ভারত ফাইনালে হারার পরে একটা মতবাদ দেখলাম কেউ কেউ তুলে আনছেন – যে প্রমান হয়ে গেলো ২০০৩ সালে ভারত টসে জিতে ব্যাটিং নিলেই বিশ্বকাপ জেতা হয়ে যেত না। এই নিয়ে আমার সামান্য একটু বক্তব্য আছে, একমত নাই হতে পারেন, সমস্যা নেই।
১.
জোহানেসবার্গের সেই ম্যাচের পিচ আর আহমেদাবাদের পিচ – আকাশ পাতাল তফাৎ। জোহানেসবার্গের পিচ প্রথম থেকে শেষ অবধি ছিল স্পোর্টিং উইকেট, একটু ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি। নইলে ফাইনালের মতো ম্যাচে ৩৫৯ রান ওঠে না। ইন্ডিয়া যখন ব্যাট করেছে তখন পিচের জন্যে কোনো উইকেট পড়েছে বা ব্যাটসম্যানদের স্ট্রোক খেলতে অসুবিধে হয়েছে বলে জানা যায়না।
ভারত হেরেছিল পাহাড়সম রানের চাপে পিষ্ট হয়ে, যে রান সেই সময়ে তাড়া করার কোনো রেকর্ড ছিলোনা। সৌরভ এবং টিম ম্যানেজমেন্ট ভেবেছিলেন যে গ্ৰুপ লিগে আগে ব্যাট করে ১২৫ অলআউট হয়ে গেছিলাম এবং পিচে শুরুতে যদি একটু ময়শ্চার থাকে, তাহলে সেটা কাজে লাগিয়ে কয়েকটা দ্রুত উইকেট তুলে নিতে পারলে অস্ট্রেলিয়াকে চেপে ধরা যাবে। কিন্তু এখানেও একটা ব্যাপার আছে, সেই ১২৫ অলআউট এর পিচ আর জোবার্গের পিচ আলাদা ছিল।
গ্ৰুপ লিগের ম্যাচে পিচ অনেকটাই বোলিং সহায়ক ছিল। এবং যেহেতু ভারতীয় ফাস্ট বোলাররা শুরুর ময়েশ্চারের সুবিধে নিতে ব্যর্থ হন, ভারতের আগে ফিল্ড করার প্ল্যান ব্যাকফায়ার করে। এখানে সৌরভকে একা দোষ দিচ্ছি না, টিম ম্যানেজমেন্টের অধিকাংশ লোকজন যেভাবে ভেবেছেন সেটাই করা হয়েছে। আর অস্ট্রেলিয়ার যে ব্যাটিং লাইন আপ ছিল, তারা আগে ব্যাট করে যদি উইকেট না হারায়, তাহলে যে বড়ো রান তুলবেই, সেটা জানাই ছিল আর সেটাই হয়েছিল।
আগে ব্যাট করে ভারত যদি শুরুর ১০ ওভার দেখেশুনে খেলে তারপরে অবস্থা বুঝে আক্রমণে যেত, জোবার্গের পিচে ৩০০+ রান না তোলার কারণ ছিল না, কেননা গোটা টুর্নামেন্টে ওই প্রথম ২ টো ম্যাচ বাদ দিলে ভারতের ব্যাটিং খুবই ভালো হয়েছিল। আর ৩০০+ যদি অস্ট্রেলিয়াকে চেস করতে হতো, তাহলে গল্প আলাদা হতেই পারতো কেননা রান তাড়া করতে গিয়ে বিগ ম্যাচে অনেক কিছুই হতে দেখেছি আমরা।
তারপরেও অবশ্যই, এটা বলা যায়না যে ম্যাচ ভারতই জিততো, কিন্তু একটা সম্ভাবনা অবশ্যই থাকতো সেই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া দলকে হারানোর। এবং আগে বল করেও যদি জাহির আর শ্রীনাথ জায়গায় বল রাখতেন, ২ টো উইকেট ৫০ রানের মধ্যে পড়ে যেত, তাহলে হয়তো অস্ট্রেলিয়াকে ৩০০র মধ্যে রাখা যেত।
কিন্তু, গোটা খেলা দেখে আমার কখনোই মনে হয়নি যে ভালো বল করলেও ওই পিচে ওই অস্ট্রেলিয়াকে ৩০০র কমে অলআউট করে দেওয়া সম্ভব ছিল। কেননা পন্টিং আর মার্টিন যতক্ষণ খেলেছেন মনে হয়েছে হাইওয়ের মতো ফ্ল্যাট ট্র্যাকে খেলা হচ্ছে।
২.
এবারে আসি দ্বিতীয় পয়েন্টে, জোবার্গের ম্যাচ ছিল দিনের ম্যাচ, দিন রাতের নয়, তাই সেখানে পরে শিশির পড়ে পিচ ব্যাটিংয়ের উপযোগী হয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, যেটা গত রবিবার অস্ট্রেলিয়া ইনিংসের ১৫ ওভারের পর থেকে হয়েছে, এবং সেই কারণেই বিকেলে যে পিচে ভারত জাস্ট ব্যাটে বল লাগাতে পারছিলো না, কোনো টাইমিং হচ্ছিলো না, সেই পিচে জাদেজা কুলদীপ একটাও উইকেট পেলেন না, টার্ন ও পেলেন না।
তাই দিন রাতের ম্যাচে টস জিতে ফিল্ডিং যেমন ডিউ ফ্যাক্টরের উপরে অনেকটা নির্ভর করে, বিশেষ করে যদি ড্ৰাই পিচ হয়, সেটা দিনের ম্যাচে ততটা ম্যাটার করে না। দিনের ম্যাচে উইকেট যদি স্পোর্টিং হয়, তাহলে দুই দলের ব্যাটিংয়ের সময়েই পিচ সমান আচরণ করে। তাই আহমেদাবাদের শুকনো স্লো উইকেটে দিন রাতের ম্যাচে টস জিতে ফিল্ডিং নিয়ে যে মাস্টারস্ট্রোক কামিন্স দিয়েছেন, সেটার সঙ্গে জোবার্গের সিদ্ধান্তের তুলনা করা ক্রিকেটীয় যুক্তিতে অনুচিত।
সৌরভের সিদ্ধান্তটা ছিল একটা চান্স ফ্যাক্টরের উপরে নির্ভর করে। যদি খেটে যায়, সফল হবেন, না খাটলে চূড়ান্ত ব্যর্থ। ভারতের দুর্ভাগ্য, দ্বিতীয়টি হয়েছিল বোলারদের ব্যর্থতায় ও অস্ট্রেলিয়া ব্যাটসম্যানদের কৃতিত্বে। কিন্তু কামিন্স যখন ফিল্ডিং নিলেন, তিনি জানেন যে ভারতের পুরো ইনিংসের প্রথম ১০ ওভারের পর থেকেই পিচ স্লো হতে থাকবে, ফলে স্পিনারদের ও পেসারদের স্লোয়ার, কাটার এগুলো খেলতে ভারতের গোটা ইনিংসই অসুবিধে হবে যদি প্ল্যানমাফিক বল করা যায়।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং শুরুর পরে প্রথম ১০-১৫ ওভার সামলে দিলেই শিশির পড়ে পিচ সহজ হয়ে আসবে। এই দুটি ফ্যাক্টর ১০০% শিওর ছিল বলেই কামিন্সের সিদ্ধান্ত কোনো চান্স ফ্যাক্টরের উপরে নির্ভর করে নেওয়া নয়। অস্ট্রেলিয়া টস জিতেছে, এবং পিচ ও পরিবেশকে সঠিকভাবে জাজ করেছে।
রোহিত শর্মা বলেছিলেন তিনি টস জিতলে ব্যাটিং নিতেন, সেক্ষেত্রে বলা যায় ভারতের পক্ষে টস জিতেও ম্যাচ জেতা প্রায় অসম্ভব ছিল এবার। যদি তিনি সেটা এমনি কনফিডেন্স রাখা বা বিপক্ষকে চাপে রাখার জন্যে বলে থাকেন তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। এই পিচে অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাট করলেও ২৫০ এর বেশি করতে পারতো না, আর ভারতের পক্ষে চেস করা অনেকটা সেই চেন্নাই ম্যাচের মতো হতে পারতো, শুরুতে ২-৩ উইকেট যেতে পারতো, কিন্তু পরে টিকে থাকলে চেস সহজ হতো।
সব মিলিয়ে, ফাইনালের পক্ষে আহমেদাবাদের পিচ একেবারেই অনুপযুক্ত ছিল, টস যেখানে বড়ো ফ্যাক্টর হয়ে যাবে, এমন কন্ডিশন কখনোই হোম টিমের জন্যে উপযুক্ত নয়। বরং ব্যাটিং উইকেট ( মুম্বাই এর মতো) দিলে হয়তো একটা হাই স্কোরিং ফাইনাল দেখা যেত আর সেখানে যে দলের খেলোয়াড় বেশি ভালো খেলতেন, তাঁরা জিততেন।
জোহানেসবার্গে কিন্তু ব্যাটিং উইকেটই দেওয়া হয়েছিল যেখানে ভালো ফাস্ট বোলার হয়তো প্রথম ৫-৭ ওভার একটু সুবিধে পাবেন। সেই সুবিধে ভারত নিতে না পারায় সেখানেই ললাটলিখন স্পষ্ট হয়ে যায়।