সর্বোত্তম শিল্পী অথবা বাসেলের বিস্ময়

২০১৭ সালের জানুয়ারির শেষ রবিবার। মেলবোর্ণের রড লেভার এরিনার প্রতিটি আলো চুঁইয়ে পড়ছে গ্রেটনেসের ঘাম। রাফায়েল নাদাল, বিশ্বের সর্বকালের সেরা পুরুষ ক্লে কোর্ট টেনিস খেলোয়াড় পঞ্চম সেটে এগিয়ে আছেন ৩-১এ। সার্ভিস করছেন রজার ফেডেরার। যে রজার ফেডেরার ২০১২র পর আর কোনও গ্র্যান্ডস্ল্যাম জেতেননি। যে রজার ফেডেরার দুটো উইম্বলডন ছাড়া নাদালের বিরুদ্ধে গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল জেতেননি। যে রজার ফেডেরার গত ছ’মাসে কোমরের চোটের কারণে টেনিস খেলেননি এবং নামমাত্র প্রস্তুতি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলতে নেমেছেন।

ইতোমধ্যেই একটা ব্রেক করে ফেলেছেন রাফা। পঞ্চম গেমে ১৫-১৫। এই সময় হঠাৎ সবাইকে অবাক করে রজার খেলাটাকে আরেক ধাপ তুলে নিয়ে গেলেন, ডিপ প্রথম সার্ভিস, নাদালের ব্যাকহ্যান্ডে আর ফোরহ্যান্ড উইনার। নাদালের আনফোর্সড এররে ৩-২। নাদালের সার্ভিস, চোট থেকে ফিরছেন নাদালও পিঠের প্রায় খেলা শেষ করে দেওয়া চোট, কব্জির চোট। পুরনো দিনের মতোই রজারের ব্যাকহ্যান্ডে আক্রমণ করছেন তিনি।

রজারের সাবেকী এক হাতের ব্যাকহ্যান্ড, দৃষ্টিনন্দন হলেও নাদালের হাই টপস্পিনে কাঁধের উপর উঠলে পালটা টপস্পিনে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ শক্ত হয়ে পড়ে। রজারের স্লাইসে হিল্লোল তুলে মাথার উপর অসি ঘোরাবার মতো আরও বেশি টপস্পিন, এই করে ফেডেরারের বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ে ২৩-১০এ এগিয়ে গিয়েছেন রাফা। কিন্তু এ রজার তো অন্য রজার। ক্রোয়েশিয়ার ইভান লুবিচিচের সহায়তায় তিনি, ব্যাকহ্যান্ডকে ক্ষুরধার করেছেন আরও।

এখন বেসলাইনের কাছে দাঁড়িয়ে নাদালের টপস্পিনকে ফণা তুলতে দেবার আগেই বুকের উচ্চতা থেকে নিয়ন্ত্রিত ব্যাকহ্যান্ড মারছেন তিনি। তিনবার ডিউস করার পর ফেডেরারের অ্যাডভান্টেজ ঠিক এমনই একটা ক্রসকোর্ট ব্যাকহ্যান্ডে। বেসলাইনের সীমান্তদেশের কাছাকাছি ল্যান্ড করেই ছিটকে বেরিয়ে গেল। আর শেষ পয়েন্ট গেমের? নাদাল বিপদ বুঝে ফেডেরারকে দূরে ঠেলার উদ্দেশ্যে ফোরহ্যান্ড টপস্পিনটাকে পাঠালেন ফেডেরারের মতোই বেসলাইনের কাছাকাছি। কিন্তু বিধি বাম, বল বাইরে চলে গেল, ৩-৩।

হেলায় সার্ভিস গেম জিতলেন, তারপর আবার সেই দুরূহ কোণ খুঁজে ক্রসকোর্ট, পাঁচ বছরের খরা কাটাবার জন্য যেন এক প্রায় ৩৬ বছর বয়স্ক সার্কিটের প্রায়বৃদ্ধ আহত চিতা নখ দাঁতে শান দিচ্ছেন। পাঁচ বার ডিউস করেও গেম বাঁচাতে পারলেন না নাদাল। চোট থেকে ফেরার পরে তাঁরও শক্তি কমেছে, কিন্তু অল কোর্ট গেম আরও মজবুত হয়েছে। আর সেই দিয়েই আলেকজান্ডার জেরেভ, মিলাস রৌনিক আর সার্কিটে জুনিয়র ফেডেরার নামে পরিচিত গ্রেগর দিমিত্রভকে হারিয়ে উঠে এসেছেন নাদাল।

কিন্তু এই ফেডেরারের উপর যেন এক অতিশক্তি ভর করেছে। প্রতিটি টপস্পিন কোর্টের কোণ খুঁজে নিচ্ছে, উড়িয়ে দিচ্ছে লাইনের চক। শেষবারের মতো ৩-৫এ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ডিউস করলেন নাদাল। কিন্তু অ্যাডভান্টেজ কোর্টে নাদালের ব্যাকহ্যান্ডে এস মেরে ডিউস কোর্টে আবার ব্যাকহ্যান্ডে সার্ভ করে সার্ভিস উইনার। চক উড়িয়ে দেওয়া ক্রসকোর্টে ৩৬ বছর বয়সে রেকর্ড করে জিতে নিলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। আর সেই সঙ্গে নাদাল মিথকেও উড়িয়ে দিলেন তিনি।

গ্র্যান্ডস্ল্যাম ফাইনালে বা সেমি ফাইনালে নাদাল প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে ফেডেরারের সামনে। কিন্তু ২০১৭র পর ৭বারের সাক্ষাতে ৬ বার জিতলেন তিনি। নাদালের হাই টপস্পিনের প্রত্যুত্তর হিসাবে ডিপ স্লাইস এবং বেসলাইনের কাছ থেকে ব্যাক কোর্টে আক্রমণত্মক টপস্পিন, বেসলাইন থেকে নাদালকে দূরে ঠেলে দেওয়া আর তারপর খোলা কোর্টের অ্যাঙ্গেলের সহায়তায় পয়েন্ট খুঁটে নেওয়া।

অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এর আগেও বহু অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। নয়ের দশকের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে বিশ্বের ১ নম্বর র‌্যাংকিং পাবার পরে বরিস বেকারকে দেখা গেছে, আবেগ কমাতে ট্রফি সেরিমনির আগে স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইয়ারা নদীর পাশ দিয়ে একা একা জগিং করতে। ওই দশকেই জিম ক্যুরিয়র একই লক্ষ্যে পৌঁছবার পর তো ইয়ারা নদীতেই ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটেছেন। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কোর্টকে আলিঙ্গন ছাড়া ফেডেরারের থেকে আলাদা করে সেরকম স্ন্যাপশট মুহূর্ত পাওয়া না গেলেও, ফেডেরার রূপকথার দ্বিতীয় পর্যায়কে দেখা সম্ভব হল। আর গ্র্যান্ড স্ল্যামের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নাদালের মোকাবিলা করার রাস্তাও দেখা গেল।

কিন্তু জোকোভিচ মিথকে পারেননি তিনি। ২০০৯এর পর থেকে গ্র্যান্ডস্ল্যামের ফাইনালেও হারাতে পারেননি তিনি, ২০১২র পর গ্র‍্যাণ্ড স্ল্যামেও। আসলে মানসিক দিক দিয়ে জোকার অতিমানব হয়ে ওঠেন, তার সঙ্গে সর্বকালের সেরা সার্ভিস রিটার্ন। একটা সুযোগ এসেছিল ২০১৯-এ উইম্বল্ডন ফাইনালে, ২১ নম্বর গ্র্যান্ডস্ল্যাম জেতার। যেমন এসেছিল ২০১১র ইউ এস ওপেন সেমিফাইনালে, ২-০ এগিয়ে থাকা অবস্থায় ২-২ হবার পরেও শেষ সেটে ম্যাচ পয়েন্ট পেয়েও ভলি নেটে মারেন রজার। আবার ২০১৪র উইম্বল্ডন ফাইনালে খুব কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর হারেন রজার। আসলে ইউ এস ওপেনটাই সে যে সেই যে ২০০৮ অবধি পরপর ৫ বার জেতার পর ২০০৯এ দেল পোত্রোর কাছে ২-১এ এগিয়ে থেকেও হারলেন তারপর থেকেই অধরা থেকে গিয়েছে।

তবে রজারের রূপকথার শুরুওয়াত তো ইউএস ওপেন নয়, ২০০১-এর উইম্বল্ডন। চতুর্থ রাউন্ডের ম্যাচে ১৯ বছরের রজার মুখোমুখি হয়েছেন তদানীন্তন টেনিসের একছত্র সম্রাট পিট সাম্প্রাসের, গত আট বছরে সাতটা উইম্বল্ডন জিতে রেকর্ড করা সাম্প্রাস এগিয়ে চলেছেন ৮ম খেতাবের দিকে। কিন্তু টেনিস খেলাটা পাল্টাচ্ছে, বেসলাইনের পিছনের জায়গা বাড়ছে, ঘাসের কোর্টের গতি ধীরে ধীরে কমছে, বল বাউন্স করছে বেশি।

পিটের সার্ভ ও ভলি নির্ভর খেলার কাউন্টার করতে ছোট্ট খোঁপা বাঁধা সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলের এক সদা হাস্যমুখ তরুণ তৈরি তার অলকোর্ট গেম নিয়ে। যিনি সার্ভ ও ভলিতেও দড় আবার বেসলাইন নির্ভর টেনিস খেলতেও জুড়ি নেই। মূলত নেটের মাথার চুল ছোঁয়ানো ব্যাকহ্যান্ড স্লাইস এবং দ্রুতগতির ফোরহ্যান্ড পাসিং এবং তার সঙ্গে রেশমি ভলিতে পাঁচ সেটে মাত করলেন পিটকে রজার। গ্রেটনেসের সন্ধান সেইদিনই সেন্টারকোর্টে রাখা ছিল।

যদিও আসল ট্রফি আসতে আরও ২ বছর লাগল। পিটকে হারাবার পরের ম্যাচেই টিম হেনম্যানের কাছে হার, আর তার পরের বছর প্রথম রাউন্ডেই বিদায়। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলিতে সঠিক শট সিলেকশন এবং বড় ম্যাচে মাথা ঠাণ্ডা রাখা সিস্টেমের মধ্যে প্রোথিত করতে করতে ২০০৩ এসে গেল। আর তারপর? ২০০৪-২০০৭ সময়কাল ওপেন এরায় কোনও একজন টেনিস খেলোয়াড়ের পারফর্ম করার সময়কালের নিরিখে শ্রেষ্ঠ সময়কাল।

২০০৪, ২০০৬ এবং ২০০৭এ তিনি চারটির মধ্যে তিনটি গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয় করেন। এবং গ্র্যাঁপ্রি টুর্নামেন্ট নিয়ে মোট ৪২টি ট্রফি চারবছরে। একবিংশ শতাব্দীতে তুলনায় আসতে পারে শুধুমাত্র নাদালের ২০০৫ এবং জোকোভিচের ২০১১ ও ২০১৫ বছরগুলি।

কিন্তু রজার ফেদেরারের গ্রেটনেস তো শুধুমাত্র শুকনো স্ট্যাটস দিয়ে ধরা সম্ভব নয়। রজার ফেডেরারকে ছোঁয়ার জন্য আবার আশ্রয় নিই ওয়ার্ডসওয়র্থের –

My heart leaps up when I behold

A rainbow in the sky:

So was it when my life began;

So is it now I am a man;

So be it when I shall grow old,

Or let me die!

তাঁর ফোরহ্যান্ডকে ধরতে আশ্রয় নিই জীবনানন্দ দাসের –

এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতে জেগে উঠে

সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য

ব্যাকহ্যান্ড স্লাইস যেন সুতীক্ষ্ণ ছুরিকা, পালকের ভেলায় ভেসে এসে শত্রুর অন্দরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাককোর্টের গভীরে। সিল্কেন ভলি রেশম কীটের সৌন্দর্য নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে যত্র তত্র সর্বত্র, ড্রপশটে কিটসের ছোঁয়া –

My heart aches, and

A drowsy numbness pains

My sense, as though of hemlock

I had drunk,

Or emptied some dull opiate

To the drains One minute past,

And Lethe-wards had sunk

কোর্টের নড়াচড়ায় ভ্রমরের ছন্দ, প্রজাপতির রংধনু বিস্তার। শৃঙ্খলবদ্ধ অতিমানবদের ভিড়ে ফেডেরারের টেনিস যেন মুক্ত বাতাস, আকাশের ডানা, আসমানী সবুজ আর আতরের গন্ধ।

আসলে ফেদেরার টেনিসের দুটো যুগকে বেঁধেছেন নরম পশমে। একযুগে যখন পাওয়ার টেনিসের আবাহন ঘটে গেছে, সার্ভ আর ভলি অথবা বেসলাইন থেকে হাই টপস্পিন। আর তার পরের পাওয়ার সর্বস্ব দ্রুত কোর্ট কভারেজ ও স্ট্যামিনা, মানসিক কাঠিন্য আর ডিফেন্সিভ টেনিসের লড়াই। ফেদেরারের টেনিসের সুযোগ্য সহযোদ্ধা হতে পারতেন মারাত সাফিন। শক্তি এবং সৌন্দর্যের সঠিক মেলবন্ধন। কিন্তু মারাতের মন যে টেনিসে থাকত না, টেনিস তাঁর কাছে প্রতিভার প্রকাশের একটা সামান্য স্থান ছিল। কিন্তু ফেদেরার তো এক বা দুটোয় আটকে থাকার মতো নশ্বর ছিলেন না।

তাই বছরের পর বছর ধরে লড়ে গেছেন। ফেদেরারের পরের বছরেই ক্লে-কোর্টে নাদালের আবির্ভাব, বয়সে অনেকটা ছোট হলেও কৃতিত্বে কম নয় মোটেই। আর তাদের থেকে সামান্য ছোট জোকোভিচ যখন এসে হাজির হলেন তখন টেনিস সন্ধিক্ষণে। ২০১০-১১, ফেডেরার পিছিয়ে পড়ছেন ক্রমে। অবশ্য এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন কাঙ্ক্ষিত কেরিয়ার স্ল্যাম, রবিন সোডোরলিং-এর কাছে নাদালের হেরে যাবার সুযোগ নিয়ে। কিন্তু সে শিখর তো নাদাল পরের বছরেই ইউএস ওপেন ও উইম্বল্ডন জিতে ছুঁয়ে ফেললেন। জোকোভিচ অবশ্য ‘লেট ব্লুমার’।

২০১৬ সালে এসে নোভাকও ছুঁলেন তাঁদের। যা ওপেন এরায় একমাত্র রড লেভার (তাঁর অবশ্য একবছরে চারটিই গ্র্যান্ডস্ল্যাম জেতার রেকর্ড আছে, যা নোভাক গতবছর ইউএস ওপেন ফাইনালে হেরে গিয়ে অল্পের জন্য ছুঁতে পারেননি।) আর আন্দ্রে আগাসিই করতে পেরেছিলেন এই তিনমূর্তি আগে।

কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে, সোনার সময়কে পিছনে ফেলে আসার পরেও, কেরিয়ার খতম করার মতো চোট থেকে ফিরে এসেও রজার চালিয়ে গেছেন। চোট আঘাত অবশ্য নাদালেরও ভয়ংকর ছিল। আর জোকার? ২০১৭র অগ্রগতি থামিয়ে দেওয়া চোট এবং মানসিক সমস্যা। সেখান থেকে ফিরে এসে গত চার বছরে আটটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। তিনটি অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, তিনটি উইম্বল্ডন। কে জানে, ২০২২এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলার অনুমতি পেলে রাফার জায়গায় জোকারই হয় তো আজকের দিনে সর্বাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক হতেন।

বস্তুত রাফার লড়াইটাই সবথেকে কঠিন ছিল, সর্বকালের সেরা হবার। যে সময় তাঁর উদ্ভাস তখন ফেডেরারের সোনার সময়। তাও সমানে সমানে লড়ে, মানসিক কাঠিন্য দেখিয়ে, (একটা ফ্রেঞ্চ ফাইনালে ১৭টি ব্রেক পয়েন্টের মধ্যে শুধুমাত্র ১টাই হারেন রজারের কাছে) তিনি লড়ে নিয়েছিলেন এক নম্বরের শিরোপা। কিন্তু বেশিদিন নয়, তার পরে পরেই নোভাক জোকোভিচ এসে ছিনিয়ে নেন রাফার সিংহাসন। তবু রাফা লড়ে গেছেন, কব্জির চোট, ম্যুলার-ওয়েইস সিন্ড্রোম (পায়ের প্রধান হাড়ের অস্বাভাবিকভাবে বেঁকে যাওয়া) জয় করে তিনি ২০১৭ থেকে টানা চার বার ফ্রেঞ্চ জিতেছেন, জিতেছেন দুটো ইউএস ওপেন। আর ২০২২-এরটা তো রূপকথা।

রজার কিন্তু বারেবারে ফিরে এসেছেন। ১৭, ১৮’র উইম্বল্ডন জেতার পরে, দুরন্ত গতিতে ধাবমান নোভাককে ফাইনালে পেলেন ১৯-এ। সেমি ফাইনালে রাফাকে হেলায় হারিয়ে। কিন্তু সে ম্যাচে সেরা টেনিস খেলেও পারেননি নোভাককে হারাতে। আসুন দেখি সেই অবিস্মরণীয় ফাইনালে কী হল, কী ছিল তাঁদের স্ট্র্যাটেজি!

জোকারের আলাদা করে রজারের জন্য নতুন কোনও স্ট্র্যাটেজি ছিল না। জোকার এমন একজন প্লেয়ার যিনি সারা ম্যাচে পার্সেন্টেজ টেনিস খেলবেন, কিন্তু ঠিক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে খেলাকে উচ্চতায় তুলে নিয়ে ম্যাচ নিয়ে চলে যাবেন। ২০১৫-র ইউএস ওপেনের সেমিফাইনালে চতুর্থ সেটে দুটো ম্যাচ পয়েন্ট পেয়েও রজার পারেননি এই একই কারণে।

আর নোভাক জানতেন, যে ওঁর যেটা শক্তি, অর্থাৎ ফোরহ্যাণ্ডে কোমরের উপরে উঠে আসা বলে ফ্ল্যাট টপস্পিন, সেটা মারতে দিলে ও একশোটার মধ্যে একশো তেইশটা ঠিক ক্রসকোর্ট মেরে দেবেন। তাই অপেক্ষা করে গেছেন রজার কখন দেবত্ব ত্যাগ করেন। ভোরবেলায় কখন বাঘ জল খেতে নেমে এসে ঘাড় নিচু করে।

আর রজারের? ২০১৯-এর উইম্বল্ডন সারফেস বেশ স্লো। আগের বছরের মতো কেভিন অ্যান্ডারসন,স্যাম কুইরি, এরা অনেক দূর যেতে পারেননি। বরং যাঁরা বেসলাইন নির্ভর ডিফেন্সিভ টেনিস খেলে, সেরকম নিশিকোরি, আগুটরা কোয়ার্টার ফাইনাল সেমি ফাইনাল গেছেন। আর বল উঠছেও না।

এই সুবিধাটা রজার নেবার চেষ্টা করেছিলেন সারা ম্যাচে। ডিপ প্রথম সার্ভ, জোকারের ব্যাক হ্যান্ডে স্লাইস, লো টপস্পিন। এইভাবে। সত্যি বলতে কী, সারা ম্যাচে রজার মনে হয় অনেক অনেক ভালো টেনিস খেলেছিলেন। আর বল যেখানে হাঁটুর উপর উঠছে না, সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টপস্পিন মারা সত্যিই কষ্টকর। জোকার শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে গেছেন। লড়ে গেছেন। যদি কখনও সোনালী ভোর আসে এই আশায়। আর কী আশ্চর্য, প্রথম দুটো টাইব্রেকারে সত্যিই রজার এলিমেন্টারি মিস করেছিলেন।

আরেকটা ব্যাপার ছিল জোকারের প্রথম সার্ভিস পার্সেন্টেজ। তবে আমি মিসড অপরচুনিটি বলতে বলব প্রথম সেটে ৬-৫এ এগিয়ে থাকা অবস্থায় জোকারের সার্ভে একটা ডিপ ব্যাক হ্যান্ড ক্রশকোর্ট মারার পরেও রজার নেটে চার্জ করলেন না। তাহলে দুই ব্রেকপয়েন্ট পেয়ে যেতেন। আর কে বলতে পারে সেটটা ৭-৫ জিতলে খেলা অন্যরকম হত না।

সেই ৯০-এর আর্জেন্টিনার মতো জোকার প্রতিটি সেটকে টাইব্রেকারে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন। ইন্টেন্স থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় সেটের শুরুতে এবং চতুর্থ সেটে সেই ইন্টেনসিটি কমেছে। বক্সার যেমন একটা ভালো হুক মারার পরে একটু আত্মতুষ্টিতে ভোগে তেমনই গার্ড নামিয়ে ফেলেছেন। আর ফেডেরার? প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে আক্রমণ শানিয়ে গেছেন। শেষ সেটে তো জেদ নিয়ে চালিয়ে গেছেন। যখনই জোকোভিচ একটু ঢিলে দিয়েছেন বানের জলের মতো ঢুকে পড়েছেন ফেদেরার।

কিন্তু পঞ্চম সেটে এসে প্রায় আটত্রিশ ফেডেরার আর সত্যিই পারছিলেন না মনে হয়। সেটা জোকারও বুঝে ফেলেছিলেন। তাই আগের চারটে সেটের মতো অস্থির না হয়ে গায়কোচিয়া হবার অপেক্ষা করছিলেন।

ভাগ্য দেবতা একবার রজারকে সুযোগ দিয়েছিলেন, যখন পরপর দুটো আনফোর্সড এররের পর জোকার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন যে রজার দুটো টেরিফিক হাফভলি মেরে গেম নিয়ে চলে গেছেন। তারপর নিজের সার্ভে রজারের দুটো ম্যাচ পয়েন্ট। প্রথমটায় অনবদ্য সার্ভিস রিটার্ন আর দ্বিতীয় ম্যাচ পয়েন্টে মাথা ঠাণ্ডা করে খুব কম কয়েকটা ফোর হ্যান্ড ক্রসকোর্ট পাসিং-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা।

বরিস বেকার বারবার বলছিলেন, এতোগুলো ম্যাচ খেলার পরেও রজারের সার্ভিস জোকার বুঝতে পারছেন না। তাই কাল রজারকে ব্রেক করতে পঞ্চম সেটের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। পরে রজারের সার্ভিসের জোর কমে গেছিল বটে, তবু জোকার মারমার কাটকাট করে উড়িয়ে দিতে পারেননি তাকে। সর্বকালের সেরা সার্ভি রিটার্ন থাকার পরেও।

তবুও জোকার জিতলেন, ইস্পাতের মত স্নায়ু আর অদ্ভুত আলো আলো মানসিকতার জন্য। শেষের দিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে হারতে পারেন না। এমনিতেই প্রথমবার উইম্বল্ডনে শেষ সেটে ১২-১২ হবার পর টাইব্রেকার হবে এরকম নিয়ম ছিল আর সেটারই সুযোগ নিলেন জোকার। আর তীরে এসেও ডুবল ফেডেরারের তরী। সেই সুদীর্ঘ ১৭ বছর আগে মার্ক ফিলিপৌসিসকে ফাইনালে হারানো দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, এসডব্লিউ১৯এর সেন্টারকোর্টে ২০১৯এ এসে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না তা।

মাঝখান থেকে শুধু গ্র্যান্ডস্ল্যামেই নাদালের টপকে যাওয়া এবং জোকারের প্রায় টপকে যাওয়া নয়। ধারাবাহিকতা এবং সব কোর্টে সমান তীক্ষ্ণতা নিয়ে আর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে স্নায়ুর লড়াইয়ে এগিয়ে থেকে জোকোভিচই হয়তো নাদাল, ফেদেরারকে সরিয়ে সর্বকালের সেরা হয়ে যাবেন।

আর রজার? বছর চারেক আগেও যাঁকে সর্বকালের অবিসংবাদিত সেরা বলা হচ্ছিল, তিনি হয় তো মুকুট হারাচ্ছেন অচিরেই। ফিরে আসার পথও আরও আরও দুর্গম, সময়ের কাঁটা ছুঁয়েছে ৪০ বছর। সাম্প্রতিককালে কোমর, হাঁটুর চোটেও ভুগছেন বেশ। ডান হাঁটুর আগের অস্ত্রোপচারটা ফলপ্রসূ না হওয়ায় গত বছর জুলাইতে মেজর সার্জারির জন্য গেলেন তিনি। হয়তো উইম্বল্ডনের আগে কোর্টে ফিরবেন, কিন্তু পুনরুজ্জীবিত নাদাল, ভ্যাকসিন নিয়ে অদ্ভুত স্ট্যান্ড নেওয়া, খোঁচা খাওয়া বাঘ জোকার বা বর্তমান কালের সুপারস্টার, মেডভেডেভ, সিসিপাস বা জেরেভের মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট অস্ত্র রজারের ক্রমক্ষীয়মান অস্ত্রাগারে মজুত আছে কি না সে নিয়ে সপ্তর্ষিমণ্ডলের সমান প্রশ্নচিহ্ন থেকে যাবে।

তবু রজারকে কি আমাদের মতো নশ্বর শিল্পলোভাতুর মানুষের মন থেকে মোছা সম্ভব হবে? টেনিস যখন দেখতে শুরু করি তখন রজার ফেডেরারের জন্মই হয়নি। জনি ম্যাক, বুমবুম আর ফরিক আন্দ্রে আগাসিকে নিয়েই আমাদের সংসার।

অথচ সেখানে হঠাৎ করে যৌবনে পৌঁছে এক উজ্জ্বল তারকার উদ্ভব। যে শক্তিকেও শিল্পের টানে আমাদের শিরদাঁড়ায় শিহরণ জাগিয়ে রাখল প্রায় দুই দশক। আমাদের চুলে পাক ধরে নুনের আধিক্য বেড়ে গেল তবু স্বপ্ন দেখা থামাতে পারলাম না। হয়তো এমন দিন খুব সামনেই, যখন টেনিস থেকে হৃদয় উবে যাবে, অন্ততঃ আমাদের মতো হোপলেস রোমান্টিকদের কাছে। তখন হয় তো টেনিস দেখাও ছেড়ে দেব।

কিন্তু তার আগে একফালি রোদ্দুর নিয়ে বেঁচে থাকুক আমাদের টেনিস দর্শন, যে রজার ফেডেরার আবার স্বমহিমায় ফিরবেন এবং ফিনিক্স নাদাল বা এভারেস্ট জোকার বা অন্যান্য দুহাতের ব্যাকহ্যান্ড মারা বেসলাইন নির্ভর ঘোঁতঘোঁত টেনিসের ভিড়ে একবার না একবার প্রজাপতির সিংহসম বিচরণ মাথা তুলে দাঁড়াবে। কে জানে, আর কখনও এই দ্বিতীয়বার জীবন পাওয়া বিদ্যুৎময় সুন্দর সিঙ্গল হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ড দেখতে পাব কি না। কিন্তু শেষ হবার আগেও তো একটা সমাপন থাকে। বাসেলের সেই সদাহাস্যময় আবেগী অথচ শান্ত শিল্পী শেষ দেশলাই কাঠিটাকে হয়তো এখনও তাঁর বাক্সে রেখে দিয়েছেন। আশাই তো বেঁচে থাকার অপর নাম।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link