জীবনে এখন তাঁর সাফল্য বা সম্পদ – কোনোটারই কমতি নেই। তবে, শুরুটা এত সহজ ছিল না!
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে কাঠখড় কম পোহাতে হয়নি। বাবা হোসে দিনিস ছিলেন মিউনিসিপ্যাল বাগানের মালি। মা মারিয়া ডোলোরেস রান্নার কাজ করতেন। চার ভাইবোনের পরিবারে রোনালদো ছিলেন সবার ছোট। ছোট ছেলে রোনালদোকে নিয়েই তাঁদের স্বপ্ন ছিল বেশি।
সবার আদরের ছিলেন খুব। এখন ‘সিআর সেভেন’ নামে পরিচিত এই তারকার নাম রাখা হয় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানের নাম থেকে। বাবার খুব ভক্ত ছিলেন রিগ্যানের, সে কারণেই এমন নামকরণ।
বয়স বাড়ার সাথে সাথেই রোনালদোর প্রথম পছন্দ ফুটবল। সেই তিন বছর বয়স থেকেই তিনি আছেন ফুটবল নিয়ে। ছয় বছর বয়সে প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার পরও সেই ফুটবল। আশপাশের সবার কাছে ঠিক এখনকার মত তখনও ফুটবলার রোনালদোর খুব কদর ছিল।
মাত্র আট বছর বয়সে জায়গা হয়ে গেল আন্দোরিনহা নামের স্থানীয় এক অপেশাদার ফুটবল ক্লাবে। এর কয়েক বছর পর যোগ দেন মাদেইরার জনপ্রিয় ফুটবল দল সিডি ন্যাসিওনাল ক্লাবে।
তখন রোনালদোর বয়স খুব বেশি না – ১০ কি ১১ হবে। তখনই তিনি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন নিজের ফুটবল কারিশমায়। তবে, খুব বেশিদিন থাকা হয়নি এই ক্লাবটিতে। ১৯৯৬ সালে যোগ দেন পর্তুগালের অন্যতম সেরা ক্লাব স্পোটিং লিসবনে, যেন নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন আরেক ধাপ।
তবে, এই যাত্রায় ফুটবলার রোনালদোকে হারাতে হয় তার সমর্থক স্বত্ত্বাকে। কারণ, শিশুবেলায় তিনি সমর্থন করতেন বেনফিকাকে। সদ্য কৈশোরে পা দেয়া ছেলেটার সে কি পেশাদারিত্ব, এই বয়সে ওসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়। অথচ, রোনালদো ভাবতে পেরেছিলেন।
এখানেই শেষ নয়, ক্ষুদে রোনালদোকে মাদেইরাতে পরিবারকে রেখে চলে আসতে হয় লিসবনে। সেখানেই শুরু হয় তার নতুন জীবন, ফুটবলময় বর্ণাঢ্য এক জীবন।
খেলার মাঠে শৈশবে তাঁকে ডাকা হতো ক্রাই-বেবি নামে। এই নামকরণের পেছনের গল্পটাও বেশ মজার। তাঁর পাস থেকে কেউ গোল করতে পারলে নাকি কেঁদে দিতেন তিনি। বোঝাই যায়, কতটা আবেগ দিয়েই তিনি ফুটবল খেলতেন।
সেই সময়, মাঠে দ্রুততায়, ক্ষিপ্রতায় কেউ পেরে উঠতো না তার সাথে। তাই বন্ধুরা ডাকতো লিটল বি। আজও, ফুটবল মাঠে রোনালদোর গতি অস্বাভাবিক।
বাকি ইতিহাসের কথাটা না বললেই নয়। লিসবন থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড; গায়ে চাপালেন বেকহ্যামের ছেড়ে যাওয়া সাত নম্বর জার্সি। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রেড ডেভিলদের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম।
সেখান থেকে ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার, রেকর্ড দরে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমানো। ক্লাব বদলালেও রয়ে গেছেন সেই আগের মতোই। গোলের প্রতি প্রচন্ড নেশা থামছেই না। একের পর এক ইতিহাস গড়ে চলেছেন রোনালদো।
ওহ হ্যাঁ! স্কুল থেকেই নাকি রোনালদোর ইতিহাস বিষয়টির প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল।
ছোটবেলা থেকে ফুটবল নিয়েই ঘুমাতে যেতেন। বেশ বড় ধরণের অস্ত্রোপচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল রোনালদোকে। হৃদপিণ্ডেরর অস্ত্রোপচার শেষ পর্যন্ত সফল হওয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।
কে জানতো, সেই অস্ত্রোপচারটা সফল না হলে হয়তো – বিশ্ব ফুটবল তাঁর ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ফুটবলারকে আর দেখতেই পারতো না। রোনালদোর জীবনের বাকিটা সময় স্রেফ ইতিহাস।
বিশ্ব দেখে অভাবনীয় এক তারকার উত্থান! ম্যানচেস্টার থেকে রিয়াল মাদ্রিদ – ক্লাব ফুটবলে তাঁর অর্জনের শেষ নেই। সাফল্যের নেশা, ক্ষুধা চলমান ছিল ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসের হয়েও। অনেক ঘাটের জল খেয়ে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফিরে আবার বিতর্ক ছড়িয়ে তিনি এখন সৌদি প্রো-লিগে। এখন কেবলই বেলা ফুরনোর অপেক্ষা তাঁর।
জাতীয় দল পর্তুগালকে ইউরোপের সেরা দল বানিয়েছেন, লিওনেল মেসির সাথে নিজের লড়াইটাকে ইতিহাসের পাতায় তুলেছেন। সেই লড়াইয়ে কখনো তিনি একটু এগিয়েছেন, কখনো বা মেসি। আজও সেই লড়াই অব্যাহত। আজ দু’জনই ক্যারিয়ারের লম্বা সময় কাটিয়ে ফেললেও তাঁদের টেক্কা দেওয়ার মত কাউকে আজও খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আমাদের সৌভাগ্য যে ইতিহাসের সেরা ভূবন ভোলানো এই দ্বৈরথটা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারছি!