সাল ১৯৮৬; ৩১ মার্চ।
কলম্বো শহরের মোরাতুয়ার তাইরোনে ফার্নান্দো ক্রিকেট স্টেডিয়াম। উপস্থিত হাজার দুয়েক দর্শক।
টস হয়ে গেছে। একটু বিচিত্র ধরণের টস। দুই অধিনায়ক আলাপ করে উইকেটের কাছে না গিয়ে ড্রেসিংরুমের সামনে দাড়িয়ে টস করে ফেলেছেন। পাকিস্তান আগে ফিল্ডিং করছে।
ফিল্ডিং সাজিয়ে নিলেন অধিনায়ক। দুই ওপেনার এসে গেছেন উইকেটে। আম্পায়ার আরেকবার চারপাশটা দেখে নিলেন। এক প্রান্ত থেকে ছুটে এলেন ইমরান খান। গুড লেন্থে পড়া বলটা আলতো করে ডিফেন্স করলেন রকিবুল হাসান। সাথে সাথে তৈরি হয়ে গেলো ইতিহাস।
আইসিসি স্বীকৃত আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের প্রথম বলটা খেলে ফেললো বাংলাদেশ দল। একদিনের আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশের। আরও অনেক ইতিহাসের মতো এই ইতিহাসেও নাম লেখালেন রকিবুল হাসান। ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলটা মোকাবেলা করলেন তিনি।
আজকের ম্যাচ রেফারি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রথম বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক রকিবুল হাসান কথা বলতে বলতে সেই দিনটায় ফিরে গিয়েছিলেন। বলছিলেন, ‘এটা তো আমাদের জন্য গর্বের একটা দিন। প্রথম ওডিআই খেললাম। আমি ভাগ্যবান যে, প্রথম বলটা খেলেছিলাম। আমি এই এশিয়া কাপের আগেই অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। তারপরও বোর্ড কর্মকর্তারা অনুরোধ করে এশিয়া কাপ খেলতে বলেছিলেন। তাই ভাগ্যই আমাকে এই ইতিহাসের সঙ্গী করেছে।’
সেই এশিয়া কাপটা একটু অন্যরকম ছিলো।
শ্রীলঙ্কার সাথে কূটনৈতিক ঝামেলার কারণে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো ভারত। ফলে অংশগ্রহণকারী ছিলো শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও আমন্ত্রিত বাংলাদেশ। ‘জন প্লেয়ার গোল্ড লিফ ট্রফি’ নামের এই এশিয়া কাপে খেলার ব্যাপারে বছর দুই আগে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়েছিলো বাংলাদেশ। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি চলছিলো।
রকিবুল হাসান জানালেন, এই এশিয়া কাপকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সে সময় বেশ কিছু খেলার মধ্যে ছিলো। প্রথমে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ভারত সফরে গিয়েছিলো। সেখানে পশ্চিম বাংলার বিপক্ষে তারা ম্যাচ খেলে। এরপর বাংলাদেশ যায় কেনিয়াতে। সেখান থেকে ফেরার পর আবার পশ্চিম বাংলা দল বাংলাদেশ সফরে আসে। অরুন লালের নেতৃত্বের সেই বাংলা দলকে হারিয়েছিলো বাংলাদেশ।
এরপর চলতে থাকে এশিয়া কাপের প্রস্তুতি।
প্রস্তুতি বলতে আজকের মতো এলাহী ব্যাপার তো ছিলো না। নিজেদের যতটা সাধ্যে কুলায়, তাই নিয়ে লড়াই করা। এখনকার মতো বিশাল কোচিং স্ট্যাফ তো দূরে থাক, বিদেশী কোনো কোচও ছিলো না। ছিলো না জিমনেসিয়াম বা আধুনিক ফিটনেস ট্রেনিংয়ের কোনো উপকরণও। তারপরও প্রস্তুতি ছিলো বলে বলছিলেন রকিবুল হাসান, ‘আলতাফ ভাই কোচ ছিলেন। আমরা সবাই নিজের দায়িত্বটা বুঝতাম। সীমিত সামর্থ ছিলো। কিন্তু আমাদের চেষ্টায় কমতি ছিলো না।’
রকিবুল হাসান মনে করেন, তখনকার প্রেক্ষাপটে ভালো একটা দল নিয়েই যেতে পেরেছিলো বাংলাদেশ। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল ভালো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু আজকের মত ম্যাচ ফি বা এসব প্রাপ্তি তখন ছিলো না।
এসব অপ্রাপ্তি একপাশে রেখে ৩১ মার্চ মাঠে নেমে গেলো বাংলাদেশ।
সূচনাটা মোটেও ভালো হলো না। ইমরান খানের করা প্রথম ওভারটা কাটিয়ে দিতে পেরেছিলেন রকিবুল হাসান। পরের ওভারে ওয়াসিম আকরামও উইকেট পাননি। এরপর ইমরান পরপর নুরুল আবেদীন নোবেল ও অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর উইকেট তুলে নেন। আর বাকীটা আসলে ওয়াসিম আকরামের দিন ছিলো। ১৯ রানে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন ওয়াসিম।
বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩৭ রান করেছিলেন শহীদুর রহমান। আর ১৪ রান করে করেছিলেন রফিকুল আলম ও গোলাম ফারুক সুরু।
৭ উইকেটে হেরেছিলো বাংলাদেশ। পাকিস্তানের ২টি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। যদিও শুরুটা ভালো ছিলো না। তারপরও একটা পথচলার শুরু হয়েছিলো ৩৫ বছর আগে। সেখান থেকে কতটুকু এগোলাম আমরা?
৩৫ বছর পর হিসাব মেলাতে গিয়ে রকিবুল হাসান বলছিলেন, ‘অবশ্যই এখনকার ক্রিকেট অনেক এগিয়েছি। তবে যে পরিমানে সুযোগ সুবিধা বেড়েছে, যতটা সময় পার হয়েছে, সে তুলনায় আরো উন্নতি হওয়া উচিত ছিলো। কেনো আমরা সঠিক পরিমানে উন্নতি করতে পারিনি, সে দায় হয়তো অনেককেই নিতে হবে। তবে আমি সে কথায় না গিয়ে বলবো, বাংলাদেশের ক্রিকেটের যেনো সত্যিকারের উন্নতি হয়।’