পেসাররা বরাবরই ইনজুরিপ্রবণ। এ কারণে সিংহভাগেরই ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয় না। ভারতীয় ক্রিকেটে পেসারদের প্রতাপ শুরু হয়েছে এই গত দশকেই। কিন্তু সেই প্রতাপের আড়ালে ইনজুরির ভয়াল ছোঁয়াও আছে। কেউই তেমন বছর জুড়ে ফিট থাকতে পারেন না। ভারতীয় পেসার মানেই যেন এখন ইনজুরিতে পড়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে গিয়েছে।
জাসপ্রতি বুমরাহ ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে রয়েছেন, তা প্রায় মাস আটেক হতে চললো। এ ছাড়া প্রসিধ কৃষ্ণা, কমলেশ নগরকোটি, দীপক চাহার, নভদ্বীপ সাইনি, উমেশ যাদবদের প্রায়শই ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে কাঁটাতে হয়।
ভারতীয় পেসারদের এমন ঘনঘন ইনজুরিতে পড়াতে এক প্রকার হতাশাই প্রকাশ করেছেন সাবেক কোচ রবি শাস্ত্রী। তাঁর মতে, শেষ তিন চার বছরে পেসাররা মাঠের চেয়ে এনসিএ-তেই বেশি সময় কাটিয়েছেন। ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি (এনসিএ) মূলত ইনজুরি আক্রান্ত ক্রিকেটারদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে।
মোহাম্মদ শামির শৈশবের কোচ মোহাম্মদ বদরুদ্দিন অবশ্য পেসারদের ইনজুরিতে পড়ার ক্ষেত্রে পুরো কন্ডিশনিং প্রক্রিয়াকেই দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, ভারতীয় পেসাররা ফিট থাকার জন্য যে ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, তা পেসারদের জন্য আসলে খুব বেশি উপযোগী নয়।
এ নিয়ে তিনি ভারতীয় এক গণমাধ্যমে বলেন, ‘তরুণ পেসারদের প্রতি আমার একটাই পরামর্শ, তোমরা তোমাদের বোলিং নিয়ে কাজ করো, শরীর নিয়ে নয়। আমি বুঝিনা, এখনকার পেসাররা কেন জিমে দুই ঘন্টা কাটায়। এটার সুফল কোথায়? এটা কি আদৌ ভাল পেসার তৈরিতে সহায়ক? একজন পেসারের মাঠেই বেশি সময় কাটানো উচিৎ। ভারোত্তলোন না করে তাঁর বোলিংয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।’
তিনি আরো যুক্ত করেন বলেন, ‘ এই মুহূর্তে উঠতি পেসারদের জিম থেকে দূরে রাখাই বেশ কঠিন। তাঁরা সেখানে যায়, এরপর ছবি, ভিডিও করে ইন্সটাতে পোস্ট দেয়। ওটাই যেন মূখ্য উদ্দেশ্য তাদের। আমি অবশ্যই জিমে যাওয়ার বিপক্ষে নই। তবে শরীর ঠিক করার আগে নিজের বোলিংটা নিয়ে বেশি কাজ করা উচিৎ।’
ভারতের সাবেক পেসার কার্সানের মতও ঠিক এমন। পেসারদের জিমে বেশি সেশন কাটানোকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘এখন পেসাররা সবাই জিমে যায়। আর সেখানে তাঁরা ভারী ভারী ওজন তোলার কাজ করে। আর এই ওয়েট লিফটিংয়ে অনেকেই ইনজুরিতে পড়ে যান। মূলত পেসারদের মূল কাজটা হওয়া উচিৎ নেট সেশনে।’
মোহাম্মদ বদরুদ্দিন এরপর মোহাম্মদ শামির উদারণ টেনে বলেন,’তাঁর একটা হাঁটুর অস্ত্রোপচার হয়েছিল। এরপর থেকে সে জিম সেশনে সময় কমিয়ে দেয়। এখন দেখুন, সে কেমন বল করে? আগের চেয়ে সে এখন দারুণ ধারাবাহিক। আর তাঁর ফিটনেসও আগের চেয়ে বেশ ভাল অবস্থানে আছে।’
মোহাম্মদ বদরুদ্দিন অবশ্য শামির দৈনন্দিন রুটিনও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সে মূলত ফিট থাকার জন্য দৌড়কে প্রাধান্য দেয়। কারণ পেসারদের পায়ের শক্তি বেশি থাকা উচিৎ। রান-আপের ক্ষেত্রে এটি বেশ কাজে দেয়। শামি জিমে কম গিয়ে এখন মাঠে বেশি সময় দেয়। তাই এখন আগের চেয়ে সে আরো বেশি বোলিং নিয়ে কাজ করতে পারে।’
লখনৌর পেসার মহসিন খানকে নিয়ে মোহাম্মদ বদরুদ্দিন বলেন, ‘লক্ষ্য করে দেখবেন, সে আগের বছরে ১৫০ কিলোমিটার পেসেও বল করতে পেরেছে। কিন্তু কাঁধের ইনজুরির পর তাঁর এ বছরে পেস কমে গিয়েছে। এখন ওকে দেখলেই স্পষ্টই বুঝা যায়, তাঁর ওজন বেড়েছে, একই সাথে সে প্রস্তুত নয়।
তাই এবারের আইপিএলে ভাল কিছু করেও দেখাতে পারেনি। সে মোহাম্মদ শামির সাথে ট্রেনিং করছে। আমি নিশ্চিত, সে এতদিনে শামির ১০ ভাগও পরিশ্রম করেনি। এখন জিমে কম সময় নিচ্ছে, মাঠে সময় বেশি দিচ্ছে। আশা করছি, ও দারুণ ভাবে ফিরতে পারবে।’
কমলেশ নগরকোটির কোচ সুরিন্দর সিং রাথোড় অবশ্য পেসারদের ইনজুরির কারণ হিসেবে ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচির কথাই বলেছেন। তাঁর মতে, এই মুহূর্তে ক্রিকেটারদের জন্য ফাঁকা সময়ই নেই। পেসাররা যদি বিশ্রামই না নিতে পারে তাহলে তাদের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনাটা কঠিন। সারা বছরে পেসারদের অতি ব্যস্ততা, ধকল আর শরীর নিতে পারে না।
তাই ভারতীয় পেসাররা ইনজুরিতেও পড়ছে সচরাচর। বিসিসিআইয়ের পেসারদের উপর ওয়ার্কলোড কমানোর জন্য কাজ করা উচিৎ। তাদের ভাগ করে দেওয়া উচিৎ, কোনো পেসাররা কোন ফরম্যাট খেলবেন, বা তাদের কোনো ফরম্যাটের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে। পেসারদের জন্য তিন ফরম্যাটেই খেলা কষ্টসাধ্য।’
ভারতীয় পেসারদের এমন ইনজুরিপ্রবণতা নিয়ে কিছুটা শঙ্কাই প্রকাশ করেছেন সাবেক পেসার জহির খান। তিনি বলেন, ‘আমি আসলে এ ব্যাপারটা নিয়ে শঙ্কিত। আমার মনে হয়, পেসারদের নিজেদের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে আরো যত্নবান হওয়া উচিৎ। আর সবচাইতে বড় কথা হলো, পেসাররা কেন এত ইনজুরিতে পড়ছে, সেই কারণটা আগে বের করা উচিৎ।’
ভারতের স্ট্রেন্থ ও কন্ডিশনিং কোচ রামজি শ্রীনিবাসনের মতে, ‘পেসার আর ব্যাটারদের মধ্যে জিম সেশনের ব্যাপারটা কিন্তু পুরোটাই আলাদা। জিম অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ পেসারদের জন্য। তবে নিজেকে বুঝতে হবে জিম সেশনের সবটাই তাঁর জন্য উপযোগী হচ্ছে কিনা। পেসাররা এটা না বুঝে অনেক সময় জিমেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেন। আর এতেই ঘটে ইনজুরি। দেখা গেল, আপনি ১০০ কেজি ওয়েট লিফট করতে পারেন, কিন্তু ১২০ কেজির ওয়েট তুলতে গেলেন, তখন কিন্তু ইনজুরিতে পড়ার সমূহ সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। যেটা আপনার বোলিংয়েও প্রভাবিত হবে।’
ইনজুরি এড়াতে পেসারদের করণীয় কি, তা জানাতে রামজি শ্রীনিবাসন আরো যোগ করে বলেন, ‘পেসারদের জন্য অ্যারাবিক এক্সারসাইজ বেশি দরকার। যেমন, ২ কিলোমিটার রানিং। কারণ ভাল পেসার হতে হলে শ্বাস প্রশ্বাস নিয়েও আলাদা কাজ করতে হয়। যখনই কেউ দৌড়ায়, সে কিন্তু শ্বাসও নেয়, আবার প্রশ্বাসও ছাড়ে। পেসারদের জন্য ৬০ ভাগ অ্যারাবিক এক্সারসাইজ প্রয়োজন, বাকি ৪০ ভাগের মধ্যে ৩০ ভাগ স্ট্রেন্থ ট্রেনিং আর ১০ ভাগ প্রয়োজন বিশ্রাম।’