শচীন টেণ্ডুলকারের মুম্বাইয়ের বাড়ির ছাদে একটা ভারতীয় পতাকা টাঙানো থাকে সারাবছর। শুনেছি বাড়ি থাকলে শচীন প্রতিদিন ছাদে গিয়ে পতাকার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। মারাঠিদের একটা সহজাত দেশপ্রেম থাকে, নিজের ব্যক্তিগত সবকিছুর ওপরে দেশকে রাখতে পারে তাঁরা।
শচীনের ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কোনোদিন কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা যায়নি ক্রিকেট দেবতাকে। কিন্তু দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই সপাটে স্ট্রেট ড্রাইভ করে দিয়েছেন ভদ্রলোক। কিন্তু শচীন তো দেশের জন্য চায়ে চিনি খাওয়া, মদ, মিষ্টি, ফ্যাট আসতে আসতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। রানিং বিট্যুইন দ্য উইকেটসে গতি বাড়াতে শেষের দিকে জিমেও যেতেন নিয়মিত।
কিন্তু, বান্দ্রায় সারারাত পার্টি করার পর একটা উছৃঙখল ছেলে যখন টলমল পায়ে শচীনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘পাজি, ম্যায় কাল ইন্ডিয়া কো জিতানা চাহতা হু…’ তখন যেন কেমন হিসেব এলোমেলো হয়ে যায়!
২০০০ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে অভিষেকের পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ হয়তো এই ছেলেটারই জন্ম দিয়েছিল। সামনে ম্যাকগ্রা-লি-গিলেস্পি, ক্রিজে ১৯ বছরের যুবি, যুবরাজ সিং।
আজকে ঋষাভ পান্থকে নিয়ে কথা হয় তরুণ তুর্কি হিসেবে কিন্তু ঐ ১৯ বছরের প্রতিভা একুশ শতকে শচীনীয় সভ্যতার পর আর কি সত্যিই দেখা গেছে? ঐ বোলিং লাইন আপের সামনে সৌরভ-শচীনের উইকেট খুইয়ে চাপের মুখে ৮৪ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংস, যুবরাজ সেদিন থেকেই যেন অলিখিতভাবে ভারতীয় সংবিধানে লিখে দিয়েছেন তার আত্মবাক্য, ‘ম্যায় ইন্ডিয়া কো জিতানা চাহতা হু!’
ভারত সেদিনও জিতেছিল, আজও জেতে, শুধু পেরিয়ে গেছে একটা যুবরাজকীয় অধ্যায়। সে অধ্যায়ের প্যান্ডোরার বাক্সের ভেতর রাখা আছে আমাদের এক টুকরো শৈশব আর ভারতীয় ক্রিকেটের জীবন্ত বিপ্লবের গল্প।
ক্যান্সার তো হেরে যেতই, যেভাবে পয়েন্টের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া বলটা হেরে যেত ত্রিভঙ্গী ভারতবর্ষের তালুর কাছে। যেভাবে প্রথম অস্ট্রেলীয় আগ্রাসনের সামনে বুক পেতে দাঁড়াতো ভারতের সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড, যেভাবে ব্রেটলির স্লেজিংকে একটা পুল মেরে পার করে দিতেন ডারবানের বাউন্ডারি- টলমল পায়ের উছৃঙখল যুবরাজ যেভাবে ঐ নীল জার্সি গায়ে তুলে নিয়ে হয়ে উঠতেন অদম্য ফিনিক্স, সেভাবেই একদিন যুবরাজ নিজের অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন একখণ্ড ভারতবর্ষ, সেখানে ক্যান্সার তুচ্ছ!
আস্কিং রেট বাড়ছে? উইকেট পড়ে যাচ্ছে? বিপক্ষের উইকেট পড়ছে না?
যুবরাজ আছে। সামলে নেবে। চিন্তা নেই৷ এটুকু আশ্বাসে আমরা একটা প্রজন্মকে বড় হতে দেখেছি,এখানেই তো যুবরাজ ক্রিকেটার থেকে হয়ে উঠেছেন একটা প্রজন্মের দলিল, তার স্তরে স্তরে সাজানো দেশপ্রেমের দস্তাবেজ।
ভারতের ধুঁকতে থাকা ক্রিকেটে সৌরভ জমানায় বিদ্যুতের মতো এসেছিলেন যুবি, আসমুদ্র হিমাচল ছড়িয়ে থাকা জাতির আনাচে কানাচে থাকা কাঁটা নিজের দেশপ্রেমের স্তন্যে ফুল করে ফুটিয়ে দিয়েছেন যুবরাজ, একদিন বা দুদিন না, টানা ১৪ বছর ধরে!
যুবরাজ উঠে দাঁড়ালেই উঠে দাঁড়াত ভারতীয় দল, সমস্ত যন্ত্রণার কাঁটা ফুল হয়ে ফুটত চওড়া ব্যাট আর নীল জার্সির সামনে। আর এখানেই যুবরাজ থেকে যাবেন, ভারত যতদিন ক্রিকেট খেলবে ভারতের পতাকার ঠিক মাঝখানে অদৃশ্য প্রেমিকের মতো থেকে যাবেন যুবরাজ সিং।