়েছিলেন পরের টেস্টে। সিরিজ নির্ধারণী চতুর্থ টেস্টে স্যাবাইনা পার্কে লয়েড তাঁর বাহিনী নিয়ে নামলেন নতুন এক কৌশল সমেত। ভারতকে গতি দিয়ে পরাস্থ করার কৌশল। মাইকেল হোল্ডিং, ভ্যানবার্ন হোল্ডার, বার্নার্ড জুলিয়ান, ওয়েন ড্যানিয়েল – চার বিধ্বংসী পেসার নিয়ে সাজানো হল একাদশ। গতির ঝড়ে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে এই পেস চতুষ্টয় ছিল যথেষ্ট।

এপ্রিল ২১, ১৯৭৬। টস জিতে বোলিংয়ে নিলেন লয়েড, এমনটাই অনুমেয় ছিল। কারণ স্যাবাইনার উইকেট এমনিতেই বোলিং সহায়ক। ব্যাট করতে নেমে ক্যারিবিয়ান পেসারদের তোপের সামনে ভারত। হোল্ডিং, জুলিয়ানরা যেন একের পর এক আগুনের গোলা ছু্ঁড়ছিলেন গাভাস্কার, গাইকড়দের দিকে। উইকেট ফেলতে পারছিলেন না ঠিক কিন্তু ক্ষিপ্র গতি আর বিষাক্ত বাউন্সে দুই ওপেনারকে স্বস্তি দেয়নি ক্যারিবীয় পেসাররা।

লয়েডের লক্ষ্য তখন স্পষ্ট। গতিতে দিয়েই ভারতকে মার‍তে চান তিনি। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬ উইকেট হারায় ভারত। ৬ উইকেটের বিনিময়ে করেন ৩০৬ রান। এর মাঝেই তিন ব্যাটার আহত হয়ে ড্রেসিং রুমে। ক্যারিবীয় পেসারদের তোপের মুখে শেষ পর্যন্ত ৩০৬ রানে ইনিংস ঘোষণা করতে বাধ্য হন ভারতীয় অধিনায়ক বিষাণ সিং বেদি। হোল্ডিং একাই নেন ৪ উইকেট।

নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ওপেনিং জুটিতে ১০৫ রান তুলে রয় ফেড্রিক্স ও লরেন্স রো। এরপর ভগবত চন্দ্রশেখরের স্পিন বিষে উইকেট হারিয়ে ৩৯১ রানে অলআউট হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চন্দ্রশেখর শিকার করেন পাঁচ উইকেট।

৮৫ রানে পিছিয়ে থেকে চতুর্থ দিনে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামে ভারত। ক্লাইভ লয়েড এই ইনিংসেও একই কৌশল নিয়ে নামলেন। হোল্ডিং, হোল্ডারদের দিয়ে একের পর এক বাউন্সার মারলেন, গতির ঝড় তো আছেই। মাহিন্দার অমরনাথই শুধু মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। বাকিদের অবস্থা শোচনীয়। গতি আর বাউন্সারে এক প্রকার ভারতীয় ব্যাটারদের উপর অত্যাচার করছিলেন হোল্ডিং-হোল্ডার জুটি। গ্যালারি থেকে হোল্ডিংকে উদ্দেশ্যে করে দর্শকরা উঁচু গলায় বলছিল,‘কিল হিম, ম্যান!’, ‘টেক হিম ডাউন, মাইক।’

এবার বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করলেন বিষাণ সিং বেদি! মাত্র ৯৭ রানেই ইনিংস ঘোষণা। সবে মাত্র ৮৫ পেরিয়ে লিড দিতে শুরু করেছে ভারত। হাতে তখনও ৫ উইকেট। কিন্তু ব্যাটিং করার মতন অবস্থায় নেই কেউই! বাধ্য হয়েই ৯৭ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত।

মাত্র ১৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ১১ বলেই জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওই টেস্টে একটা সময় এমন অবস্থা ছিল যে ভারতের স্কোয়াডের ১৭ জন ক্রিকেটারই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মাঠে নেমেছে। ইনজুরিতে এমন অবস্থা ছিল যে ফিল্ডিংয়ে এগারো জন মেলাতেই হিমসিম খায় ভারত। সেই টেস্টে মাত্র ১১ উইকেট হারালেও দশ উইকেটে হারে ভারত! চার ম্যাচ টেস্ট সিরিজ সেবার ২-১ এ জিতে নেয় ক্যারিবিয়ানরা। তবে, জয়-পরাজয় ছাপিয়ে বাইশ গজের রক্তবন্যার জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছে সেই সিরিজ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link