২০০৮ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের প্রাক্কালে এক সাংবাদিক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ফাইনালে উঠে আপনার কেমন অনুভূতি হচ্ছে?’
প্রত্যুত্তরে দারুণ একটি কথা বলেছিলেন বর্ষীয়ান কোচ, ‘এই সময়ে এসে আমার তুলনা আমি নিজেই।’
সমালোচকরা তখন ওনাকে তীক্ষ্ণ কথার বাণে বিদ্ধ করেছিলেন। আর কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তার হয়ে জবাব দিয়েছিল তাঁর দলের জয়।
আসলে হয়তো জিনিয়াসরা এরকমই হন। পদে পদে থাকে অহংবোধ, নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার জেদ, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নিজের স্বত্তা প্রতিষ্ঠিত করা কিংবা কখনও বা স্বেচ্ছামৃত্যু।
জন্ম আলজেরিয়ায় হলেও জীবনের প্রতিটি ‘ফুট’ এবং ‘বল’ – দুটি কথা বলেছে ফ্রান্স এর হয়ে। জিতেছেন ফুটবলের শ্রেষ্ঠ মহারণ – বিশ্বকাপ। একদিকে, যেমন গোটা দেশ জুড়ে বন্দিত হয়েছেন আবার ২০০৬ এর পর থেকে নিন্দিত কম হন নি। নেপথ্যে সেই বিশ্ব ফাইনালের বিখ্যাত ‘ঢুঁস’। এর আগে মাতেরাজ্জি নিজের দেশের হয়ে ততটা সমর্থন ও পাননি যতটা সেই ঘটনার পর থেকে সহানুভূতি পেয়েছিলেন। এক কথায় ‘জিদানের ঢুঁস’ তাকে বিশ্ব ফুটবলের লাইমলাইটে এনে দিয়েছিল।
ক্লাব ক্যারিয়ারে জীবনের শেষ পাঁচটি বসন্ত কাটিয়েছেন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। জিতেছেন লা লিগা থেকে শুরু করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। উপহার স্বরূপ ক্লাবের অল টাইম একাদশে জায়গা ও পেয়েছেন।
কথায় আছে না, মানুষ ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে যেখানে সেটির সন্ধান পায় সেখানেই নিজের অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করে দেয়। এনার ক্ষেত্রে ও বোধহয় একই কথা প্রযোজ্য। গোটা ফুটবল ক্যারিয়ারের ‘কোহিনুর’ টা হয়তো এখানেই খুঁজে পেয়েছিলেন।
হয়তো সেই কারণেই ২০১০ সালে হোসে মরিনহোর এক কথায় তিনি রিয়াল মাদ্রিদের ‘Special Adviser’-এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এরপর একে একে স্পোর্টিং ডিরেক্টর, সহকারী কোচ, রিয়াল মাদ্রিদ ‘বি’ দলের হেড কোচ হয়ে মূল দলের ব্যাটন হাতে আসল ২০১৬ সালের শুরুতে।
ফুটবল ক্যারিয়ারের মতো কোচিং ক্যারিয়ারটাও শুরু করলেন ‘With A Bang’. প্রথম ম্যাচেই পাঁচ গোল দিয়ে শুরু হল কোচ জিজুর পথ চলা। কোচিং জীবনের প্রথম ‘এল ক্ল্যাসিকো’ জিতলেন কাতালানদের মাঠে, ৩৯ ম্যাচ জয়ের বিজয়রথ থামিয়ে দিয়ে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও জিতলেন প্রথম বছর আরেক মাদ্রিদের ক্লাবকে হারিয়ে।
২০১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সবাইকে হতবাক করে জানিয়ে দিলেন ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’র কথা। এর মধ্যেই ক্লাবকে দিয়েছেন প্রায় সব ট্রফি। থামলেন তিন বছরের মাথায়। ক্লাবের উন্নতি, পরিবর্তনের কথা ভেবে স্বেচ্ছায় সরে গেলেন অন্তরালে।
এরপর মাদ্রিদ জুড়ে শুধুই অন্ধকার। নেই সেই অর্থে কোনো ট্রফি। এর সাথে সেরা তারকার বিদায়। লোপেতগুই কিংবা সোলারি, সেই সাফল্যের ধারে কাছে আসতে পারলেন না কেউ। অবশেষে ডাক পড়ল সেই ফরাসি ভদ্রলোকের।
বিখ্যাত লেখক আর্থার কোনান ডয়েল তার সৃষ্ট ‘শার্লক হোমস’ চরিত্রটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু পাঠকদের প্রবল রোষে লেখক আবার তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। পাঠকের চোখে যেমন চরিত্র অমর ঠিক তেমনই মাদ্রিদ সমর্থকদের কাছে ‘জিনেদিন জিদান’ এক জাদুকাঠির অপর নাম।
স্বেচ্ছামৃত্যু কে পাশ কাটিয়ে, সমর্থকদের ভালোবাসার বন্যায় ভেসে গিয়ে আবার তিনি পা রাখলেন সেই সবুজ গালিচায়। যেখানে তিনি খেলোয়াড় ও ম্যানেজার হয়ে অসংখ্য ট্রফি জিতেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি এবার সত্যিই প্রতিকূল। লা লিগায় পয়েন্টে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব এগিয়ে আছে। এদিকে খেলোয়াড়দের মনোবল ও তলানিতে।
ঠিক এখানেই শুরু হল কোচ জিজুর ম্যাজিক। আলাদা ভাবে কথা বললেন প্রতিটি ফুটবলারের সাথে। বিশ্বাস জোগালেন যে এখনও লিগ জয় সম্ভব। রামোস কে দিলেন লিডারের দায়িত্ব। সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন হার না মানা মানসিকতা।
ব্যস, শুরু হল রিয়ালের বিজয় রথ। শেষ ল্যাপে প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন অন্তিম স্টেশনের দিকে। মার্চ মাসে যে লিগকে ছোঁয়া অসম্ভব মন হয়েছিল, জুলাইতে এসে সেই ট্রফি মাদ্রিদের ট্রফি ক্যাবিনেটে শোভা পাবে! কেউ ভেবেছিল? অতি বড় মাদ্রিদ সমর্থক ও হয়তো ভাবতে পারেনি। কিন্তু একজন ভেবেছিলেন এবং সেই ভাবনাটা পুরো দলে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
একটা কথা ফুটবল মহলে প্রচলিত আছে, সব সময় ভালো ফুটবলার কখনো ভালো কোচ হতে পারে না। কিন্তু যদি না তার নাম হয় জিনেদিন জিদান। যেমন খেলোয়াড় জীবনে মাঝমাঠ সামলেছেন অনায়াসে ঠিক তেমনি কোচিং জীবনে তুখোড় মস্তিষ্ক পিছনে ফেলে দিয়েছে অনেক তাবড় কোচকে।
এই ভূখণ্ডে অনেক জিনিসের কোনো তুলনা হয় না অথবা বলা যায় সেই জিনিসের তুলনা সে নিজেই। তেমনি ফুটবলার জীবনে ওনার তুলনা উনি নিজেই ছিলেন। আর কোচিং জীবনেও হয়তো সেই দিন আসতে চলেছে যখন কোচ জিদানের তুলনা হবে জিদানের সাথেই।
শুধু বেঁচে থাকবে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার বাসনা। নিজে কাতালানদের সমর্থক এবং প্রবল মাদ্রিদ বিরোধী হয়েও এই মানুষটির উপর প্রচুর শ্রদ্ধা। যা স্বীকার করতে কোনো কুণ্ঠাবোধ নেই।