জোয়েল ‘আন্ডাররেটেড’ গার্নার

যারা ৭০ এবং ৮০ দশকের ক্রিকেট নিয়মিত দেখতেন তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস কোয়াড্রের্ট পেস চতুষ্ঠয়কে চিনে থাকবেন। এই পেস কোয়াড্রের্টের অংশ ছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস,ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার এবং মাইকেল হোল্ডিং। এদের মধ্যে সবচেয়ে কম আলোচনা হত জোয়েল গার্নার এবং মাইকেল হোল্ডিংকে নিয়ে। পুরোটা আলোই আসলে কেড়ে নিয়েছেন অ্যান্ডি রবার্টস আর জোয়েল গার্নার।

কিন্তু, পরিসংখ্যান দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যাবে জোয়েল গার্নার কিংবা মাইকেল হোল্ডিং কোনো অংশেই কম ছিলেন না কারো থেকে। উপরন্তু সবাই ছিলেন সমানে সমান। আজকের গল্পটা গার্নারের।

বেশ ভালো বোলিং রেকর্ড থাকা সত্বেও সবচেয়ে কম আলোচনায় ছিলেন জোয়েল গার্নার। বলা উচিৎ তিনি ছিলেন চারজনের মধ্যে সবচেয়ে আন্ডাররেটেড। অথচ তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা বোলিং তারকা।

১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের ঘরের মাঠ জর্জ টাউনে অভিষেক জোয়েল গার্নারের। অভিষেক টেস্টে দুই ইনিংসে নিয়েছিলেন যথাক্রমে ৪ এবং ২ উইকেট। এর জন্য খরচ করেছিলেন ১৩০ এবং ৬০ রান। পাকিস্তানের শক্তি বিবেচনায় একজন অভিষিক্ত বোলার জন্য অবশ্যই সেরা বোলিং ফিগার এটা। এছাড়া অভিষেক সিরিজে নিয়েছিলেন ২৫ উইকেট।

জোয়েল গার্নার এবং কলিন ক্রফটের অভিষেক একই সিরিজে। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অভিষেক হয় কলিন ক্রফটের। কলিন ক্রফট কুইন্স পার্ক ওভালের ফ্লাট উইকেটে তুলে নেন ৮ উইকেট। আর এই ৮ উইকেটের জন্য খরচ করেন ২৯। এই দূর্দান্ত পারফর্মেন্সের কারণে সম্পুর্ন আলো নিজের দিকে টেনে নেন কলিন ক্রফট।

এছাড়াও ওই সিরিজে জোয়েল গার্নারের পাশাপাশি দূর্দান্ত বোলিং করেন কলিন ক্রফট। লর্ডসে ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ড ১১ রানে শেষ ৮ উইকেট হারায়। ফাইনালে দূর্দান্ত বোলিং করেন জোয়েল গার্নার। ৩৮ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ৫ উইকেট। কিন্তু ফাইনালের পর গাইনাল জেতার কৃতিত্ব পেতে শুরু করেন কলিন ক্রফট এবং এবং স্যার ভিভ রিচার্ডস।

জোয়েল গার্নারের বোলিং রেকর্ড বেশ ঈর্ষনীয়। কিন্তু ক্যারিয়ারের শীর্ষে থাকাকালীন সময়ে বেশিরভাগ সময়ে নতুন বলে বোলিং করার সুযোগ পাননি তিনি। কারণ তখন নতুন বলে বোলিং করার জন্য ছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস এবং মাইকেল হোল্ডিং।

গার্নার নিয়মিত নতুন বলে বোলিং করার সুযোগ পেতে শুরু কত্রেন ১৯৮৪ সাল থেকে। যখন তাঁর বয়স ৩১ বছর। নতুন বলে তাঁর সঙ্গী ছিলেন ম্যালকম মার্শাল। ম্যালকম মার্শাল আলো কেড়ে নেন তাঁর থেকে। ১৯৮৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হোয়াটওয়াশ করে ইংল্যান্ডকে। এই সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে হারের মুখ দেখান গার্নার। কিন্তু এই সিরিজের হিরো হিসেবে প্রাধান্য পান ম্যালকম মার্শাল এবং গর্ডন গ্রিনিজ।

১৯৮৬-৮৭ সালে যখন জোয়েল গার্নার অবসরে যান তখন সেটা নিয়ে খুব বেশি আফসোস কিংবা আপত্তি কারোরি ছিলো না। কারণ তখন এসেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের আরেক কিংবদন্তি পেসার কার্টলি অ্যামব্রোস। তিনি জোয়েল গার্নারের স্থলাভিষিক্ত হতে সময় নেন মাত্র এক বছর। এর ফলে জোয়েল গার্নারের অভাবটা বুঝতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল।

জোয়েল গার্নার এমন একজন বোলারা  ছিলেন যিনি কিনা ভালো বোলিং করা সত্ত্বেও লোকজনের লক্ষ্যের বাইরে ছিলেন। অর্থাৎ নীরবে করে গেছেন তাঁর কাজ। খেলোয়াড়ি জীবনে শারীরিক গড়নের জন্য পরিচিত ছিলেন ‘বিগ বার্ড’ নামে। ক্যারিয়ার শেষেও পাখির মত হারিয়ে যান।

৭০-৮০ এর দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ক্রিকেটার এবং সমর্থকরা একটা সিরিজিকে বিশেষভাবে মনে রাখবে। সেটা হলো ১৯৭৯-৮০ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়। কারণ ওই সময়ে প্রায় প্রত্যেকটা সিরিজে জয়ের দেখা পাচ্ছিলো অস্ট্রেলিয়া। স্বাভাবিকভাবেই এই সিরিজের সেরা বোলার ছিলেন জোয়েল গার্নার। এই সিরিহজে ১৪ উইকেট তুলে নেন তিনি।

গ্যাবায় প্রথম টেস্ট ড্রয়ের পর মেলবোর্ন সিরিজ শুরু টস জিতে ব্যাটীং এর সিদ্ধান্ত নেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল। ব্যাটিং এ ভালো শুরু করেছিলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেনাররা। কিন্তু পরবর্তীতে জোয়েল গার্নারের বোলিং তোপে খেই হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপ। গার্নার তুলে নেন ৩ উইকেট। পরে সেই সুযোগে বাকি উইকেট গুলো তুলে নেই মাইকেল হোল্ডিং এবং কলিন ক্রফট। সাথে ক্যারিবিয়রা ম্যাচ জিতে নেয় ১০ উইকেটে।

অ্যাডিলেড ওভালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচ খেলতে নেমেছিলো। এই ম্যাচটি জোয়েল গার্নারের জন্য ছিলো বিশেষ একটি ম্যাচ। এর ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭৬ সালের কোনো এক ঘটনায়।

১৯৭৪ সালে জর্জ টাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ চলচ্ছিলো। তখন ইয়ান চ্যাপেলের অটোগ্রাফ নিতে আসেন জোয়েল গার্নার। তখনই ইয়ান চ্যাপেল গার্নারকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কি ক্রিকেট খেলো?’ গার্নার উত্তর দেন, ‘খেলি। আর টেস্টে আপনার বিপক্ষে বল করবো।’

জোয়েল গার্নারের জন্য ইয়ান চ্যাপেলের মুখোমুখি হওয়াটা ছিলো দারুণ একটা ব্যাপার। কিন্তু এক ইনিংসেও তাঁকে বল করার সুযোগ পাননি তিনি। প্রত্যেকবারই নতুন বলে তাঁকে ফিরিয়েছেন অ্যান্ডি রবার্টস এবং মাইকেল হোল্ডিং।

১৯৮৪ সাল থেকে নতুন বলে বল করার সুযোগ পান জোয়েল গার্নার। এটা শুধুমাত্র তাঁর জন্য স্মরণীয় নয়। পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের জন্য স্মরনীয় হয়ে ছিলো। কারণ ১৯৮৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল টানা ১১ টি টেস্টে জয় ললাভ করেছিলো। আর ইনজুরির কারণে এই জয়গুলো মাঠের বাইরে থেকে দেখতে হয় ম্যালকম মার্শাল এবং মাইকেল হোল্ডিংকে। আর তাদের অনুপস্থিতিতে নতুন বলে বল করেন জোয়েল গার্নার।

এই সিরিজে নতুন বলে বল করার সুযোগ পেয়ে দূর্দান্ত বল করেন জোয়েল গার্নার। পরিনত হন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের যমদূত হিসেবে। একই বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংলিশদেরকে হোয়াটওয়াশ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

এই সিরিজেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমণের অন্যতম সেরা পেসার ছিলেন তিনি। একই বছর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ জয়েও ভূমিকা ছিলো জোয়েল গার্নারের। যদিও খুব বেশি উইকেট পাননি তবুও ব্যাটসম্যানদেরকে চাপে রাখার কাজটি তিনিই করেছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই সিরিজে সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচ ছিলো গ্যাবায় দ্বিতীয় টেস্টে। এই টেস্টে ৬৭ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ৪ উইকেট। আর তাঁর এই ববোলিং তান্ডবে মাত্র ১৭৫ রানে গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।

জোয়েল গার্নার ছিলেন ব্যাটসম্যানদের জন্য নীরব ঘাতক। তিনি বোলিংয়ে এসে দূর্দান্ত বোলিং করতেন। ইংল্যান্ডকে দ্বিতীয়বারের মত হোয়াটওয়াশ করার সিরিজে ২৬ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো ইনিংসেই ৫ উইকেটে পাননি।

জোয়েল গার্নার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান ১৯৮৬-৮৭ সালে। যখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ৩৫ বছর। গার্নার যখন অবসর নেন তখন পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ জুড়ে ছিলো প্রচুর প্রতিভাবনা ফাস্ট বোলার। ক্যারিয়ারে শেষ টেস্টেও দূর্দান্ত বোলিং করেন তিনি।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে হারের মুখ দেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুধু মাত্র জোয়েল গার্নার নন, আরো অনেক ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তী ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে হারের মুখ দেখে।একই মৌসুম শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান মাইকেল হোল্ডিং এবং গোমেজ।

বোলিং এর পাশাপাশি ব্যাটিং টাও বেশ ভালো করতে পারতেন। তিনি ব্যাটিংয়ে নেমে মারকাটারি ব্যাটিংয়ে দর্শকদের বেশ বিনোদন দিতেন।

জোয়েল গার্নার ৫৮ টেস্ট খেলে নিয়েছিলেন ২৫৮ উইকেট। বোলিং গড় ছিলো মাত্র ২০.৯৭ এবং ইকোনমি রেট ছিলো মাত্র ২.৪৭।আর ব্যাটিংয়ে ৬৮ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে করেছেন ৬৭০ রান। যার মধ্যে ছিলো একটি অর্ধশতক।

৯৮ টি একদিনের ম্যাচ খেলে নিয়েছিলেন ১৪৬ উইকেট। আর ব্যাট হাতে করেছিলেন ২৩৯ রান। একদিনের ক্রিকেটের অন্যতম কার্য্যকর পেসার – এটুকু বললে তাঁর ব্যাপারে বাড়তি বলা হয় না। অথচ, তাঁকে ঘিরে আজকাল কোনো আলোচনাই নেই।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link