চ্যাম্পিয়নস লিগ মানেই চমক, তেমনই এক চমক দেখিয়েছে পোর্তো।
ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্তাসকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে এখন পোর্তো। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে যেখানে ধরা হয় চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা, চ্যাম্পিয়নস লিগ অ্যান্থেম শুনলে যেখানে রক্ত গরম হয়ে যায়; সেই রোনালদোকে থামিয়ে দিয়েছে পোর্তো। এক পেপেই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন সামনে। দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৪ গোলে ড্র করে তারা পার হয়েছে রাউন্ড অফ সিক্সটিনের বৈতরণি।
২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দৌড় তাদের। এ জয়ে অন্তত কিছুটা প্রশংসা তো অন্তত প্রাপ্য কোচ সার্জিও কন্সিওয়াওয়ের। গত চার মৌসুম ধরে পোর্তোড় খেলাই বদলে দিয়েছেন তিনি। অথচ ম্যাচ শেষে প্রেস কনফারেন্সে এসে দেখলেন সে জায়গা ধূ ধূ মরু। এমনিতেই কোভিড সিচুয়েশনের জন্য কেউ সশরীরে উপস্থিত থাকেনা ঠিকই, কিন্তু জুম কলে চাইলেই প্রশ্ন করা যায় কোচদের। কিন্তু কন্সিয়াওয়ের জুম কলে ছিলেন না কোনো সাংতবাদিকই। এমনকি পর্তুগিজ সাংবাদিকেরাও অনুপস্থিত। মাত্র ৫০ সেকেন্ডের প্রেস কনফারেন্স কন্সিয়াও শেষ করেছেন কোনো প্রশ্ন না নিয়েই।
এমনটা নতুন নয়, পোর্তোর আগের কোচ জোসে মোরিনহোও এর আগে একবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ থাকাকালীন সময়ে প্রেস কনফারেন্স শেষ করেছে ২৪ সেকেন্ডে, তখন অবশয় সাংবাদিকেরা ছিল, কিন্তু সংখ্যা ছিল মাত্র তিনজন।
এমন উদ্ভট উদ্ভট প্রেস কনফারেন্স নতুন কিছু নয়। ফুটবল জগতে কোচ, খেলোয়াড়দের সাথে সাংবাদিকদের এরকম অদ্ভুত কিছু প্রেস কনফারেন্স নিয়েই আজকের লেখা।
- এরিক ক্যান্টোনা ও তার ‘ডিপ-সি’ মেটাফোর
এরিক ক্যান্টোনা জীবনী লেখা হলে তার পরতে পরতে থাকবে টুইস্ট। খেলোয়াড়ি জীবন থেকে কোচিং জীবন, কী না করেছেন তিনি?
পুরো জীবনজুড়ে যেমনটা চেয়েছেন তেমনটা চলেছেন। এমনকি কড়া মাস্টারমশাই স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন পর্যন্ত তাকে সামলাতে পারেননি, চলতে দিয়েছেন স্বাধীনমতো। কারণ তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা মানে খেলোয়াড়ি জীবনটাকেই সাইডলাইন করে দেওয়া। স্যার অ্যালেক্স আর যাই হোক, তা নিশ্চয় চাইবেন না।
১৯৯৪-৯৫ মৌসুম, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তখন তাদের হ্যাট-ট্রিক লিগ টাইটেলের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। ২৫ জানুয়ারি ক্রিস্টাল প্যালেসের সাথে এক অ্যাওয়ে ম্যাচে ডিফেন্ডারকে ফাউল করে লাল কার্ড দেখেন ক্যান্টোনা। সবকিছু ঠিকই চলছিল, রেফারির সাথে তর্কাতর্কি করে মাঠ থেকে ডাগ-আউটে ফেরার সময় হুট করেই তেড়ে যান ক্যান্টোনা। কথা নেই, বার্তা নেই; উড়ে গিয়ে ‘কুং ফু কিক’ বসিয়ে দেন সেই সমর্থকের মুখে।
ক্যান্টোনার এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে যায় মাঠে থাকা সকলে। তাকে জোর-জবরদস্তি করে মাঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে যান দলের স্টাফরা। পরদিনই তাকে ৪ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করে এফএ। তবে ক্রিস্টাল প্যালেস ছাড়েনি। তার বিরুদ্ধে করা মামলা গড়ায় কোর্ট পর্যন্ত। দুই সপ্তাহের জন্য হাজতবাসের আদেশ দেয় কোর্ট। যদিও মুচলেকা দিয়ে ১২০ ঘন্টা কমিউনিটি সার্ভিসের কাজে নিয়োজিত থাকার শর্তে ছাড়া পান ক্যান্টোনা। কিন্তু ততদিনে যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। তবে নাম ক্যান্টোনা বলে কথা, ঘটনা রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মতন, ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’।
জেল থেকে বেরোনের দুই দিন পরে এক প্রেস কনফারেন্স ডাকেন এরিক ক্যান্টোনা। প্রেস কনফারেন্সে আসলেন, বসলেন। কেউ কোনো প্রশ্ন করার আগেই মুখ খুললেন,
“When the seagulls follow the trawler, it’s because they think sardines will be thrown into the sea. Thank you very much.”
[সিগালরা নৌকার পেছন পেছন চলে; কারণ তারা ভাবে যে, সাগরে সার্ডিন মাছ লাফিয়ে উঠতে পারে। ধন্যবাদ]
এরপর উঠে চলে গেলেন। ঘটনার ২৫ বছর পার হয়ে গিয়েছে, এখনও পৃথিবীর কোনো মানুষ রহস্য উদ্ধার করতে পারেননি তার কথার। পৃথিবী এখনও জানার বাকি, কেন ও কী জন্য সেদিন এই বাণী দিয়েছিলেন তিনি। এবং তার মর্ম কী ছিল?
- ‘ইয়েস’ ‘নো’ ‘আই ডোন্ট নো’
একজন মানুষকে ইগনোর করতে চাইলে কী করবেন? স্বভাবতই বলবেন পরে আসতে কিংবা তার কথার ছোট্ট ছোট্ট জবাব দিতে। কিন্তু প্রেস কনফারেন্সে?
এখানে আসা মানেই বিশাল এক হ্যাপা। সাংবাদিকদের যতসব প্রশ্ন, উদ্ভট সব জানার ইচ্ছে। কিছু কিছু শুনলে তো মনে হয় বসে বসে মাথার চুল ছিড়ি। কিন্তু কী আর করা? তাদের জানার ইচ্ছে আর প্রশ্নের উত্তর সব আপনার কাছেই। উত্তর তো দিতেই হবে। কী করা যায় তবে?
চেলসির সাবেক কোচ অ্যাভ্রাম গ্র্যান্ট বেশ ভালো একটা বুদ্ধি বের করেছিলেন, যা সব প্রশ্ন আসবে, সব পাঁচ শব্দের মধ্যে শেষ করে দিবেন। ইজরাইলি এই ম্যানেজারের চেলসি আসার ঘটনাও বেশ অদ্ভুত। তিনি মূলতে এসেছিলেন দলের ডিরেক্টর অফ ফুটবল হিসেবে। চেলসির মালিক রোমান আব্রামোভিচের বন্ধু হিসেবে। কিন্তু মাঝপথে জোসে মোরিনহোকে বরখাস্ত করার পর তড়িঘড়ি করে দায়িত্ব পরে তার উপরেই। যদিও কোচ হিসেবে তার কোনো সার্টিফিকেট ছিল না, দর্শকদের সমর্থনও ছিল না। কিন্তু মাঠে নেমে ঠিকই রেজাল্ট আনতে পটু ছিলেন তিনি। সেদিনও অবশ্য গ্র্যান্টের অবশ্য মুড খারাপ থাকার কোনো অবস্থা ছিল না। কিন্তু কিছু একটা হয়েছিল, যে কারণে পুরো ইন্টারভিউর ২১ টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন মাত্র ১৩৭ শব্দে। যার বেশিরভাগই ছিল ‘ইয়েস’ ‘নো’ আর ‘আই ডোন্ট নো’।
বেশ ইম্প্রেসিভই বলা যায় তাই না?
- গোড়ায় গলদ
ছোটবেলায় এমন প্রবাদ বাক্য কত পড়েছে লোকে। কনো কাজের শুরুটা খারাপ হলে তার শেষড়া নিয়ে আর যাই হোক, আশাবাদী হওয়া তেমন সম্ভব হয় না। কিংবা ‘দিনের প্রথম সূর্যটা দেখেই পুরো দিনের কথা বলে দেওয়া সম্ভব’। কিন্তু কোচেদের ক্ষেত্রে এমন হওয়ার সম্ভাবনা কতটূকু ভাবছেন? ভাবনা বদলে যাবে ইভায়ো পেতেভের গল্প শুনলে।
খেলোয়াড় হিসেবে খুব একটা বড় মানের খেলোয়াড় ছিলেন না ইভায়ো পেতেভ। কিন্তু কোচ হিসেবে খুব কম বয়সে ভালো নাম কামিয়েছিলেন এই বুলগেরিয়ান। মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই নামের পাশে ছিল কোচ হিসেবে দুই লিগ টাইটেল। লুডোগোরেটসকে পরপর দুইবার লিগ জিতিয়ে কোচ হিসেবে নিয়োগ পান লেভস্কি সোফিয়া দলের।
কোচ হিসেবে প্রেসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে আসে দলের কর্মকর্তারা। কিন্তু প্রেস কনফারেন্স শেষ হওয়ার আগেই এগিয়ে আসে কয়েকজন সমর্থক। এগিয়ে এসে তাকে বলে ক্লাবের লোগো সম্বলিত জামা খুলে ফেলতে। সকলের সামনে ক্লাবের জামা খুলে তাকে প্রেস কনফারেন্স থেকে বের করে দেয় উগ্র সমর্থকেরা। ফলে ১ দিনের মাথাতেই কোচ হিসেবে রিজাইন করেন পেতেভ।
মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। এর মূল কারণ ছিল খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি একবার বলেছিলেন, তিনি সিএসকেএ সোফিয়া দলকে পছন্দ করেন। নিজেদের রাইভাল দলকে পছন্দ করে এমন কোচকে রাখতে রাজি ছিল না সমর্থকেরা। যে কারণে প্রেস কনফারেন্স থেকেই বার অপমানিত করে বের করে দেয় তারা।
- গালির ফোয়ারা
মেজাজ হারানো দোষের কিছু না। একজন কোচ দলের খারাপ পারফরম্যান্সের পর মেজাজ হারাতেই পারেন। তার উপর আবার যুক্ত হয়েছে সাংবাদিকদের অহেতুক প্রশ্ন, ব্যস আর যায় কোথায়? আইরিশ কোচ জো কিনারের মনোভাব এমনই ছিল অনেকটা। ৮০’র দশোকে ভারত, নেপালের মতন দলে কোচিং করিয়ে যাওয়া এই আইরিশ কোচের সর্বোচ্চ সাফল্য এসেছিল উইমবল্ডনের হয়ে। ৯০’র দশকে সুন্দর ফুটবল উপহার দেওয়ার তালিকায় ছিলেন উপরের দিকেই।
প্রায় ৫ মৌসুম পরে জো কিনার ফিরেছিলেন কোচিং করাতে। নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের ইন্টার্ম কোচ হিসেবে নিয়োগ পান জো। মূলত দুই মাসের জন্য তাকে নেওয়া হয়েছিল কোচ হিসেবে। কিন্তু নিয়োগ পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা গেল, এখন আর টপ লেভেলের কোচিং করানোর অবস্থাতে নেই তিনি।
প্রেস কনফারেন্সে এসেই গালি দিয়ে বসেন এক সাংবাদিককে। এরপর শুরু হয় গালির ফোয়ারা। ৫ মিনিটে গুনে গুনে ৫৩টি গালি দেন এক বসাতেই। এরপর আবার সাংবাদিককদের বলেও দেন, ‘তোমরা চাইলে যা ইচ্ছা লিখতে পারো আমাকে নিয়ে। আমার কোনো রিগ্রেট নেই এই প্রেস কনফারেন্স নিয়ে।’
এরপর থেকে আর যতদিন ছিলেন নিউক্যাসেলে, তার সহকারী আসতেন প্রেস কনফারেন্সে। যদিও কয়েকদিনের মাথায় ম্যাচ শুরুর কয়েক ঘন্টা আগে হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি। এরপর থেকে আর কখনও কোচ হিসেবে মাঠে দেখা যায়নি তাকে।