২০০৬ সালে আরব আমিরাত ও বাংলাদেশ ‘এ’ দলের মধ্যে একটি সিরিজ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। খুলনায় অনুষ্ঠিত সেই সিরিজে নেটে মাত্র ১২ বছর বয়সী এক স্পিনারের বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন আমিরাতের সেই সময়কার কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে। সিরিজের পর ছেলেটাকে একটা ব্যাট উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন হাতুরু। সেদিনই বোধহয় ব্যাটিংটাও নিয়ম করে করার একটা বাসনা তৈরি হয়েছিল শেখ মেহেদীর হাসানের মনে।
১৮ টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ছোট্ট এক ক্যারিয়ার। তবুও কেন যেন তাঁকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিভৃত এক চরিত্র মনে হয়। অন্যসব তরুণ ক্রিকেটারদের মত মেহেদীকে নিয়ে খবরের শিরোনাম করা হয় না, তাঁকে নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ঝড় উঠে না। এর বড় কারণ আসলে মেহেদীর ইমপ্যাক্টটা বাইরে থেকে বোঝা কঠিন। দলে তাঁর ভূমিকাটা খালি চোখে ঠিক বোঝা যায় না। শুধুই সংখ্যা দিয়ে পড়তে চাইলে মেহেদীকে ভুল পড়া হয়।
কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজটা জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন মেহেদী। সিরিজের প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাট করে মাত্র ১৩১ রান করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। এই পুঁজি নিয়েও অস্ট্রেলিয়াকে হারানো যায় সেটা তখন ক’জনই বা বিশ্বাস করতো। তবে শেখ মেহেদী বিশ্বাসটা করেছিলেন। তিনিই প্রথম সাহসটা দেখিয়েছিলেন। বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের তিনিই প্রথম বার্তাটা দিলেন, ‘আমরা লড়াই করতে এসেছি।’
ইনিংসের প্রথম বলেই অজি ওপেনার অ্যালেক্স ক্যারিকে রীতিমত বোল্ড করে দিলেন। এটাকে শুধু একটা উইকেট হিসেবে বিবেচনা করলেই ভুলটা হবে। মেহেদীর গুঁড়িয়ে দেয়াটা স্টাম্পটা ছিল তখন পুরো অস্ট্রেলিয়া দলের প্রতিচ্ছবি। ওই একটা উইকেট পুরো বাংলাদেশ দলকে সাহস জুগিয়েছে। ইনিংসের শুরুতেই এমন একটা উইকেট দলকে চাঙা করেছে। অন্যান্য বোলারদের মনেও বিশ্বাস এসেছিল যে তাঁরাও পারবেন।
এই কাজটা মেহেদী পরের ম্যাচ গুলোতেও করেছেন। তিনি আর দশটা সাধারণ অফ স্পিনারের মতই। তবে মেহেদী নিজের দুর্বলতা ও শক্তির জায়গাটা বোঝেন। অধিনায়ক যখনই বল তুলে দিয়েছেন তখনই নিজের কাজটা করে গিয়েছেন। পাওয়ার প্লেতে উইকেট এনে দিয়েছেন। মাঝের ওভার গুলোতে ইকোনমিক্যাল বোলিং করে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের উপর চাপ তৈরি করেছেন।
লাইন-লেন্থের উপর তাঁর নিখুঁত কন্ট্রোল মেহেদীকে আলাদা করে। তিনি হয়তো খুব নজরকারা রিস্ট স্পিনার নন। কিংবা বল প্রচণ্ড টার্ন করাতে পারেন তাও না। তবে মেহেদী খুব সহজে ব্যাটসম্যানদের রান করতে দিবেন না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও একেরপর এক ডট বল করে ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলে দেন। ফলে অন্য প্রান্তের বোলারদের জন্য উইকেট পাওয়ার কাজটা সহজ হয়ে যায়। ফলে শুধু উইকেট সংখ্যা দিয়ে তাঁকে মাপলে দলে তাঁর অবদানকে অবহেলা করা হয়।
মেহেদীর আরেকটা বড় গুন হলো তিনি একজন টিম ম্যান। দল থেকে তাঁকে যে দায়িত্বটা দেয়া হয় তিনি সেটাই করেন। বাংলাদেশ দল মূলত তাঁকে স্পিনার হিসাবেই খেলাচ্ছে। তবুও ব্যাট হাতে যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেটুকুকেই কাজে লাগিয়েছেন। আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমেও তিনি যে দ্রুত ব্যাট চালাতে পারেন তাঁর প্রমাণ দিয়েছেন।
ফলে মেহেদী দলে থাকলে দলের ব্যাটিং লাইন আপ গভীর হয়। শেষ দিকে দ্রুত কিছু রান করে দিতে পারেন। এছাড়া মেহেদীকে চাইলে ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন পজিশনেই ব্যাট করতে পাঠানো যায়। বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচে পিঞ্চ হিটার হিসেবে তাঁকে উপরের দিকে নামানো হলেও খুব অবাক হয়ার কিছু থাকবে না। ফলে তিনি দলে থাকা মানে প্রতিপক্ষ দলের জন্যও এক চিন্তার বিষয়।
যেমন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল চার নম্বর পজিশনে। আবার শেষ ম্যাচে তাঁকে দিয়ে ওপেনও করিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে দারুণ শুরুও এনে দিয়েছিলেন দলকে। মোদ্দাকথা মেহেদীকে যখন যা করতে বলা হয়েছে তিনি সেটাই করার চেষ্টা করেছেন। দলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
ফলে সাকিব, নাসুমদের সাথে বিশ্বকাপে মেহেদীর বোলিং বাংলাদেশের স্পিন বোলিং অ্যাটাকে বাড়তি বৈচিত্র যোগ করবে। এছাড়া ব্যাট হাতে তাঁর ছোট ছোট ক্যামিও দলের জন্য বাড়তি পাওয়া। প্রতিপক্ষ ও ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁকে বিভিন্ন পজিশনে ব্যাট করতে নামিয়ে প্রতিপক্ষের উপর চাপ তৈরি করা সম্ভব। সবমিলিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে ইমপ্যাক্টফুল ক্রিকেটারদের একজন মেহেদী।