জিনেদিন জিদান, বৃষ্টিস্নাত ক্লাসিকোর মাস্টারমাইন্ড

বর্তমান ফুটবলের বাঘা বাঘা ট্যাক্টিশিয়ানদের নাম বলুন তো? গার্দিওলা, মরিনহো, ক্লপ, আনচেলত্তি; আলোচনায় নামলে নামের অভাব হবে না। অথচ এসব নামের পাশে কখনও জিনেদিন জিদান নামটা উঠে আসতে দেখবেন না। বড় বড় ফুটবল পণ্ডিতেরা একসাথে বসেন, কফি খান, গল্প করেন।

রিয়ালের প্রশংসা করেন, ক্রুস-মদ্রিচের প্রশংসা করেন, কিন্তু আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়া জিনেদিন জিদান আড়ালেই থেকে যান। আলফ্রেডো ডি স্তেফানো স্টেডিয়ামের বৃষ্টিস্নাত ট্যাক্টিক্যাল ব্যাটেলে জয়ী হয়েও ক্রুস-বেনজেমার আড়ালে জিদান।

মোরিনহো-গার্দিওলা আমলের পর খুব সম্ভবত সবচেয়ে উত্তেজনাকর ফাইনাল ছিল গতকাল। এল ক্লাসিকোর জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে নয়, বরং দুই দলের লিগে অবস্থান, খেলার ধরণ আর ইনজুরিগ্রস্থ দুই দলের সামগ্রিক অবস্থা মিলে এই এল ক্লাসিকোর সিচুয়েশন ছিল অন্যরকম। তাই এই ম্যাচে যতটা না দেখা গিয়েছে দুই দলের খেলোয়াড়দের লড়াই, তার থেকে বড় লড়াই চলেছে সাইডবেঞ্চ থেকে দুই লিজেন্ড জিনেদিন জিদান আর রোনাল্ড কোম্যানের মধ্যে।

আর সেখানেই কোম্যানকে পরাস্ত করেছেন জিদান। ৩-৪-২-১ ফরমেশনে পিকেকে ছাড়াই ডিফেন্স সাজাতে হয়েছিল বার্সাকে। ফলে ডিফেন্সে ছিল সকলেই ছিলেন আনকোরা, বার্সার যুব দল থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়। ইনজুরি থেকে ফেরা আরাহো আর অস্কার মিনগুয়েজার সাথে ছিলেন ক্লেমেন লংলেট।

আর সেখানে জিদান নামিয়েছেন একটা ফ্লুইড একাদশ। গত ম্যাচে ট্যাকড়িক্যালি আউটবিট করা ইয়ুর্গেন ক্লপের বিপক্ষে নামানো একাদশ আর ফরমেশনই ট্রাই করবেন জিদান, এটাই ভেবেছিলেন সকলে। কিন্তু এসেন্সিওর জায়গায় ফেদেরিক ভালভার্দেকে নামিয়েই পুরো ম্যাচের চাবিকাঠি নিজের করে নেন জিদান।

চার মিডফিল্ডার দেখে বার্সা যখন ভেবেছিল মদ্রিচকে ফ্রি করে দিয়েছেন জিদান, সেখানে জিদান ফ্রি করে দিয়েছিলেন ভালভার্দেকে। ফলে মিডে ক্রুস-মদ্রিচ-ক্যাসেমিরো ট্রিও প্রথম ১০ মিনিটেই মিডফিল্ড নিজেদের পকেটে পুরে নিয়েছে। আর সেই সময়টা বার্সার ডিফেন্স তছনছ করেছেন ফেদেরিক ভালভার্দে।

কখনও উইংয়ে, কখনও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, কখনপো আবার রাইট ব্যাকে নেমে লুকাস ভাজকেজকে ক্রস করার সুযোগ করে দেওয়া, সব মিলিয়ে ভালভার্দে ছিলেন জিদানের ট্রাম্প কার্ড। আর এই ট্রাম্প কার্ডের পেছনেই নিজের ‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস’ ভাজকেজকে খাঁটিয়েছিলেন জিনেদিন।

বার্সার ডিফেন্স আনকোরা হলে কী হবে, ডিফেন্সের একটা জায়গাতে তারা বড্ড শার্প। অ্যারিয়াল ডিফেন্ডিং। পিকে ছাড়াও বার্সার থ্রি-ম্যান ডিফেন্সের প্রত্যেকেই নিজেদের জায়গা থেকে বেশ ভালো হেডার। গোল করতে-থামাতে দুই জায়গাতেই সফল তারা। তাই লিভারপুলের বিপক্ষে এক ম্যাচে ছয় লং বল খাটানো টনি ক্রুস ছিলেন এই ম্যাচে কোনো লং বল ছাড়া। এই মৌসুমে প্রথম কোনো ম্যাচে লং বল ছাড়া খেলেছেন ক্রুস।

জিদানের ট্যাক্টিসের সৌন্দর্য্যটাই এখানে। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে যখন পুরো টুর্নামেন্টে ২ গোল হজম করা জুভেন্টাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল রিয়াল, অ্যারিয়াল ডিফেন্ডিংয়ের রাজা জুভেন্টাসকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছিল জিদান তার লো ক্রস ট্যাক্টিসে। এল ক্লাসিকোতেও লুকাস ভাজকেজ সেটাই করেছেন। ভালভার্দের রানে ডিসপ্লেস হয়ে যাওয়া বার্সা ডিফেন্স ফুটো করে ঢুকে পরেছিলেন ভাজকেজ।

তাঁর কাজ ছিল শুধু একটা লো ক্রস দেওয়া, বাকি কাজটা ঠিকভাবেই সামলে নিয়েছেন করিম বেনজেমা। পুরো মিডফিল্ড ডমিনেট করলেও বল কন্ট্রোল ছিল কিন্তু বার্সার পায়েই। তবুও এক জিনেজিন জিদানের কল্যাণেই সবটা নিজের করে নিয়েছে রিয়াল।

দ্বিতীয়ার্ধে চোটের কারণে ভাজকেজ-ভালভার্দেকে বদলে অদ্রিওজোলা আর ইসকোকে নামাতে হয়েছিল জিদানের। তুরুপের তাস হারিয়ে যখন জিদানের খেল দেখানোড় সমাপ্তি ভেবেছিল বার্সা, তখনই ক্রুস-ভিনি-বেনজেমাকে সরিয়ে মার্সেলো-এসেন্সিও-মারিয়ানোকে নামিয়ে দেন জিদান। হিসেবটা সোজা। লো-ব্লক ডিফেন্সে চলে যাও কিন্তু তাই বলে বার্সার দিফেন্সে প্রেস করা বন্ধ করো না। রিয়াল করেওনি।

বার্সেলোনার মতন দলের সাথে নিজের বেঞ্চের চারজনকে নামিয়ে খেলা শেষ করার দু:সাহস দেখিয়েছেন। লাল কার্ড দেখে ১০ জনের দলে পরিণত হয়ে ম্যাচ জিতিয়ে আলফ্রেডো ডি স্তেফানো স্টেডিয়াম ছেড়েছেন বীরের বেশে। ২০০৭-০৮ মৌসুমের পর এই প্রথম এই মৌসুমের দুই এল ক্লাসিকোতেই জয় তুলে নিল রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়াল ইতিহাসের প্রথম কোচ হিসেবে জিতেছেন টানা তিন এল ক্লাসিকো!

৩-৫-২, ৪-৩-৩, ৪-৪-২; ফুটবল সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আইডিয়া থাকলেই সকলে জানে, এই তিন ফরমেশনে এক দলকে খেলাতে কি পরিমাণ হ্যাপা পোহাতে হয় দলের কোচকে। কী পরিমাণ স্কোয়াড ডেপথ থাকতে হয় একটা দলের। অথচ গত তিন ম্যাচে সম্পূর্ণ তিন ফরমেশনে রিয়ালকে সাজিয়ে ঠিকই জয় বের করে এনেছেন জিদান।

অথচ দলের মূল তিন ডিফেন্ডার এখনও সাইডবেঞ্চে, চোট আর কোভিডের তাড়ায়। মৌসুমে ৫২ ইনজুরি নিয়েও বহাল তবিয়তে টিকে আছেন চ্যাম্পিয়নস লিগে, টাইটেল রেসে প্রথম। এরপরও যদি ট্যাক্টিক্যাল জিনিয়াস হিসেবে জিনেদিন জিদানের নাম বাকি সকলের কাতারে না উঠে, তবে তা আফসোস ছাড়া আর কিছুই নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link