আজিঙ্কা রাহানে খেলছেন। নিজের জন্য, কলকাতা নাইট রাইডার্সের জন্য — আরও গভীরে গেলে, ক্রিকেটের জন্য। বাইশ গজে তাঁর অস্তিত্ব মানে কেবল ব্যাট-প্যাডের সংযোগ নয়, মানে এক জীবন দর্শন। তিনি খেলছেন কেকেআরের জার্সিতে, কিন্তু তাঁর ব্যাটের প্রতিটা শট যেন নিবেদন বিরাট কোহলির প্রতি, শ্রদ্ধা কেন উইলিয়ামসনের প্রতি।
খেলছেন টি-টোয়েন্টির সেই ওল্ড স্কুলের জন্য, যেখানে ব্যাট হাতে আগ্রাসন মানেই উন্মত্ততা নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত আগুন। যেখানে বলকে মর্যাদা দিতে হয়, প্রতিপক্ষকে সম্মান জানাতে হয়। আর সেই সম্মান দেখিয়েই তাঁকে দিতে হয় জবাব — তীক্ষ্ণ, নির্ভুল, ব্যাকরণের মায়াজালে মোড়া। যেখানে চাইলেই ভুল ধরতে আসার সাধ্য যে কারও কল্পনারও বাইরে!
রাহানের ব্যাটিং এক প্রবাহমান নদী। কখনো শান্ত, কখনো স্রোতের গভীরে গুমরে ওঠা বিদ্রোহ। তাঁর জন্য প্রতিটি ডেলিভারি যেন এক নতুন সম্ভাবনা। বলেরও আত্মমর্যাদা আছে, সে কেবল মার খাওয়ার জন্য জন্ম নেয়নি। সে কখনো সীমানার ওপারে উড়ে যেতে চায়, কখনো চায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দৌড়াতে, আবার কখনো নি:শব্দে উইকেটরক্ষকের দস্তানায় আশ্রয় নেয়। রাহানে সেটাই বোঝেন, বলের ইচ্ছেকে সম্মান জানান। কিন্তু, তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন নিজের মত করে। ওটাই তো ক্রিকেটের ব্যকরণ, ওটাই রাহানের দর্শন।
এই ব্যাটিংয়ে চোখ-ধাঁধানো চাকচিক্য নেই, সুপারম্যান সুলভ স্ট্রাইক রেটের গর্জন নেই। কিন্তু আছে নির্মল সৌন্দর্য, নদীর মতোই গভীর এক শৃঙ্খলা। প্রয়োজন হলে রাহানে উত্তাল হন, প্রতিপক্ষকে ভাসিয়ে নিয়ে যান। আর প্রয়োজন না হলে তিনি ধীরে বইতে জানেন, একদম নি:শব্দে, স্থিরতায় মোড়া এক প্রবাহ। কিন্তু, সেই প্রবাহ চললে রান আসবেই। তাই তো তাঁকে চাইলেই বাতিল করা যায় না।
তবু, ক্রিকেটের বাজার নিষ্ঠুর। এক মৌসুম খারাপ করলেই তাঁকে ছুড়ে ফেলে চেন্নাই সুপার কিংস। অথচ যখন দরকার পড়ে, তখন তাঁকেই দেড় কোটিতে কিনে অধিনায়কের আসনে বসিয়ে দেয় কলকাতা নাইট রাইডার্স। যেখানে কেউ কেউ ডিভোর্সের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পৌঁনে পাঁচ কোটি রুপি গুনে দেয়, সেখানে রাহানে কিনতে লাগে সামান্য একটা দর, তাও কেনা যায় কেউ আগ্রহী নয় বলে। জাতীয় দলেও তাঁকে ছিটকে দিয়েছিল মাত্র একটা বাজে বছর।
কিন্তু, রাহানেদের লড়াই কোনো অর্থমূল্যে কেনা যায় না। তাঁদের প্রতিটা ইনিংস অমূল্য। তাঁদের সংগ্রাম বিক্রয়যোগ্য নয়। একটা সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি রাহানের জন্য যথেষ্ট নয়, একটা আইপিএলও নয়। তিনি শিরোপার জন্য খেলেন না, তিনি খেলেন ক্রিকেটের শুদ্ধতম রূপের জন্য। এই লড়াই তাঁর একার নয়, বিরাট-উইলিয়ামস কিংবা স্টিভেন স্মিথ – সবার।
তাঁকে অধিনায়ক করা হলে অনেকেই বলেছে, আর কেউ ছিল না বলে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাহানেকে। কলকাতার হাতে নাকি বিকল্প ছিল না! কিন্তু রাহানে খেলছেন। ইডেন গার্ডেন্সের ধুলো মেখে, বাইশ গজের কোলাহলে নিজের নিরব স্বপ্ন বুনে তিনি লড়ে যাচ্ছেন। হয়তো এই মৌসুম শেষে তাঁকে আর কেউ মনে রাখবে না, তাঁর দাম খুব বেশি বাড়বে না, কলকাতা তাঁকে ধরে রাখবে কি না — সে অনিশ্চিত। কিন্তু রাহানে জানেন, তিনিই পারেন সবার হয়ে লড়তে।
তাঁর ব্যাট যখন কথা বলে, তখন সেটা শুধু রাহানের কথা নয়—তখন সেটা বিরাটের কথা, তখন সেটা কেনের কথা। তখন, সেটা ক্রিকেটের এক অমর ব্যাকরণ। সেই ব্যকরণের ভুল ধরতে নেই!