জাভি, দ্য পাপেট মাস্টার

ছেলে এসি মিলানে খেলার জন্য ইতালিতে উড়াল দিবেন। সবকিছু ঠিকঠাক। আনুষ্ঠানিকতা বাকি শুধু। বাবা হোয়াকিম হার্নান্দেজও সানন্দে রাজি হলেন। কিন্তু বেঁকে বসলেন মা মারিয়া ক্রুজ।

রীতিমত হুমকি দিয়ে হোয়াকিমকে জানিয়ে দিলেন, ‘আমাদের ছেলে যদি বার্সেলোনা ছেড়ে মিলানে যায়, তাহলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব।’ সহধর্মিণীর এমন রূদ্রমূর্তিতে হোয়াকিমও পিছু হাটলেন। ছেলেকে রেখে দিলেন নিজেদের শহরেই। আর সেই ছেলেই একদিন হয়ে উঠলেন বার্সার কিংবদন্তীদের একজন।

গল্পটা জাভি হার্নান্দেজের। স্প্যানিশ ফুটবলের উত্থানের গল্প কিংবা এক বিংশ শতাব্দীতে বার্সেলোনার আধিপত্যের গল্পের সামনের সারির নায়ক এই জাভি। খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ারে দু’হাত ভরে পেয়েছেন। আর সেই সাফল্যে মোড়ানো অধ্যায়ই তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে সেরাদের আসনে।

১১ বছর বয়স থেকে ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু। বার্সেলোনার তখন যুব প্রকল্প লা মাসিয়া খেলোয়াড় তৈরির কারখানা। জাভি নিজের শুরুটা করলেন এই অ্যাকাডেমিতেই। এরপর থেকেই দ্যুতি ছড়ানো শুরু। বার্সেলোনা সি, বার্সেলোনা বি দল হয়ে বার্সেলোনার মূল দলে সুযোগ পেলেন দ্রুতই।

তখন বার্সেলোনার মধ্য মাঠের প্রাণ ছিলেন পেপ গার্দিওলা। যাকে আবার পরবর্তীতে বার্সেলোনার ইতিহাসে সবচেয়ে সফলতম কোচ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তো গার্দিওলার সাথে জাভির খেলার ধরনের খুব মিল ছিল। অবশ্য ক্যারিয়ারের শুরুর দিক থেকেই গার্দিওলাকে খুব ফলো করতেন জাভি।

এক কথায় লা মাসিয়াতে থাকার সময় গার্দিওলার মতোই হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, সেই গার্দিওলার এক ইনজুরির কারণেই তাঁর জায়গায় বার্সেলোনার মূল দলে জায়গা পান জাভি। আর একটা সময় যার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন খেলোয়াড় হিসেবে পেপ গার্দিওয়লাকে পরবর্তীতে ছাপিয়ে যান জাভি।

বার্সেলোনার হয়ে জাভি প্রথম মাঠে নেমেছিলেন ১৯৯৮ সালে। সাউদাম্পটনের বিপক্ষে প্রীতি এক ম্যাচে তিনি বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নেমেছিলেন। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচেও অভিষেক হয় সে বছরে।

১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে পেপ গার্দিওলা ইনজুরিতে পড়ায় মাত্র ১৯ বছর বয়সেই দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্লে-মেকারে পরিণত হন জাভি। আস্থার প্রতিদান দেন প্রথম মৌসুমেই। বার্সেলোনা সে বার লালিগা শিরোপা জিতেছিল। আর জাভি নির্বাচিত হয়েছিলেন লিগের বেস্ট ব্রেক থ্রু প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার।

তবে সেই মৌসুমের পর থেকেই বার্সেলোনার আর্থিক অবস্থার অবনতি শুরু হয়। প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়ে যায় সে সময়। অভিষেক মৌসুমে দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের কারণে ততদিনে ইউরোপের বেশ কিছু ক্লাবের নজরে পড়েছেন জাভি।

এসি মিলান থেকে সরাসরি প্রস্তাব পেলেন। লোভনীয় প্রস্তাব। একবার তাতে সাঁইও দিয়ে ফেললেন। কিন্তু মায়ের কারণে থেকে যান বার্সাতেই। বার্সার ক্রান্তি লগ্নে ক্লাবের হাল ধরার চেষ্টা করলেন।

দু:সময়ে ক্লাবের পাশে থাকার ফল মিলল দ্রুতই। ২০০৫ সালে জাভিকে বার্সেলোনার সহ-অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। আর সে বছরেই আবারো পুরনো ছন্দে ফেরে বার্সেলোনা। লা লিগা ও সুপার কোপা- দুই শিরোপাই ঘরে তোলে কাতালানরা। আর সে মৌসুমে লা লিগার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন জাভি।

তবে পরের মৌসুমেই বড় এক ইনজুরির মুখে পড়েন জাভি। অনুশীলনের সময় বাম পায়ের লিগামেন্ট ছিড়ে যায় তাঁর। এ কারণে সেবারের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে বেঞ্চে বসে কাটাতে হয় তাঁকে। চার মাস ফিরে আবারো পুরনো রূপে ফিরতে শুরু করেন তিনি। আগের বারের মতো এ মৌসুমেও লা লিগা ও সুপার কোপার শিরোপা জেতেন তিনি।

জাভি তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছিলেন ২০০৮-০৯ মৌসুমে। সেবার ইউরো ফুটবলে ফাইনালে জার্মানিকে হারিয়ে ১৯৬৪ সালের পর প্রথম শিরোপার মুখ দেখেছিল স্পেন। আর ফাইনালের একমাত্র গোলটি জাভির বানানো বল থেকেই এসেছিল। তাঁর পাস থেকে গোল করেন ফার্নান্দো তোরেস। তাছাড়া রাশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে একটি গোল করেছিলেন জাভি। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের কারণে সেই ইউরোর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।

২০০৮ এর সেই উয়েফা ইউরোর ফর্ম টেনে এনেছিলেন ক্লাব ফুটবলেও। সে বছরের কোপা দেল রে’র ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে বলতে গেলে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ফ্রি-কিক থেকে করেছিলেন দুর্দান্ত এক গোল। এরপর সে বছরেই এল ক্লাসিকোতে রিয়ালকে ৬-২ গোলের বিধ্বস্ত করার ম্যাচে একাই ৪ টি গোলে সহায়তা করেছিলেন জাভি।

২০০৮-২০০৯ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ম্যানইউ এর বিপক্ষে জয়েও মাঝমাঠের ত্রাণকর্তা হয়ে ছিলেন জাভি। বার্সেলোনা সে ম্যাচ ২-১ গোলে  জয় লাভ করে। আর দ্বিতীয় গোলটিতে সহায়তা করেন তিনি।

তাঁর বাড়ানো বল থেকেই হেডে গোল করেছিলেন লিওনেল মেসি। সব মিলিয়ে সে মৌসুমে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে ২৭ টি গোলে সহায়তা করেছিলেন তিনি। আর এ কারণেই সেবার উয়েফার মাঝমাঠের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন জাভি।

২০১০ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জেতে স্পেন। আর সে বিশ্বকাপেও দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন জাভি। সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে একমাত্র গোলটির উৎস তিনিই ছিলেন। তাঁর বাড়ানো বল থেকেই হেডে গোল করেছিলেন কার্লোস পুয়োল।

২০০৮ ইউরোর মতো ২০১২ সালের ইউরো ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্পেন। আর এখানেই আরেকটি কীর্তি গড়েন জাভি। টানা দুই ইউরোর ফাইনালে গোলের সহায়তা করার রেকর্ড গড়েন তিনি। ইতালিকে ফাইনালে ৪-০ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় বার ইউরোর শিরোপ জেতে স্পেন। আর সেই ৪ গোলের দুটিতেই অ্যাসিস্ট করেন জাভি।

মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথের শুরুর সময়ের ফুটবলার ছিলেন জাভি। আর তাতে তাদের টানা দুইবার টেক্কা দিয়েছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে মেসি যেবার প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি অর জিতলেন, সেবার জাভি হয়েছিলেন তৃতীয়। ঠিক পরের বছরেও ব্যালন ডি অরের শীর্ষ তিনে জায়গা পান জাভি। এবার ব্যালন ডি অরের সংক্ষিপ্ত তালিকায় তাঁর সাথে ছিলেন আরো দুই বার্সা সতীর্থ- মেসি আর ইনিয়েস্তা।

বার্সার সাথে জাভির দীর্ঘ দিনের পথচলা শেষ হয়েছিল ২০১৫ সালে। তবে তাঁর শেষটা হয়েছিল দুর্দান্ত। বার্সার হয়ে শেষ মৌসুমে জেতেন ট্রেবল। অধিনায়ক হিসেবে সে মৌসুমে লা লিগা শিরোপা দিয়ে শুরু। এরপর কোপা দেল রে এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা দিয়ে শেষ হয় জাভির বার্সা ক্যারিয়ার।

বার্সা ছাড়ার পর কাতারের ক্লাব আল সাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন জাভি। তিন বছর সেখানে খেলার পর পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে দেন তিনি। তবে ফুটবলের সাথে আবার ভিন্নরূপে সেখানেই শুরু করেন জাভি। আল সাদের কোচ হয়ে কোচিং ক্যারিয়ারে প্রবেশ করেন জাভি।

আল সাদের দায়িত্ব নিয়ে শুরুর মৌসুমেই দেখান চমক। এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে আল সাদকে নিয়ে যান সেমিফাইনালে। এরপর ২০১৯-২০ মৌসুমে কাতার কাপ শিরোপা জেতেন তিনি।

খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে লোভনীয় সব প্রস্তাব পেয়েও বার্সার দু:সময়ে পাশে ছিলেন জাভি। এরপর সেখান থেকে বার্সাকে রীতিমত ইউরোপের সেরা ক্লাবে পরিণত করেন। ইতিহাসের প্রথম ক্লাব হিসেবে বার্সার দুই বার ট্রেবল জয়ের পথযাত্রায় অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। তবে সোনালি দিনে সেই বার্সা আবারো আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে। যার কারণে তারা তাদের ইতিহাসের সেরা তারকা মেসিকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।

এর পাশাপাশি ক্লাবের বাজে পারফরম্যান্স তো ভাবাচ্ছিলই। কিকে সেতিয়েন, রোনাল্ড কোম্যান- কোনো কিছুতেই সাফল্য ধরা দিচ্ছিল না। এমন ধুকতে থাকা বার্সার পাশে আবারো দাঁড়ালেন জাভি। ২০২১ সালের শেষ দিকে আবারো বার্সায় ফিরলেন তিনি। তবে কোনো খেলোয়াড় হিসেবে নয়। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলেন কোচ হয়ে।

জাভি যখন দায়িত্ব নিলেন তখন স্কোয়াড গোছানোই বড় চ্যালেঞ্জ। জাভি প্রথম দিকে সেই দল গোছানোর কাজটাই করলেন। বার্সার অনন্য প্লেয়িং স্টাইল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেন। প্রথম মৌসুমে সাফল্য পাবেন না, সেটি নিশ্চিতই ছিল।

কিন্তু, নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে এসে কিছুটা আলো দেখাতে শুরু করেন তিনি। বার্সার কোচ হিসেবে এ মৌসুমেই জেতেন উয়েফা সুপার কাপ শিরোপা। রিয়াল মাদ্রিদকে ৩-১ গোলে হারানোর সে ম্যাচে রিয়াল যেন জাভির প্লেয়িং স্টাইলের কাছে পাত্তাই পায়নি।

উয়েফা সুপার কাপ ছাড়াও এ মৌসুমে লা লিগার পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষে আছে জাভির বার্সা। আগের বারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ থেকে রয়েছে ৩ পয়েন্ট এগিয়ে। একটু একটু করে জাভির স্পর্শ বদলে যাচ্ছে বার্সা। খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় যেভাবে একটু একটু করে বার্সাকে সেরা করে তুলেছিলেন সেভাবে কি কোচ হিসেবেও পারবেন? এর জন্য অপেক্ষা আরো বেশ কিছু সময়ের।

চমৎকার দৃষ্টি শক্তি আর বল নিয়ন্ত্রণের অবিশ্বাস্য ক্ষমতার জন্য জাভিকে বলা হতো ‘দ্য পাপেট মাস্টার’। সেই পাপেট মাস্টারের চোখে এখন বার্সা বস হওয়ার স্বপ্ন। এর আগে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে গার্দিওলার মতো হওয়ার মতো স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। খেলোয়াড় হিসেবে অর্জনে তিনি গার্দিওলাকে বহু আগেই টপকে গিয়েছেন।

তবে, কোচ হিসেবে গার্দিওলা আবার সর্বজয়ী। বার্সা, বায়ার্নের চৌকাঠ পেরিয়ে ম্যানসিটিকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন নতুন সাম্রাজ্য। তাই সেই শৈশবের মতোই হয়তো জাভি এবারও গার্দিওলার মতো হতে চাইবেন। কে জানে বার্সা পুরনো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে পারে তাদের এই ঘরের ছেলের হাত ধরেই।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link