নয় নয় করে ২২ তম বিশ্বকাপের দামামা বেজে গেল মরুদেশে। আগেরবার তো অসাধারণ খেলে ৪-২ গোলে ক্রোয়েশিয়াকে পরাস্ত করে দ্বিতীয়বারের মত ফ্রান্স জিতে নিল বিশ্বসেরার শিরোপা। এবারেও বহু টিম ফেভারিট হিসেবেই মরুদেশে পা রেখেছে। বিশ্বকাপ ফুটবল, এ এক জমকালো আসর বটে। সারা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশই যোগ্যতা অর্জন পর্বে লড়াই করে, শেষমেষ কপালে শিকে ছেঁড়ে সেরা ৩২টি দেশের। এবার তাদের মধ্যে লড়াই। যো জিতা, ওহি সিকান্দার!
কথাটা সেখানে নয়। এই আসরের মধ্যেও যে কিছু হট ফেভারিট কেকের বন্দোবস্ত রয়েছে। নায়কের অরিন্দমের কথাই যেন বারংবার ঘুরেফিরে আসে ফুটবলের অন্দরমহলে। ‘আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ!’ – প্রত্যেকটা টিমের ড্রেসিংরুমে ঢুকে কান পাতলেই এইরকম নাগাড়ার মত ধ্বনি ভেসে আসবে। সে ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া, ওশিয়ানিয়া – মহাদেশটা ম্যাটার করে না।
কিন্তু, এর মধ্যেও সেই কলকাতা ময়দানের মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের মতোই বাকযুদ্ধ, কথার ফুলঝুরিতে একে অপরকে টপকে যাওয়ার অশেষ আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। এই সেদিন পর্যন্তও উত্তর কলকাতার রাজবল্লভ পাড়ায় নেইমারের গোল পাওয়ার জন্য বল রেখে পুজো করতে দেখা গেছে! কোন কোন পাড়াতে আবার আকাশের রঙয়ের সাথে পাড়ার রঙও নীল-সাদা, মানে আর্জেন্টিনা টিমের জার্সির রঙ আর কি!
সেই পেলে-গ্যারিঞ্চা আর দিস্তেফানো-ম্যারাডোনা দিয়ে শুরু, এখনো সে জয়ধ্বজা জারি রয়েছে নেইমার আর মেসির পায়ে পায়ে। আমবাঙালির কাছে এখনো প্রিয় ফুটবলারের নাম মারাদোনা, যিনি সেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একাই পাঁচ-ছ’জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল করে এক মোহজালে বিঁধেছেন বাঙালিকে।
আর পেলে স্বয়ং বাংলার মাঠে মোহনবাগানের সাথে খেলে গেছেন। সুব্রত ভট্টাচার্য এবং প্রদীপ চৌধুরির সার্থক ডিফেন্স এবং শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনবদ্য গোলকিপিংয়ে পেলের কসমস ক্লাবের সাথে ২-২ ড্র করে মোহনবাগান, এই যুদ্ধজয়ের গল্প বাঙালি নিজচোখে প্রত্যক্ষ করেছে!
তারপর মেসি জমানা, ২০১০। ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে খেলতে নামা মেসিময় কলকাতার সন্ধ্যায়, অস্ত যাওয়া পশ্চিমী সূর্যের অমল আলোয় উদ্ভাসিত যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সেদিন উড়েছিল শুধুই নীল-সাদা পতাকা। ভারতবর্ষের বাংলা প্রদেশ যেন সেদিন এক টুকরো আর্জেন্টিনা!
তাহলে কি বাঙালির ফুটবল মোহ নিয়েই এ কাহিনীর উত্থাপন? একেবারেই না। আসলে, ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার ফুটবল রেষারেষি যে সূদূর বাংলাতেও কতটা উজ্জ্বল, তা বোঝাতেই উপরের প্রসঙ্গ টেনে আনা। এই দুই দলের কথা উঠলেই মনে একটাই শব্দ ভেসে ওঠে, যার নাম ফুটবল!
তাহলে মোদ্দা কথা কি দাঁড়ালো? বিশ্বকাপ ফুটবলের আজও পর্যন্ত একটাই হট-ফেভারিট ম্যাচের আশায় বুক বেঁধে থাকে সুমাত্রা টু সুমেরু। ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা। সে যতই হল্যান্ডে(নেদারল্যান্ডস) একটা রুড গুলিট, জোহান ক্রুয়েফ বা মার্কো ভ্যান বাস্তেন থাকুন, জার্মানিতে বেকেনবাওয়ার, লোথার ম্যাথাউস হয়ে মাইকেল বালাক, বাস্তিয়ান শোয়েইনস্টাইগার বা আজকের টমাস মুলার বা টনি ক্রুজ, ম্যানুয়েল নয়্যার থাকুন, ফ্রান্সের একটা জিদান, মিশেল প্লাতিনি থাকুন, ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার, ববি চার্লটন হয়ে আজকের ওয়েন রুনি, বেকহ্যাম বা স্টিভেন জেরার্ড থাকুন কিংবা পর্তুগালের ইউসেবিও হয়ে এক লুইস ফিগো বা এইমূহূর্তে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো থাকুন।
যতই বেলজিয়াম, সুইডেন, নাইজেরিয়া, ঘানা, উরুগুয়ে সহ আরো আরো দেশ থাকুক এ বিশ্বমঞ্চে, তবু পৃথিবীর সাতটা মহাদেশ মিলিয়েও এ ম্যাচের বাতাবরণ কেউ পাল্টাতে পারবে না। মানতেই হবে, বিশ্ব ফুটবলের আসরে আজও আক্ষরিক অর্থেই একমাত্র অবিসংবাদী হট টপিক ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার ফুটবল ম্যাচ।
ইংরাজিতে একটা কথা আছে, ‘My game is fair play’। আমার খেলা ন্যায্য খেলা, ফুটবলের পরিভাষায় বললে সঠিক আইন মেনে, অন্যায় সুবিধা বা অন্যায় ঘটনা না ঘটিয়ে খেলাটার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। যে কারণেই প্রতিবছর ফিফা বিশ্বকাপের আসরে একটি টিমকে ফেয়ার প্লে সম্মানে ভূষিত করে, যে টিম হারা জেতার ঊর্ধে উঠে ফুটবলটাকে জিতিয়েছে গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে, ট্রফিটা সেই টিমকেই দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ থেকে এই সম্মান প্রদান শুরু। ২০১৮ সালে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলার জন্য এই অ্যাওয়ার্ড যেমন স্পেন পায়।
এই ফেয়ার প্লে সম্মানের প্রসঙ্গ উত্থাপন করার কারণ? কারণ একটাই। বিশ্বের ফুটবলের দরবারে, অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই ফুটবল টিম ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার ফুটবলযুদ্ধে এমন এক কাণ্ড ঘটেছিল, যা ফুটবলের পরিভাষায় রীতিমতো ‘আনফেয়ার’। ফিফার উদ্যোগকে হেলায় তছনছ করে দেওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে এটি সম্ভবত একনম্বরে থাকবে। সেই ১৯৩০ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলের আসরে যতগুলো বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিতর্ক হোলি ওয়াটার কেলেঙ্কারি। যা বিশ্ব ফুটবলের দরবারকে এক লহমায় কালিমালিপ্ত করে দেয়।
সোজাসুজি ঘটনাতেই আসা যাক। ১৯৯০ সাল, ইতালিতে বসেছে ১৪ তম ফুটবল বিশ্বকাপের আসর। তারই রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচে মুখোমুখি এই দুই শ্রেষ্ঠ দল। তুলনামূলক ভাবে ব্রাজিল এ ম্যাচে ফেভারিট হিসেবেই নেমেছিল। প্রথমত তাদের হাতে ভালো দল ছিল। ব্র্যাঙ্কো, দুঙ্গা, আলেমাও, জর্জিনহো, মাজিনহো বেশ ভালো ফর্মে ছিলেন। কোচ সেবাস্তিও লাজারনির অধীনে থাকা এই ব্রাজিল দল ছিল তুল্যমূল্য ভাবে বেশ গোছানো।
তাছাড়া ১৯৮২ এর সেই জিকো-সক্রেটিস সমৃদ্ধ ব্রাজিল দল নিয়েও বিশ্বকাপ জিততে না পারার একটা খেদ কাজ করছিলোই। সব মিলিয়ে সে বিশ্বকাপে দারুণভাবে শুরু করে ব্রাজিল। তাদের গ্রুপে ছিল কোস্টারিকা, স্কটল্যান্ড এবং সুইডেন। যদিও সেই বিখ্যাত সাম্বা ম্যাজিক দেখা যায়নি সেভাবে, তবুও প্রতিটা দলকে হারিয়ে, সব ম্যাচ জিতেই শেষ ষোলোয় পৌঁছে যায় ধারেভারে এগিয়ে থাকা ব্রাজিল।।
অন্যদিকে আর্জেন্টিনা ছিল সে বিশ্বকাপে একেবারেই নিষ্প্রভ। তাদের না ছিল ফর্ম, না ছিল ভালো দল। তার একটা কারণ, আগের মেক্সিকো বিশ্বকাপে ডিয়েগো ম্যারাডোনা একার হাতে বিশ্বকাপ জেতালেও, সে টিমেল অনেকেই ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে ছিলেন না। যেমন ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার পাসারেল্লা ছিলেন না। গায়কোচিও এবং বুরুচাগা একেবারেই ফর্ম খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফলত ইতালি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ক্যামেরুনের কাছে হারের মুখ দেখে আর্জেন্টিনা!
এরপর রোমানিয়ার সাথে ড্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জিতে গ্রুপে তৃতীয় হয়ে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে পৌঁছতে সক্ষম হয় তারা। কোচ কার্লোস বিলার্দোর চিন্তার ভাঁজের রেখা বেড়ে চললেও আর্জেন্টিনার পারফরমেন্সের কোন উন্নতিই চোখে পড়ছিল না সে বিশ্বকাপে। বলতে গেলে প্রধানত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই নীল-সাদা জার্সিধারীরা শেষ ষোলোয় স্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
তবে, কোন দল দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছে আর কোন দল নেই, সেসব হিসেবের খাতা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মত হট ফেভারিট ম্যাচে কার্যত বন্ধই থাকে। আর নকআউটের মত মঞ্চে যখন যা খুশি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত, যেহেতু খেলাটার নাম ফুটবল। সমস্ত হিসেবনিকেশ পরের ৯০ মিনিটে পুরো উল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে যে খেলা, সে কারণেই তো সব খেলার সেরা ফুটবল খেলা!
যাই হোক, তুরিনে শেষ আটের লড়াইয়ে সেবার মুখোমুখি ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। শুরু থেকেই একটু ডিফেন্সিভ খেলার প্রবণতা আর্জেন্টিনার, কারণ এমনিতেই এত চাপের ম্যাচে দলগত কারণে তারা পিছিয়ে। ছকটা ছিল, ডিফেন্স গুছিয়ে সেন্ট্রাল মিড থেকে আক্রমণ তুলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা, এবং সে প্ল্যানকে প্রায় মোটামুটি গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন সেলেকাও স্ট্রাইকার কারেকা।
একটা দুর্দান্ত সোলো রানে অ্যাটাক তুলে গোলের মুখ খুললেও সেটাকে গোলে পরিণত করতে পারলেন না। পরের পর কার্যত আক্রমণের ঢেউ তুলছিল ব্রাজিল, কিন্তু মোক্ষম কাজটি কিছুতেই করে উঠতে পারছিল না। ইতিমধ্যে একটা শট পোস্টে লেগেও ফিরে এল! সেদিন মাঠে উপস্থিত থাকা ব্রাজিল সমর্থকরা ভাগ্যকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিলেন না। এত আক্রমণেও সেলেকাওরা যখন একবারও বল জালে জড়াতে পারছিল না, তখন সত্যিই মনে হচ্ছিল সেদিন ভাগ্য ব্রাজিলের সাথে নেই!
অন্যদিকে অসংখ্য আক্রমণে ছারখার হয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনা নিজেরাও আক্রমণ তুলতে পারছিল না, কারণ তাদের তুরুপের তাস ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা তখন এক ব্রাজিলিয়ান লেফটব্যাক ব্র্যাঙ্কোর মার্কে বন্দীদশায়। ব্র্যাঙ্কোর কড়া ট্যাকলকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে না পারা ম্যারাডোনা সেদিন নিজের খেলাতেই ঠিক করে মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না, সর্বক্ষণ বাজপাখির মত ব্র্যাঙ্কো ম্যারাডোনাকে মার্ক করে রেখেছিলেন। কখনো বামপ্রান্ত, কখনো মাঝখান দিয়ে দু’তিনজন ব্রাজিল প্লেয়ারকে টেনে নিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করলেও বারবার ধরা পড়া যাচ্ছিলেন সেই ব্র্যাঙ্কোর কাছে।
কিন্তু ঐ, সব ভালো যার শেষ ভালো। দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরুর কিছুক্ষণ পর আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার পেদ্রো ত্রগ্লিও চোট পান, ফলে খেলাও অনেকক্ষণ বন্ধ থাকে। আর্জেন্টিনা দলের ফিজিও ছুটে আসেন, শুশ্রুষার পর ফের খেলা শুরু হয়।
চমক ঘটল এইখানে। যে ব্র্যাঙ্কোকে কার্যত অপ্রতিরোধ্য লাগছিল সেদিন, খেলা শুরুর পর থেকেই মনে হচ্ছিল ব্র্যাঙ্কো ঠিক যেন আগের ব্র্যাঙ্কো নেই, কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে! এতক্ষণের সেই চনমনে ভাবটা কেমন যেন ভোজবাজির মতন উধাও। ফলে মাঝেমধ্যেই খেলা থেকে হারিয়ে যান ব্র্যাঙ্কো, আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহারই করে ফেলেন ম্যারাডোনা।
ডিফেন্সিভ মিড থেকে উঠে আসা বলটা নিয়ে ব্র্যাঙ্কো সমেত দু-তিনজন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বেরোতে যান ডান দিক দিয়ে, চকিতে দেখে নেন বাঁদিক থেকে উঠে আসছেন স্ট্রাইকার ক্লদিও ক্যানিজিয়া। এদিকে সব ডিফেন্ডাররাই ম্যারাডোনাকে সামলাতে ব্যস্ত, ফলে বাঁদিকে ক্যানিজিয়া সম্পূর্ণ একা। তাই ম্যারাডোনা অসাধারণ থ্রুতে বল ঠেলে দিলেন বাঁদিকে। সে বলটা ধরে ব্রাজিলের গোলরক্ষক তাফারেলকে কাটিয়ে বলটা জালে জড়িয়ে দিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড ক্লদিও ক্যানিজিয়া!
ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই। ম্যারাডোনার অসাধারণ অ্যাসিস্টকে কাজে লাগিয়ে গোলটা করে যখন ক্যানিজিয়া সমেত গোটা আর্জেন্টিনা টিম কর্নারের দিকে সেলিব্রেশনে মত্ত, তখন ব্র্যাঙ্কোকে দেখা যায় সতীর্থদের উত্তেজিত হয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছেন! এদিকে কড়া ফাউল করায় ম্যাচের ৮৫ মিনিটের মাথায় লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়ে চলে যান ব্রাজিল অধিনায়ক রিকোর্ডো গোমেজ। পুরো খেলায় তুমুল দাপট দেখানো ব্রাজিলকে একটা কাউন্টার অ্যাটাকেই ধরাশায়ী করে শেষ পর্যন্ত সে ম্যাচটা ১-০ গোলেই জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় আর্জেন্টিনা, সঙ্গে শেষ হয়ে যায় সেবছরের মত ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জেতার সোনালী স্বপ্ন!
চিত্রনাট্যে টুইস্টের আরো অনেক কিছু তখন বাকি! ম্যাচ শেষ হলো ম্যাচের নিয়মে । কিন্তু ম্যাচ শেষে বোমাবর্ষণ করলেন ব্র্যাঙ্কো। রীতিমতো দাবী করলেন, দ্বিতীয়ার্ধে পেদ্রো ত্রগ্লিওর চোটের জন্য যখন খেলা বন্ধ ছিল, তখন ব্র্যাঙ্কো শুশ্রূষা করতে আসা আর্জেন্টাইন ফিজিও মিগুয়েল দি লরেঞ্জোর কাছ থেকে জল চেয়ে খেয়েছিলেন। এবং তারপর থেকেই তাঁর ঐ ঝিমুনিভাবের শুরু!
ঘটনা হচ্ছে, ব্র্যাঙ্কো সত্যিই জল চেয়ে খেয়েছিলেন আর্জেন্টাইন ফিজিওর কাছ থেকে। কিন্তু তাতে কি প্রমাণ হয় যে ঐ কারণেই ব্র্যাঙ্কো অসুস্থ বোধ করছিলেন? হয় না। ফলত, যা হওয়ার তাই হল। আর্জেন্টিনা মিডিয়া এ অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। অপ্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে আর্জেন্টাইন ফিজিওকে বিদ্ধ করার জন্য আর্জেন্টিনা মিডিয়া এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাল। ফলে জ্বলে ওঠা আগুন ছাইচাপা হয়েই পড়ে থাকল!
আবার সে ছাইচাপা আগুন দুম করে জ্বলে উঠল ২০০৫ সালে। আর্জেন্টিনার এক টিভি চ্যানেলের টক শোতে আমন্ত্রিত ছিলেন ফুটবল ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সেখানেই ফাটালেন বোমাটা! সর্বসমক্ষে স্বীকার করলেন, সেদিনের খেলার মাঝে ব্র্যাঙ্কো যে জলটা পান করেছিলেন, তাতে সত্যিই ট্র্যাঙ্কুলাইজার মেশানো ছিল! সেটা খাওয়ার পরেই ব্র্যাঙ্কোর ঝিমুনি আসে এবং তারপর থেকেই ম্যাচ থেকে হারিয়ে যান ব্র্যাঙ্কো!
ব্যস্! আর যায় কোথায়! সারা দুনিয়ার সাংবাদিক মহল নড়েচড়ে বসল। ইতোমধ্যে সে ম্যাচের সমস্ত ফুটবলারই অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু সাংবাদিকদের লক্ষ্য ফুটবলাররা ছিলেন না, ছিলেন তৎকালীন আর্জেন্টাইন কোচ কার্লোস বিলার্দো। তাঁকে পাকড়াও করে সাংবাদিকগণ, তিনি হেঁয়ালি করেন তখন। বলেন যে তিনি কিছুই জানেন না সে ব্যাপারে, কিন্তু ঘটনাটা ঘটা আশ্চর্য নয়! বেশ বোঝা যায় তিনি ঘটনার মধ্যে অনেক কিছুই সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন। তারপ অবশ্য বিলোর্দো সমস্ত ঘটনাই অস্বীকার করলেন, এটা যে নিছক মিডিয়ার বানানো গল্প সে মন্তব্য করতেও কসুর করলেন না। কিন্তু দাবানল কি অত সহজেই মেটে!
সাংবাদিকদের এর পরের লক্ষ্য সেই সময়ের আর্জেন্টিনা দলের ফিজিও মিগুয়েল দি লরেঞ্জো। তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনিও জানান এটা নিছক ছেলেভুলানো গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। পুরো ঘটনাই সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন লরেঞ্জো।
কিন্তু এদিকে সেলেসাও সংসারেও আগুনের ধোঁয়া গিয়ে পৌঁছেছে! সেদিনকার মূল ভিকটিম ব্র্যাঙ্কো হুঙ্কার ছাড়লেন। আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনকে আদালতে দাঁড় করানোর পক্ষে জোর সওয়াল করেন ব্র্যাঙ্কো। চুপ করে বসে ছিলেন না অন্যরাও। বেবেতো দাবী করেন তৎকালীন আর্জেন্টাইন ফিজিও লরেঞ্জো তাঁর কাছে এ ঘটনার সত্যতার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।
‘লরেঞ্জো যদি এ ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করেন, তবে তিনি আমার কাছে এ ধরনের অভিযোগ স্বীকার করার সঙ্গে তিনি মিথ্যাও বলেছিলেন’ – বেবেতো এই মন্তব্য আরও সাড়া ফেলে দেয় সাংবাদিক মহলে। তবে সবচেয়ে বেশি তেড়েফুঁড়ে ওঠেন সেসময়ের ব্রাজিল কোচ লাজারোনি। ‘এটা খেলাধুলোর অংশ হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণই একটি নোংরা খেলা। চোদ্দো বছর আগে হোক, কি চোদ্দো দিন আগে হোক, ফিফার উচিত এ ধরনের কর্মে লিপ্ত থাকা অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া। কে বলতে পারে, আর্জেন্টিনা অন্য দলের সঙ্গেও একইরকম খেলা খেলেনি বা খেলবে না?’ – জ্বলন্ত মন্তব্য রাখেন লাজারনি!
এত কিছুর পরেও ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন আনুষ্ঠানিক ভাবে ফিফার কাছে অভিযোগ দায়ের করেনি। কারণ, যাই হয়ে যাক, ব্রাজিলের পরাজয় এবং আর্জেন্টিনার জয়ের ফলাফলের তাতে কোন পরিবর্তন হতো না। ঘটনার পর কেটে গেছিল প্রায় ১৪-১৫ বছর। তবে প্রকৃতিদেব বোধহয় সবকিছুর বিচার তুলে রাখেন সময় মতোই। নাহলে ১৯৯০ এর বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যারাডোনার কান্না তো দেখার কথা নয় বিশ্ববাসীর!
জার্মানির পক্ষে যাওয়া পেনাল্টি, যেখান থেকে ফাইনালের একমাত্র গোলটি করেন আন্দ্রেয়াস ব্রেহমে, সেটা যে রেফারির একটি ভুল ডিশিসন, তা আজ সর্বজনবিদিত। অথচ সেই সিদ্ধান্তেই কাঁদতে হল ফুটবল ঈশ্বরকে! এরপর ১৯৯৪ এর আমেরিকা বিশ্বকাপে তো ড্রাগ সেবনের কারণে অভিযুক্ত ম্যারাডোনাকে বিশ্বকাপ মঞ্চেরই বাইরে চলে যেতে হলো, বলা বাহুল্য ফুটবল খেলাটা থেকেই নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন! অথচ সে বিশ্বকাপে দুঙ্গার নেতৃত্বে ইতালিকে হারিয়ে ব্রাজিল জিতে নেয় চতুর্থবারের মতো বিশ্বসেরার খেতাব!
শান্তির ললিতবাণীর প্রচার ফিফা করে আসছে আজও, সেই ১৯৭০ সাল থেকে। এরমধ্যে পৃথিবীর মানচিত্রে কত বদল ঘটে গেছে! অথচ ক্রমাগত ফল্গুধারার ন্যায় বয়ে চলেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের জয়যাত্রা। এই পরিবেশে, এই মঞ্চের আলোয় তাই কখনোই বরদাস্ত করা চলে না এমন নিকৃষ্টতম খেলা, সে যতই প্রকৃতি বিচারসভা বসান।
দিনের শেষে ব্রাজিল – আর্জেন্টিনা নয়, আখেরে ফুটবল জিতল কিনা সেটাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ। ৯০ মিনিটের যুদ্ধ, সেখানে পায়ে পায়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়াই কাম্য, সেটা কখনোই বিরুদ্ধপক্ষকে কৌশলে ঘায়েল করে নয়।
বরং চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের বদলে লড়াই ফিরিয়ে দিতে পারলে, তবেই জমে উঠবে যুদ্ধের ঢক্কানিনাদ। রণকৌশল সাজানোয়, বিপক্ষের ছক ভাঙার খেলাতে কখনোই বিপক্ষকে নিষিদ্ধ বস্তু সেবন করিয়ে দুর্বল করা নয়, যেন সে কৌশলে থাকে বুদ্ধির খেলা। তবেই তো সার্থক রণক্ষেত্র তৈরী হয় দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসা অসংখ্য সমর্থকের চোখের সামনে। তবেই তো সার্থক ফুটবল, সার্থক রণকৌশল। জয়ের আনন্দগান তো সেখানেই মানায়, যেখানে বাকি সবকিছুকে ফিকে করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত জিতে যায় ফুটবল!