অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়, অভাবনীয় – এই ধরনের শব্দগুলোও আসলে কখনও কখনও যথেষ্ট মনে হয় না।
রূপকথা? শ্যামার জোসেফকে নিয়ে এই কথা তো এর মধ্যেই কয়েকবারই লিখতে হয়েছে। যে নিভৃত গ্রাম থেকে উঠে এসে তিনি টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন, চমকপ্রদ গল্পটি লিখেছিলাম কয়েকদিন আগে। টাইমলাইনে একটু স্ক্রল করলেই পাবেন। অমন জায়গা থেকে উঠে এসে তিনি টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন, এটাই বিস্ময়কর। সেই তিনি প্রথম দুই টেস্টেই যা করলেন, শেষ দিনে যা করলেন – রূপকথাও আসলে এতটা রূপকথাময় হয় না।
সাড়ে তিনশো মানুষের এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, যেখানে নদীপথে পৌঁছাতে কখনও কখনও দুই দিন লেগে যায়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত যেখানে টেলিফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট ছিল না, সেখানেই বেড়ে ওঠা ছেলেটি, বছর দেড়েক আগেও যিনি নৈশপ্রহরীর চাকরি করতেন।
১১ দিন আগে তার টেস্ট অভিষেক হলো, ক্যারিয়ারের প্রথম বলে স্টিভেন স্মিথের উইকেট নিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ায় ৫ উইকেট নিলেন এবং আজকে…
আজ তাঁর হাত ধরেই অস্ট্রেলিয়াকে প্রায় ২০ বছর পর টেস্ট হারাতে পারল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অস্ট্রেলিয়া সফরে যাওয়া স্মরণকালের দুর্বলতম ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটিই অস্ট্রেলিয়ার মাঠে জয়ের দেখা পেল ২৬ বছরের খরা ঘুচিয়ে।
কার ভাবনায় আসতে পারে এমন চিত্রনাট্য? কে লিখতে পারেন এমন রূপকথা!
তার বারাকারা গ্রাম বা উঠে আসার গল্প, সেসব আপাতত আড়ালে রেখে এই ছবিটা দেখুন। আজকে গ্যাবার সবুজ আঙিনায় তার খ্যাপাটে উদযাপনের অনেক ছবি আছে। তবু এই ছবিটাই দিলাম। গতকালকে মিচেল স্টার্কের ইয়র্কার পায়ের অগ্রভাগে ছোবল দেওয়ার পর এভাবেই মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি। কালকে তিনি বোলিং করতে পারেননি, আজকেও পারবেন না বলে ধরেই নিয়েছিল দল…
সেই তিনি আজ মাঠে ফিরলেন। বল যখন হাতে নিলেন, ইনিংসের ততক্ষণে ২৮ ওভার পেরিয়ে গেছে। স্টিভেন স্মিথ ও ক্যামেরন গ্রিনের জুটি দাঁড়িয়ে গেছে। তিনি বোলিংয়ে এসেও প্রথম ওভারে দুই বাউন্ডারিতে দিলেন ১০ রান। এরপর?
এরপর ক্যারিবিয়ান পেস কিংবদন্তিদের সোনালি সময়ের আভা ছড়িয়ে পড়ল যেন গ্যাবার ২২ গজে। তিনি কখনও ওয়েস হলের মতো আগ্রাসী, কখনও মাইকেল হোল্ডিংয়ের মতো ভীতি জাগানিয়া, কখনও জোয়েল গার্নারের মতো ক্ষুরধার, কখনও কার্টলি অ্যামব্রোসের মতো বিধ্বংসী আর কখনও ম্যালকম মার্শালের মতো পরিপূর্ণ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন অস্ট্রেলিয়ায় সর্বশেষ টেস্ট জিতেছিল, পার্থে সেই টেস্টে আগুন ঝরিয়েছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোস আর ইয়ান বিপশ। এই শামার জোসেফের তখন জন্মও হয়নি। আজ তিনি আগুনে স্পেলেই মনে করিয়ে দিলেন ক্যারিবিয়ান পেস ঐতিহ্যের সব নায়ককে।
এক স্পেলেই এক জীবনের রসদ। প্রতিটি উইকেটই যেখানে একেকটি গল্প। তাঁর ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে বল পিচ করার জায়গাটায় বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ক্যামেরন গ্রিন। হয়তো ভাবছিলেন, এই লেংথ থেকে বল এতটা লাফিয়ে উঠল কীভাবে!
পরের বলটি চমকে দিল ট্রাভিস হেডকে। প্রথম বলেই অমন এক ইয়র্কারের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। তার কাছে ছিল না জবাব। আগের টেস্টের ঝড়ো সেঞ্চুরিয়ান এবার ‘কিং পেয়ার’, মানে দুই ইনিংসেই ‘গোল্ডেন ডাক’।
দুটি ডেলিভারিই ছিল ১৪১ কিলোমিটার ছাড়ানো। ক্রমে তিনি ছাড়িয়ে যেতে থাকলেন নিজেকে। ১৪২, ১৪৩, ১৪৪!
১৪৪ কিলোমিটার ছাড়ানো দারুণ এক ডেলিভারিতে বিদায় করে দিলেন তিনি মিচেল মার্শকে। প্রথম ইনিংসে পাল্টা আক্রমণে ফিফটি করা অ্যালেক্স কেয়ারিকে এবার ২ রানেই বোল্ড করে দিলেন ১৪৫.৪ কিলোমিটার গতির গোলায়। ধারাভাষ্যকক্ষে তখন ইয়ান স্মিথের চিৎকার, “দিস ইয়াং ফেলা ইজ ক্রিয়েটিং হিস্টরি হিয়ার টুডে, ফোকস!
ইতিহাস গড়ার তখনও বাকি ছিল। তিনি সেই পথ ধরে ছুটলেন, ক্যারিবিয়ান পেস-দানবদের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে। ক্যামিও ইনিংস খেলে ঝামেলা পাকানো মিচেল স্টার্ককে থামিয়ে দিলেন ১৪৬.৮ কিলোমিটার গতির তোপে। ৬.৫ ওভারেই ৫ উইকেট!
এরপর প্যাট কামিন্সের উইকেট নিয়ে আরেকটি বাধা সরানো। ডিনার ব্রেকের আগে ১০ ওভারের টানা স্পেল। ব্রেকের পর যখন রোমাঞ্চ-নাটকীয়তা তুঙ্গে, স্টিভেন স্মিথের মহাকাব্যিক লড়াই যখন পূর্ণতা পাওয়ার পথে, প্রতিটি মুহূর্ত যখন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার।
তখনই শেষ ব্যাটসম্যান জশ হেইজেলউডের বেলস উড়িয়ে দিয়ে তিনি ছুটলেন বাঁধানহারা দৌড়ে। যেন উসাইন বোল্ট, তাকে আর পায় কে! তিনি ছুটছেন গ্যাবার সবুজ ঘাসে, পেছনে ছুটছে দলের সবাই – অপার্থিব এক দৃশ্য!
এক ছুটে মাঠের মাঝখান থেকে গ্যালারির কাছে গিয়ে থামলেন। এতটা পথ পেছনে দৌড়ে গিয়ে এক লাফে তার কাঁধে উঠে গেলেন কার্ক ম্যাকেঞ্জি। একে একে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন সবাই। সতীর্থদের আলিঙ্গনে তিনি হারিয়ে গেলেন। তার জায়গা তখন ইতিহাসে।
৬৮ রানে ৭ উইকেট। কার্টলি অ্যামব্রোসের ৩১ বছর পর অস্ট্রেলিয়াতে ৭ উইকেট নিতে পারলেন কোনো ক্যারিবিয়ান বোলার।
অথচ নায়ক হতে পারতেন স্টিভেন স্মিথ। ওপেনার হিসেবে দ্বিতীয় টেস্টেই ‘ক্যারিং দা ব্যাট থ্রু আ কমপ্লিটেড ইনিংস’ কীর্তি গড়লেন। অসাধারণ লড়িয়ে এক ইনিংস খেললেন। জয় থেকে স্রেফ দুটি শট দূরে নিয়ে গেলেন দলকে। তার ক্যারিয়ারের সেরা দুই-তিন ইনিংসের একটি, হয়তো।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে রইলেন ট্র্যাজেডির নায়ক। কারণ, গায়ানার দুর্গম গ্রামে লেবু আর পেয়ারা দিয়ে বোলিং করা ছেলেটি, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের মূল স্রোতের বাইরে থেকে উঠে আসা ক্রিকেটার, সংসার আর ক্রিকেটের লড়াই চালাতে নাইটগার্ডের চাকরি করা স্বপ্নাতুর সেই মানুষটি, ফিজিও আর সতীর্থের কাঁধে ভর দিয়ে গতকাল মাঠ ছেড়ে যাওয়া এক ফাস্ট বোলার – এখানেই রচনা করলেন ক্রিকেটের চিরায়ত গল্পগাঁথায় অমর হয়ে থাকার মতো এক আখ্যান।
অস্ট্রেলিয়ান সমর্থক হিসেবে প্রিয় দলের যে কোনো পরাজয়ই আমাকে পোড়ায়। তবে কিছু কিছু ম্যাচ তো জয়-পরাজয় কিংবা ক্রিকেটের সীমানা ছাপিয়ে যায়। টেস্ট নম্বর ২৫২৪, ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট নম্বর ৫৭৫, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় নম্বর ১৮৩ – এসব এখন আর স্রেফ বেরসিক কিছু সংখ্যা নয়, বরং ওয়েস্ট ইন্ডিজের তথা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের সেরা জয়গুলির একটির প্রতীক।
এই জয়ে হয়তো কিছুই বদলাবে না ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের। টেস্ট ক্রিকেট সেখানে বিরাট গুরুত্ব পাওয়া শুরু করবে না, টাকার জোগান বাড়বে না, কেন্দ্রীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর না করা তারকারা টেস্ট খেলতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না, তাদের ক্রিকেটের বাস্তবতা বদলাবে না, শ্যামার জোসেফও হয়তো কদিন পর বুঁদ থাকবেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে।
তবে অনেক অনেক দিন পর, সেই ক্যারিবিয়ান রোমাঞ্চের দোলা খানিকটা নাড়া দিল ক্রিকেট বিশ্বকে। ক্যারিবিয়ান আবেগের স্রোতের হারিয়ে বসা জোয়ার একটু হলেও অনুভব করা গেল।
যে অনুভূতির ছোঁয়ার ধারাভাষ্যকক্ষে থাকা ব্রায়ান লারার চোখে দেখা গেল জল। ক্রিকেটের নির্মল আনন্দের রাজপুত্র কান্নার দমকে ধরে আসা গলায় উচ্চারণ করলেন, ‘এই তরুণ, এই অনভিজ্ঞ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল, যাদেরকে কেউ গোনায় ধরেনি, তারাই এখানে মাথা তুলে দাঁড়াল… ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটেরও আজ শির উঁচু হয়ে গেল।’
– ফেসবুক থেকে