শীতকালীন দলবদলের মৌসুমে লোকেদের নজর থাকে ট্রান্সফার মার্কেটে। যেকোনো সময় যেকোনো ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারে নাকের আগা দিয়ে, খেয়ালও থাকবে না। গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মতন বড় অংকের লেনাদেনা খুব কম হয় এসময়। বরং শুরুর অর্ধেক মৌসুমের ল্যাকিংসগুলো পূরণ করে নেয় দলগুলো। তবে এই খেলোয়াড়দের দলবদলের সময়ে অদলবদল চলছে কোচেদের। ক্লাব লিজেন্ড ল্যাম্পার্ডকে পত্রপাঠে বিদায় জানিয়েছে চেলসি।
তাঁর জায়গায় কোচ হিসেবে এনেছে থমাস টুখেলকে। যিনি ক্রিসমাস ইভেনিংয়ে ছাটাই হয়েছিলেন আরেক জায়ান্ট পিএসজি থেকে। দেড় বছরের চেলসি কোচিং জীবনে কোনো শিরোপা আনতে পারেননি ঘরে। এমনকি স্বপ্নও দেখাতে পারেননি। বরং খরচ করেছিলেন প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড। ল্যাম্পার্ড আর চেলসির এই নিজেদের পথ দেখার নৈপথ্যের কারণ তবে কী?
চেলসি তাদের লিজেন্ড ল্যাম্পার্ডের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল এক তথৈবচ অবস্থার মধ্যে। মাউরিৎজিও সারিকে সরিয়ে কোচ হয়ে আসা ল্যাম্পার্ডের সামনে ছিল অনেক কিছু পেরোনোর ভয়। একে তো ট্রান্সফার ব্যান, চাইলেও কাউকে কিনতে পারবে না চেলসি। অন্যদিকে চেলসি ম্যানেজমেন্টের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। দুইকে একসাথে সামাল দেওয়া বেশ কষ্টের কাজ ছিল ল্যাম্পার্ডের জন্য। সেটা সামাল দিয়ে ল্যাম্পার্ড চেলসিকে ভালোই পথে রেখেছিলেন। চেলসি অ্যাকাডেমি আর লোনে থাকা খেলোয়াড়দের ভিড়িয়ে ঠিকই চ্যাম্পিয়নস লিগে পজিশন রাখেন ল্যাম্পার্ড।
তবে এবারের মৌসুমে সে ফর্মের ধারে কাছে ভিরতে পারেননি ল্যাম্পার্ড। ২০০ মিলিয়ন খরচ করে ৬ জন খেলোয়াড়কে কেনার পরেও এমন রেজাল্ট পেলে অবশ্যই খুশি হবে না বোর্ড। সে যত বড়ই ক্লাব লেজেন্ড হোক না কেন। চেলসি বোর্ড আবার এক কাঠি সরেস কোচেদের বরখাস্ত করবার বেলায়। ১৯ ম্যাচে ২৯ পয়েন্ট নিয়ে লিগ টেবিলের দশে থাকাই কাল হয়েছে ল্যাম্পার্ডের জন্য। নতুন বছর শুরুর ২৫ দিনের মাথায় ছাড়তে হুয়েছে ক্লাব, বিদায় বলতে পারেননি নিজের খেলোয়াড়দেরও।
চেলসির বিশ্বস্ত সূত্রমতে বোর্ড কখনোই ল্যাম্পার্ডকে নিজেদের লং টার্ম ম্যানেজার ভাবেনি। বরং ল্যাম্পার্ড এসেছিলেন ক্লাবকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে। করোনার প্রভাবে পুরো বিশ্ব থমকে না গেলে হয়তো এই মৌসুমের শুরুতেই চেলসির ডাগ আউটে পরিবর্তন দেখা মিলত। কিন্তু করোনার প্রভাবে এই অহেতুক রিস্ক নিতে চায়নি চেলসি। তাই ল্যাম্পার্ড বহাল ছিলেন স্বপদেই। তবে ভেতরে ভেতরে ঠিকই আওয়াজ পাচ্ছিলেন ভাঙ্গনের। ১৬ বছর খেলে গিয়েছেন এই ক্লাবে। ক্লাবের ভেতর বাহির, আগা-গোড়া সবই তার চেনা। তার আসার আগের ১৪ বছরে ক্লাব পত্রপাঠে বিদায় করেছে ১৫ জন কোচকে। ল্যাম্পার্ড যে ১৬ তম হবেন না, এটা ভাবাও অসম্ভব ছিল। তাই তিনি চাচ্ছিলেন নিজের মতো ক্লাবকে একটু গুছিয়ে নিতে। কিন্তু সেখানেও মনমালিন্য শুরু হয়েছিল বোর্ড আর ল্যাম্পার্ডের।
আর্সেন ওয়েঙ্গার একবার ট্রান্সফার উইন্ডো নিয়ে বলেছিলেন, ‘যদি কোনো ম্যানেজার নিজের দলের জন্য এক উইন্ডোতে তিনজনের বেশি মূল দলের জন্য খেলোয়াড় কিনে, তবে সে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারে।’
কথাটা আপাত দৃষ্টিতে খুবই অদুভ লাগলেও সত্য। তিনজন মূল দলের খেলোয়াড় কেনা মানে, আগের মৌসুমের দল থেকে তিনজনকে ছেঁটে ফেলে দেওয়া। তার সঙ্গে নতুন খেলোয়াড়দের মানিয়ে নেওয়া, যা সব মিলিয়ে খুবই দীর্ঘস্থায়ী একটা প্রক্রিয়া। সাবেক রাইভাল কোচের কথা হয়তো মাথায় ছিল ল্যাম্পার্ডের, যে কারণে একটা ছোট্ট বাজারের ফর্দ দিয়েছিলেন চেলসি বোর্ডকে। যাতে ছিল ডিফেন্ড শক্ত করার টোটকা। শর্টলিস্টে ছিলেন বার্নলির জেমস টার্কোওস্কি এবং ওয়েস্টহামের ডেকলান রাইস। স্ট্রাইকে হাকিম জিয়েখ আর একজন গোলরক্ষক। কিন্তু ক্লাব ট্রান্সফারের হর্তা-কর্তা মারিনা গ্র্যানোচস্কিয়া এত সহজে সবকিছু করেন না। ল্যাম্পার্ডকে আগে থেকেই ভরসার পাত্র হিসেবে ভাবেনি কেউ। লিগের শেষমূহুর্তে পয়েন্ট খুঁইয়ে গোলব্যবধানে থার্ড প্লেইস হারিয়েছে চেলসি। তাই দলবদলের স্বাধীনতা আগেই কেড়ে নিয়েছিল বোর্ড আর মারিনা।
নিজের শর্টলিস্ট অনুযায়ী রাইসকে কিনতে শুরু থেকেই প্রেশার দিচ্ছিলেন বোর্ডোকে। কিন্তু এই রাইসকেই একসময় চেলসি একাডেমি থেকে রিজেক্ট করে দেওয়া হয়েছিল ‘ট্যালেন্টেড এনাফ’ নয় বলে। সে সময়ও এই ট্রান্সফারের হর্তা-কর্তা ছিলেন মারিনা। তাই তাকেই আবার বড় অংক খরচ করে ফেরত আনতে বেশ ইগোতে লাগছিল হয়তো। শেষপর্যন্ত রাইসকে কেনা হয়নি তার, বরং চেলসি পিএসজি থেকে ফ্রিতে নিয়ে আসে থিয়াগো সিলভাকে। আর তার সঙ্গে ল্যাম্পার্ড কথা শুনেছিলেন, তাকে কেনার জন্য বেশি জোরাজুরি করলে চাকরিও খোয়াতে হতে পারে। শেষপর্যন্ত সেটাই হলো।
এমনকি ৮০ মিলিয়ন দিয়ে কেনা কেপা আরিজাগালাকেও ঠিকমতো কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ল্যাম্পার্ড। বলা বাহুল্য বেশ অনেকদিন ধরেই ফর্মে নেই এই স্প্যানিশ গোলরক্ষক। সিলি মিস্টেক, খেলায় মন থাকাসহ অনেক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। প্রায় ১২ বছরের রিলেশন ভেঙ্গে যাওয়ার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পরেছে খেলায়। তাই তাকে বিক্রির খাতায় তুলে দিতে চেয়েছিলেন ল্যাম্পার্ড। কিন্তু মারিনা তার সবচেয়ে দামী ট্রান্সফারকে এভাবে রসাতলে দিতে যেতে নারাজ। তাই কোনো খেলোয়াড় না কিনে তাকেই ব্যবহার করতে বলেছিলেন। তার রিপ্লেসমেন্ট পেতেও বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে ল্যাম্পার্ডকে। অনেক জুরাজুরি করে ফ্রেঞ্চ লিগ থেকে এডুয়ার্ডো মেন্ডিকে কিনে আনে চেলসি।
কেপার মতন দলের ডেডউডগুলোকে বিদায় করতে চেয়েছিলেন ল্যাম্পার্ড। বিদায় করলে দলের অবস্থা উন্নতি না, সাথে সাথে ট্রান্সফারের জন্য ফান্ডও আসতো। জর্জিনহো, কোভাচিচ; রুডিগার-মার্কোস আলান্সোকেও বিদায় বলতে চেয়েছিলেন। তাতেও বাধ সাধে বোর্ড। তার কথা মতো কেনা-বেচা কোনোটাই করতে দেয়নি তারা।
এটুকু তো গেল ল্যাম্পার্ডের ফর্দ অনুযায়ী। চেলসি যেন গত ট্রান্সফার উইন্ডোতে ছিল টাকা-পয়সা হাতে পেয়ে বাজারে যাওয়া স্বামীর মতন। বাড়িতে যত মাছ-মাংসই থাকুক না কেন, ঝুড়িভর্তি করে বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা কিনে এনে চমকে দিয়েছে সকলকে। এদিকে যে প্রতিদিনের মাছ-মাংস বাদে সবজিও খাওয়া প্রয়োজন, সেদিকে থোড়াই কেয়ার।
ল্যাম্পার্ডের শর্টলিস্টে ছিল ডিফেন্স শক্ত করার কথা। সে অনুযায়ী লেস্টার সিটি থেকে লেফটব্যাক বেন চিলওয়েলকে কিনে চেলসি। আর ফ্রন্ট থ্রির জন্য আয়াক্স থেকে হাকিম জিয়েখ। ব্যস এতটুকুও চাওয়া ছিল ল্যাম্পার্ডের। কিন্তু এতে থামলে কী চলে? ট্রান্সফার মার্কেটের সেরা খেলোয়াড়গুলোকে একে একে ভেরাতে শুরু করল। প্রথমে লাইপজিগ থেকে টিমো ভের্নার, এরপর লেভারকুশেনের কাই হাভার্টজ। এক ধাক্কায় পকেট থেকে ২০০ মিলিয়ন খরচ সম্পন্ন করলো চেলসি। এতে করে ভাবছেন শান্তির সুবাতাস বওয়ার কথা? জ্বি না, ট্রান্সফার উইন্ডোতে আন্দাজে খরচ করলেই যে সব ট্রফি কিনে ফেলা যায় না, তার প্রমাণ পেতে শুরু করল চেলসি।
এমনিতেই এবার প্রাক-মৌসুম ছিল না, তাই ছিল না দলকে ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ। তার উপরে দুই জার্মান-ভাষী খেলোয়াড়, তাদের সাথে মানিয়ে নেওয়াও সহজ নয়। ইংলিশ লিগের মতন হাই-ভোল্টেজ লিগে না জোটে সময়, না চলে এক্সপেরিমেন্ট। আগের মৌসুমের অর্ধেক দলকে বেঞ্চে বসিয়ে নতুন শুরু করতে গিয়ে আর ধরে রাখতে পারেননি ল্যাম্পার্ড। এমনিতেই অভিজ্ঞতা কম, তাই প্রেশার সামাল দিতে গিয়ে দলকেই বিপদে ফেলেছেন। নামতে নামতে ১০ নম্বরে নেমে গিয়েছে তার দল। সাথে সাথে হারিয়েছেন ড্রেসিং রুমও। অতিরিক্ত ট্রেনিং করান বলে খেলোয়াড়রাও অভিযোগ করেছে বোর্ডের কাছে। সব মিলিয়ে দলের ভেতরে বাইরে সব জায়গাতেই নিজের শেষ দেখতে পাচ্ছিলেন ল্যাম্পার্ড। শেষমেশ এই শেষ এলো লেস্টারের বিপক্ষে হারের পর। মালিক রোমান আব্রামোভিচের কাছ থেকে পত্র পেয়ে দল ছাড়েন চেলসির ‘সুপার ফ্র্যাংকি’!
প্রশ্ন হতে পারে সুপার ফ্র্যাংকির ভুলটা কোথায় ছিল? সত্যি বলতে সুপার ফ্র্যাংকির ভুল খুবই নগণ্য। ৪২ বছর বয়সে কোচ হওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। তাও আবার চেলসির মতন ক্লাবে। এর আগে খুব একটা ভালো এক্সপেরিয়েন্সও নেই তার কাছে। ফলে একাডেমি থেকে খেলোয়াড় নিয়ে ঠিকই দল সামলে নিয়েছেন, কিন্তু নতুন ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে আর পেরে উঠেননি।
এছাড়াও ট্যাক্টিসেও খুব একটা পটু নন ল্যাম্পার্ড। প্ল্যান এ ঠিকমতো কাজ না করলেই প্যানিক করতেন, ফলাফলে ব্যাকফুটে থেকে আর ফেরত আসা সম্ভব হতো না। সবমিলিয়ে ল্যাম্পার্ড ছিলেন একজন শিক্ষানবিশ, কিন্তু চেলসির মতন ক্লাবে শিক্ষানবিশদের দাম নেই। এখানে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েও ৪ মাসের মাথায় বরখাস্ত হয়েছে রবার্তো ডি মাত্তেও। এখানে থাকতে হলে লিগ জেতা ছাড়া উপায় নেই। ল্যাম্পার্ড সেখানে পিছিয়ে পরলেন বলেই হয়তো বলি হলেন অকালেই।