বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে সেরা দ্বিপক্ষীয় সিরিজ কোনটা?
এই প্রশ্ন আসলে অনেকেই দেশের মাটিতে ভারত, পাকিস্তান কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের কথা বলবেন। কেউ হয়তো বলবেন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ‘বাংলাওয়াশ’-এর কথা। তবে, আমি একটু ভিন্ন মতামত দেই।
আসলে, এসব আলোচনায় বাংলাদেশের জয়ের স্মৃতিগুলোই বেশি আসে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইগুলো আড়ালেই থেকে যায়।
ঠিক তেমনই একটা সিরিজ হল ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের মাটিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে খেলা পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। সিরিজটা অনেক কারণেই স্মরণীয়। সিরিজটিতে অভিষেক হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টার বয় সাকিব আল হাসানের। ওয়ানডে অভিষেক হয় মুশফিকুর রহিমেরও।
এছাড়া, একসময়ের ভবিষ্যৎ তারকা মনে করা ফরহাদ রেজারও অভিষেক হয় এই সিরিজে। এসব ছাড়াও আরো অনেক অর্জন আছে এই সিরিজে বাংলাদেশ দলের। তবে দুঃখের বিষয় সিরিজটি ৩-২ ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ।
এই সিরিজ হারাতে হত না যদি তৃতীয় ম্যাচটি বাংলাদেশ জিততে পারত। জিততে পারত বলার কারণ হল, ঐ ম্যাচে জয়ের খুব কাছে গিয়ে হেরে যায় বাংলাদেশ দল।
দিনটা ছিল দুই আগস্ট। সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডে এবং ওয়ানডে ইতিহাসের ২৩৯৪ তম ম্যাচে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ে। নিয়মিত অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের জ্বরের কারণে অধিনায়কের দায়িত্ব পান খালেদ মাসুদ পাইলট। তবে টস ভাগ্যে হেরে যান জিম্বাবুয়ের তরুণ অধিনায়ক প্রসপর উৎসেয়ার কাছে।
প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে ৪৯ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ দল করে ২৩৬ রান। রাজিন সালেহ ৯০ বলে করেন ৫৪ রান। আর মাত্র ৩৯ বলে ৫৩ রান করেন আফতাব আহমেদ।
সামনে যাওয়ার আগে আফতাবকে নিয়ে কিছু বলতে চাই। তার ক্যারিয়ার নষ্ট হবার পিছনে ‘তাঁর গাফলতি না বিসিবির অবহেলা দায়ী? – সেই পুরনো বিতর্কের জল ঘোলা করতে চাই না। কিন্তু এটা সত্য যে আফতাব সবসময় আফসোস হয়ে থাকবে। এক্ষেত্রে আশরাফুলের চেয়েও আমি আফতাবের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লম্বা ক্যারিয়ার না হওয়াটা বড় করে দেখব।
যাই হোক ম্যাচে ফিরে যাই। জিম্বাবুয়ের হয়ে অ্যান্থনি আয়ারল্যান্ড আর হ্যামিল্টন মাসাকাদজা নেন তিনটি করে উইকেট। মোহাম্মদ আশরাফুল ৪৬ আর আব্দুর রাজ্জাক শেষের দিকে করেন ২০ রান।
২৩৬ রানের জবাব দিতে নেমে জিম্বাবুয়ে এক পর্যায়ে ৩৮ ওভারে ৪ উইকেটে ১৫০ রান করে ফেলে। তারপর বোলিংয়ে আসেন শাহাদাত হোসেন। তিনি যা করলেন তা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওয়ানডে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দলীয় ১৫১ রানের মাথায় ৩৮.৩ বলে তাফাদজা মুফামবিজি প্যাভিলিয়নের পথ দেখান। তারপরের দুই বলে আউট করেন এলটন চিগুম্বুরা এবং অধিনায়ক উৎসেয়াকে। হ্যাট্রিক করেন শাহাদাত। যা ছিল ওয়ানডে ইতিহাসে বাংলাদেশ দলের সর্বপ্রথম কোন হ্যাটট্রিক। ১৫১ রানে সাত উইকেট নেই জিম্বাবুয়ের, নিশ্চিত জয় দেখছিল বাংলাদেশ।
ওই সময় থেকেই ম্যাচের মোড় ঘুরতে শুরু করে। তাওয়ান্ডা মুপারিয়াকে নিয়ে মেরামতের কাজ সামলে জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন ব্রেন্ডন টেলর। তারপরও খুব কঠিন একট লড়াই ছিল।
শেষ ওভারে জিম্বাবুয়ের দরকার ছিল ৬ বলে ১৭ রান৷ বল করতে আসেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। দ্বিতীয় বলে ছক্কা। তারপর তিন বলে দরকার ছিল ৯ রান। চতুর্থ বলে টেইলর একটা চার মারেন। মানে দুই বলে দরকার পাঁচ রান। পঞ্চম বলে রান আউটের শিকার হন তাওয়ান্ডা। ৩৫ বলে তিন চারে ৩৩ রান করে জিম্বাবুয়েকে ম্যাচে রাখেন তিনি।
শেষ বলে দরকার পাঁচ রান। মানে একটা ছয় মারতে হবে। কাজটি নিশ্চয়ই কঠিন কিন্তু দুঃসাধ্য নয়। কিন্তু কাজটি সহজ হয়ে যায় মাশরাফির ভুলে। ইয়র্কারের সন্ধানে গিয়ে ফুলটস করে বসেন। মিড উইকেটের উপর দিয়ে ছক্কা হয়ে যায়। টেলরের ছক্কায় নিশ্চিত হয় জয়।
হারারেতে বরাবরের মত সেদিনও খুব বেশি দর্শক ছিল না। কিন্তু, যা ছিল তাঁদের আর আর জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটারদের উল্লাস সেদিন আকাশ ছুঁয়েছিল। ৭২ বলে ৭৯ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হন টেলর।
- সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ: ২৩৬ অল আউট,৪৯ ওভার; রাজিন সালেহ ৫৪(৯০), আফতাব ৫৩(৩৯), মাসাকাদজা ৩/৩৯
জিম্বাবুয়ে: ২৩৮/৮, ৫০ ওভার; টেইলর ৭৯(৭২), ডাফিন ৪৮(৮১), শাহাদাত ৩/৫২(১০)
বলা হয়ে থাকে ইতিহাস সবসময় জয়ীরা লেখে। এখানে জয়ী বলতে যদি আমরা শক্তিশালী ক্রিকেট শক্তিদের ধরি। তাহলে কথাটি মিলে যাবে। যে কোন বিচারে ম্যাচটি ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু ম্যাচটি খেলা দুই দল জিম্বাবুয়ে এবং বাংলাদেশ বলে কেউ সেভাবে ম্যাচটি নিয়ে আলোচনা করে না। তখন থেকেই বদ্ধমূল একটা ধারণা জন্মায়, টেলর উইকেটে থাকলে জিম্বাবুয়ের জয়ের সামান্য সম্ভাবনা হলেও থাকে।
সেই ম্যাচের শেষটা নি:সন্দেহে মাশরাফির ক্যারিয়ারের অন্যতম বাজে মুহূর্ত। জার্সি দিয়ে তাঁর মুখ লুকানোর দৃশ্যটা ভুলতে পারি না। এর পর থেকেই ডেথ ওভারে বোলিং করায় অনিয়মিত হয়ে যান মাশরাফি। আবার তিনি এই জায়গাটা নিয়ে অনেক কাজ করে বেশ কিছু উন্নতিও আনেন।