২০০৬ সালের বিশ্বকাপ। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে কিছুটা অবাক করেই কিংবদন্তি প্রশিক্ষক হোসে পেকেরম্যান রাইট ব্যাক পজিশনে ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের বছর আঠাশের ডিফেন্ডারকে নামিয়ে দিলেন – লিওনেল স্ক্যালোনি।
সেই ম্যাচেই চুরাশি মিনিটের মাথায় পেক্যারম্যান নামালেন তৎকালীন ফুটবল বিশ্বের টিনএজ সেনসেশনকে – লিওনেল মেসি। সেই স্কালোনিই তার থেকে দশ বছরের ছোট এককালের সতীর্থ মেসির ‘ দ্য লাস্ট ফ্রন্টিয়ার-য়ে নাবিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
এবার দেখে নেওয়া যাক সদ্যসমাপ্ত টুর্নামেন্টের সেরা প্রশিক্ষক স্ক্যালোনির ‘সপ্তবান’ কিভাবে মেসির ক্যারিয়ারের পরম প্রাপ্তিযোগ ঘটালো।
১.
২৯ জুন ২০১৬, বিকেল ৪ টে বেজে ২১ মিনিট। চিলির পাঁচজন ফুটবলার পরিবৃত মেসির ছবি টুইট করে স্কালোনি লিখলেন – ‘এই ছবিটাই সবটা বলে দিচ্ছে … যেও না লিও।’ তখনও স্কালোনি পেশাদার কোচিং জগতে প্রবেশ করেননি। একজন আর্জেন্টাইন, একদা মেসির সতীর্থ হিসাবেই টুইটটা করেছিলেন।
২০১৬ সালের ২৬ জুন টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করে চিলির কাছে উপূর্যপুরী দুটি কোপা আমেরিকা ফাইনাল হেরে জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে ফেলা মেসিকে অবসর ভেঙে ফেরানোর প্রথম ধাপগুলোর অন্যতম এই পদক্ষেপটি।
২.
২০১৭ সালের জুন মাসে হোর্খে সাম্পাওলি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের প্রশিক্ষক নিযুক্ত হয়ে সেভিয়ায় তার সহকারী স্কালোনিকেও জাতীয় দলে তার সহকারী বহাল করলেন।
অবসর ভেঙে ফিরে আসা মেসি বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের বাধা পেরিয়ে আর্জেন্টিনাকে রাশিয়ার বিমানের টিকিট জোগাড় করে দিলেন। কিন্তু, ২০১৮ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স রাউন্ড অব সিক্সটিনের শেষেই সাম্পাওলির আর্জেন্টিনার হাতে রিটার্ন টিকিট ধরিয়ে দিল। সাম্পাওলি পদত্যাগ করলেন। তার সহকারী স্কালোনি অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পেলেন। সাথে রইলেন মেসির কৈশোরের আদর্শ পাবলো আইমার।
বিশ্বকাপ শেষে ভগ্নমনরথ মেসির ভাবনায় জাতীয় দল থেকে অবসরের ভাবনা আবারও উঁকি দিল। ঠিক এমন সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত স্কালোনি মেসিকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করলেন – ‘হাই! লিও, আমি স্কালোনি। আমি আর পাবলো ( আইমার ) তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই … ’
এই কথোপকথনের শেষে মেসি শুধু অবসরের চিন্তাভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন তাইই নয় এমনকি কোপা ও বিশ্বকাপ জেতার জন্য শেষ দেখে ছাড়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলেন।
৩.
আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশন স্কালোনি ও তার কোচিং টিমের চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিল। স্কালোনি দল গঠনে মন দিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ – ২০ মৌসুমে শেষভাগে আর্সেনালের জার্সিতে নজরকাড়া পারফরম্যান্স করা গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে জাতীয় দলের স্থায়ী সদস্য পরিণত করে আর্জেন্টিনার দীর্ঘদিনব্যাপী বিশ্বমানের গোলরক্ষকের সমস্যাটির সুরাহা করলেন।
৪.
২০ নভেম্বর ২০২২। মেসি ও মাঝমাঠের স্তম্ভ রডরিগো ডি পল একসাথে বসে পান করছিলেন। মাঝে মেসি কিছুক্ষণের জন্য বাথরুমে গেলে পরে ডি পল একটি ছোট্ট চিরকুট লিখে মেসির ঘরের ড্রয়ারে রেখে দিলেন, ‘আজ ২০ নভেম্বর। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি যে আমরা চ্যাম্পিয়ন হবো।’
ডি পল ও মেসি কোনোদিন বেস্ট ফ্রেন্ড নন। বরং, আর্জেন্টিনা ফুটবল সার্কিটে মেসির বেস্ট ফ্রেন্ড কে? প্রশ্ন করলে সবার আগে যে নামটা আসবে – সার্জিও আগুয়েরো। কিন্তু, কুন ও মেসি আর্জেন্টিনার বয়সভিত্তিক দল থেকে একসাথে খেললেও জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে ওদের মধ্যে যে বন্ধনটা গড়ে ওঠেনি সেটা গড়ে উঠেছিল ডি পলের সাথে। ডি পল হয়ে উঠলেন – ‘মেসির বডিগার্ড।’
আর, মাঠে ও মাঠের বাইরে ডি পলের মেসির বডিগার্ড হয়ে ওঠার নেপথ্য কারিগর – লিওনেল স্ক্যালোনি।
৫.
মেসির সেই বডিগার্ডই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের ফরাসি প্রশিক্ষক হার্ভে রেনার্ডের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে ধরা পড়ে গেলেন। এর জন্য গত মরশুমে আতলেতিকো মাদ্রিদে ডি পলের নিয়মিত না খেলাও অনেকাংশে দায়ী।
স্ক্যালোনি বুঝে গেলেন এক ডি পলকে মেসির বডিগার্ড বানালে মেসি ফ্রি খেলতে পারবেন না। তাই, পরের ম্যাচ থেকে টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত আলেক্সিস ম্যাকআলিস্টারকে লেফট হাফ হিসাবে খেলালেন। আর, ম্যাকআলিস্টারকে বাঁ দিকের টাচলাইন বরাবর না খেলিয়ে বরং অনেকটা ডানদিকে ঢুকে খেলতে নির্দেশ দিলেন যাতে ম্যাক আলিস্টার মেসির কাছাকাছি থাকতে পারেন অনেকটা বডিগার্ডের মত আর তার ফলে মেসি ফ্রি খেলতে পারেন। কৌশলটা প্রতিটা ম্যাচে কাজে দিল। ফলে, টুর্নামেন্টের বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেসি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠলেন।
৬.
ফাইনালে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের মুখোমুখি হওয়ার আগে পর্যন্ত আর্জেন্টিনা সবথেকে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের।
কিংবদন্তি প্রশিক্ষক লুই ফান হালের তিন ডিফেন্ডারে খেলে মাঝমাঠে লোক বাড়িয়ে ম্যাচের দখল নেওয়ার কৌশলকে ব্যর্থ করতে স্কালোনি নিজেও তিন ডিফেন্ডারে খেললেন। ফলে, ফান হালের নেদারল্যান্ডস মাঝমাঠে নাম্বার অ্যাডভান্টেজ পেলো না। ডাচরা ওখানেই ম্যাচটা অর্ধেক হেরে বসলেন।
৭.
ফ্রান্সের দুই বিশ্বমানের উইঙ্গার যথাক্রমে বামদিকের কিলিয়ান এমবাপ্পে ও ডানদিকের উসমানে ডেম্বেলে নীচে নামেন না এবং তাদের ডিফেন্সিভ স্কিলও দুর্বল। তাছাড়া, ফ্রান্সের লেফট ব্যাক থিও হার্নান্দেজ আক্রমণে যতটা স্বচ্ছন্দ রক্ষণে ততটা নন।
এগুলো মাথায় রেখে স্ক্যালোনি ফাইনালে বর্ষীয়ান উইঙ্গার ডি মারিয়াকে লেফট উইংয়ে খেলিয়ে দিলেন। ফলে, এক প্রান্তে মেসি আরেক প্রান্তে ডি মারিয়া মিলে এমন আক্রমণের ঝড় তুললেন যে ম্যাচের সত্তর মিনিট পর্যন্ত গতবারের চ্যাম্পিয়নদের অস্তিত্ব মাঠে খুঁজেই পাওয়া গেল না।
স্কালোনির ‘সপ্তবান’ আর্জেন্টিনাকে সাফল্য এনে দিয়েছে। কিন্তু, স্ক্যালোনির সাফল্যের পিছনে রহস্যটা কি ?
চাপ, পরাজয়, জয়, সাফল্য এবং এমনকি বিশ্বজয়ের মঞ্চে বিশ্বজয়ী হিসাবে প্রথমবার মহার্ঘ্য কাপটিকে ছুঁয়ে দেখার মধ্যেও যে নির্লিপ্ততা বজায় রাখলেন সেটাই দীর্ঘ ছত্রিশ বছরের খরা কাটিয়ে আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের নায়ক লিওনেল মেসির পাশাপাশি নেপথ্য নায়কে পরিণত করলো আরেক লিওনেলকে – লিওনেল স্ক্যালোনি।