২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭, এক আনকোরা অধিনায়ক প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি তুলে ধরলেন জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে, চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানে রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে হারিয়ে উল্লাসে মেতেছে গোটা দল, সেই সাথে গোটা ভারতবাসী ও। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।
সেই বিশ্বকাপের পর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা একদম যাকে বলে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছে, চারদিকে সব ফ্রাঞ্চাইজি লিগের রমরমা বাজার এসে গেছে, যার মধ্যে সেরা অবশ্যই ভারতের আইপিএল।
ক্রিকেট বিশ্বতে টি-টোয়েন্টি সেই বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়ার পর সেদিনের সেই আনকোরা অধিনায়ক আর কোনো দিন যদিও ছুঁতে পারেননি সেই ট্রফিটা। মাথার চুল পাকিয়ে ফেলা সেই অধিনায়ক এবারেও ভারতীয় দলে থাকবেন, তবে অবসরপ্রাপ্ত সেই তিনি পোশাকি পদে ‘মেন্টর’ হয়ে, তাঁর মস্তিস্কতেই হয়তো আবারও ‘কিছুটা’ নিয়ন্ত্রিত হবে ভারতের কুড়ি বিশের বিশ্বকাপ অভিযান।
হ্যাঁ সেই তিনি আর কেউ নন মহেন্দ্র সিং ধোনি, যাঁর ড্রেসিংরুমে ‘মহেন্দ্র ছোঁয়ায়’ ১৪ বছর পর এবারও কী দুবাই স্টেডিয়ামে ট্রফিটা তুলে ধরার সেই মুহূর্ত হাজির করবেন কিং কোহলি? আশাবাদী হওয়ার অবশ্যই যথেষ্ট কারণ থাকছে।
সাড়ে পাঁচ বছর আগে হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ৭২ ম্যাচে ভারত জয়লাভ করেছে ৫১ ম্যাচে, আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়েও দুই নম্বরে থাকা দলের থেকে সবাই যে উচ্চাশা পোষণ করবেন এটা বলাই বাহুল্য। পায়ে পায়ে শুরু হতে চলা মরুর দেশে এই বিশ্বযুদ্ধের জন্য কেমন প্রস্তুত ভারত, দেখে নেওয়া যাক।
ভারতীয় দলের টপ অর্ডারে রোহিত, রাহুল ও কোহলির মত এই তিন মহারথীর ব্যাটিং এর দিকে সবচেয়ে আগে তাকিয়ে থাকবে দল, কারণ স্কোরবোর্ডে বড় রান তুলতে এই তিনজনের মধ্যে অন্তত দু’ জনের ১০-১৫ ওভার অবধি ব্যাটিং খুব জরুরি, আর এঁরা প্রত্যেকেই বড় ইনিংস খেললে ১৫০ বা তার বেশি স্ট্রাইক রেটেই ব্যাটিং করার ক্ষমতা রাখেন। আন্তর্জাতিক টি২০ তে তিনজনেই দুর্ধর্ষ সব পারফরমেন্স দিয়ে শেষ পাঁচ বছরে বিশ্বের সেরাদের দলে।
এরপর মিডল অর্ডারে সূর্যকুমার যাদব ও ঋষভ পন্তের ভূমিকা খুব জরুরি হতে চলেছে, দ্রুত প্রথম দিকের উইকেট পড়লে সূর্য এবং পন্ত দুজনের মধ্যে একজনের শেষ পর্যন্ত উইকেটে থাকা খুব জরুরি। এঁদের দুজনেরই সুবিধা হলো যেকোনো পরিস্থিতিতেই হাত খুলে খেলার ক্ষমতা রাখেন। ভারতের টি২০ দলে সূর্যর এই দারুন উত্থান একটা বিরাট পজিটিভ দিক। আমিরশাহীর উইকেটে নিয়মিত হয়তো ১৮০-২০০ রান হবে না, কিন্তু অন্তত ১৬০-১৭০ এর কাছাকাছি রান তুলতে বা তাড়া করতে মিডল অর্ডারকেও ভালো খেলতে হবে।
চাপের মুহূর্তে চোক করে যাওয়ার বদভ্যাস ত্যাগ করলে আর শেষের দিকে হার্দিক, জাদেজারা তাঁদের নিজেদের খেলা খেললে ম্যাচ ফিনিশ করে আসা সমস্যা হবে না। হার্দিক ও জাদেজার ব্যাটিংকে ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী কিভাবে কাজে লাগানো হয় সেটা অবশ্যই দেখার বিষয় হবে।
তবে জাদেজা সম্পর্কে কয়েকটা ব্যাপার বলার থাকে – জাদেজা কিন্তু গত অস্ট্রেলিয়া সফরে প্রথম টি২০ তে ৪৪ রানের ইনিংসটা বাদ দিলে গোটা ক্যারিয়ারে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচে জেতানো বা উল্লেখযোগ্য কোনো ইনিংস উপহার দেননি, বোলিং এ হয়তো তুলনায় কিছুটা বেশি সাফল্য এসেছে, যদিও দারুণ সব উইকেট তুলে ম্যাচ ঘোরানো বোলিং পারফরমেন্স ও খুব বেশি জাদেজার থেকে পাওয়া যায়নি।
এই বিশ্বকাপের দলগঠন দেখে মনে হয়েছে জাদেজাকে হয়তো ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে ব্যবহার করার চেস্টা করবে দল। কিভাবে আসল সময় টিম ম্যানেজমেন্ট জাদেজাকে ব্যবহার করে সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকবো আমরা সবাই। হার্দিক কতোটা ম্যাচে বোলিং করবেন সেটা দেখার বিষয়, নির্বাচক প্রধান চেতন শর্মার বক্তব্য অনুযায়ী হার্দিক বিশ্বকাপে নিয়মিত বোলিং করবেন, বিশ্বকাপের জন্যই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে এতদিন, এমনই শোনা গেছে।
আর একটা ব্যাপার দলে তৃতীয় কোনো ওপেনার না থাকা, সেক্ষেত্রে ঈশান কিষানকেই তৃতীয় ওপেনার কাম দ্বিতীয় কিপার কাম প্রয়োজনে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে এমনটাই শোনা গিয়েছে নির্বাচক প্রধানের থেকে। অভিষেক সিরিজ থেকেই দ্যুতি ছড়ানো ঈশানের এ হেন অন্তর্ভুক্তি যথেষ্ট ভালো দিক এবারের দল নির্বাচনে, তবে শ্রেয়াস আয়ারের না থাকা কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেক করে অবশ্যই।
ভারতের বোলিং ডিপার্টমেন্ট যেটা বিশ্বকাপের জন্য বাছা হয়েছে সেখানে বেশ কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, চাহাল কেন নেই স্পিন বিভাগে? চার বছর ধরে যে স্পিনার দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিলেন তিনি কয়েকটা ম্যাচে খারাপ বোলিং করার জন্য বাদ পড়লেন। স্পিন বিভাগে অশ্বিনের ফিরে আসা অবশ্যই ভালো দিক, তবে চার বছর বাদে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ফেরাটা খুব সহজ হয়তো হবে না।
গ্ৰুপ লিগে বাবর, রিজওয়ান, হাফিজ, উইলিয়ামসন, কনওয়ে, মুশফিকুরদের মত ব্যাটসম্যানের মুখোমুখি কিন্তু হতে হবে অশ্বিনকে। কেমন করেন অশ্বিন সেদিকে অবশ্যই চোখ থাকবে। আর কখনো কম রানের টার্গেট ডিফেন্ড করতে বা শেষ ওভারে ম্যাচ জেতাতে, বড় পার্টনারশিপ ভাঙতে একজনকে সেরা ফর্মে থাকতেই হবে, তিনি হলেন – জাসপ্রিত বুমরাহ, ভারতের প্রধান স্ট্রাইক বোলার বুমরাহর ওপর ভারতের বিশ্বকাপ অভিযান অনেকটাই নির্ভর করবে।
অক্ষর প্যাটেলের জায়গায় শার্দুল ঠাকুরের অন্তর্ভুক্তি দলে আলাদা মাত্রা যোগ করবে আশা করা যায়। ডেথ ওভারে স্লোয়ার বা নাকল বলের ভ্যারিয়েশন এর পাশাপাশি ৮ নম্বরে নেমে ব্যাট হাতেও ঝড় তুলতে পারেন শার্দুল। মিস্ট্রি স্পিনার হিসেবে মাত্র তিনটা আন্তর্জাতিক ম্যাচের অভিজ্ঞতা থাকা বরুণ চক্রবর্তীর দিকে চোখ থাকবে, বিশ্বের বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানই চক্রবর্তীর বোলিং ‘চেখে দেখেননি’, বিশ্বকাপেও ‘চক্রবর্তী রহস্য’ যতই উন্মোচন না হয় ততই মঙ্গল ভারতের।
ভারতের বিশ্বকাপ দলের দিকে যদি তাকানো যায় তবে এটা অবশ্যই বোঝা যাবে যথেষ্ট বুদ্ধি করেই এই দল গঠন হয়েছে, আবেগকে কম প্রাধান্য দিয়ে। ধাওয়ান, চাহালদের বাদ পড়া সেদিকেই ইঙ্গিত করে। গ্ৰুপে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছে পাকিস্তান আর নিউজিল্যান্ড। তবে আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ এই আরবের কন্ডিশনে কিন্তু মোটেই ফেলনা হবে না।
মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ গত এশিয়া কাপের ফাইনালিস্ট আর আফগানিস্তানের সাথেও কিন্তু ভারত গত এশিয়া কাপে জিততে পারেনি, টাই হয়েছিল (যতই ৫০ ওভারের সেই টুর্নামেন্ট হোক)। সুতরাং যেহেতু গ্ৰুপ থেকে মাত্র দুটো দলই সেমিতে যাবে সেক্ষেত্রে একবার পা হড়কালেই সমস্যা হতে পারে।
তবে প্রথমে পাকিস্তান ও পরের নিউজিল্যান্ড ম্যাচ জিতে বেরিয়ে গেলে মোমেন্টাম তখন ভারতের হাতেই, আর সেমিতে উঠলে তখন তো দু’কদম দূরে ১৪ই নভেম্বরের ট্রফি। শুধু আসল সময় ‘চোক’ না করলেই হলো। তা হলেই ১৪ বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ট্রফির ‘বনবাস’ কাটিয়ে আবার উঠতে পারে কোহলির হাতে, আর সাথে যদি ‘মাহেন্দ্রযোগ’ থাকে, তা হলে তো স্বপ্ন দেখাই যায়।
- ভারতের স্কোয়াড
বিরাট কোহলি (অধিনায়ক), রোহিত শর্মা, লোকেশ রাহুল, সুরিয়াকুমার যাদব, ভূবনেশ্বর কুমার, ঋষভ পন্ত, হার্দিক পান্ডিয়া, রবীন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামি, ঈশান কিষাণ, বরুণ চক্রবর্তী, শার্দুল ঠাকুর, রাহুল চাহার।