নব্বইয়ের রান মেশিন

নব্বইয়ের দশক জুড়ে ইংলিশ ক্রিকেটের সবচেয়ে পরিচিত মুখ ছিলেন মাইক আথারটন।

মাথা স্থির, সাবধানী চোখ এবং দুর্দান্ত পায়ের কাজ এই ছিল মাইক আথারটনের পরিচিত। এইভাবেই করেছেন রান উদ্ধার করেছেন দলকে। তাঁর এই ব্যাটিংয়ে ভর করে এগিয়ে গিয়েছে ইংল্যান্ডের রানের চাকা।

মাইক আথারটনের ক্যারিয়ার ছিল বেশ বিস্ময়কর। যদি বৃটিশ গণমাধ্যম তাকে নিয়ে বেশি আলোচনা না করতো তাহলে হয়তো আত্মবিশ্বাসের সাথে আরো দুর্দান্ত খেলতে পারতেন তিনি। তিনি যখন ইংল্যান্ড দলকে নেতৃত্ব দেন, তখন ইংল্যান্ড দল ছিল সময়ের সেরা ইংল্যান্ড দল। দলকে আরো বেশি কিছু দিতে পারতেন মাইক আথারটন, কিন্তু কোনো কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

আথারটন সবচেয়ে বেশিবার আউট হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি বোলার গ্লেন ম্যাকগ্রার কাছে। এছাড়াও কার্টলি অ্যামব্রোস এবং কোর্টনি ওয়ালসশও ছিলেন তার যম দূত। এছাড়াও অ্যালান ডোনাল্ড এবং শেন ওয়ার্নের কাছে যথাক্রমে ১১ এবং ১০ বার করে আউট হয়েছেন তিনি। এই বিষয়টা তাঁর ক্যারিয়ারকে সবচেয়ে ভুগিয়েছে। ইংলিশ গনমাধ্যম তাকে এটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উপহাস করেছে আথারটনকে।

ইংলিশ ক্রিকেট সমর্থকরা এটা ভুলতে পারে না যে, পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে পিঠে ব্যাথা থাকা সত্ত্বেও ইংলিশ ক্রিকেটের ব্যাটিং লাইনকে সামলেছেন তিনি। ইংল্যান্ডের হয়ে ১১৫ টেস্টে ৩৭.৬৯ গড়ে ১৬ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৭৭২৮ রান। তাঁর ক্যারিয়ারের শেষে তিনি নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে বলেন, ‘আমি সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান ছিলাম না। তবে আমার টেস্ট রেকর্ড বলে আমি ভালো একজন টেস্ট ব্যাটসম্যান ছিলাম।’

এটা ভুলে গেলে চলবে না, নব্বইয়ের দশক ছিল পেসারদের জন্য সেরা এক সময়। এই সময়ে ব্যাটসম্যানদের জন্য ব্যাটিং করা ছিল বেশ কষ্টকর এক কাজ। এই দশকে আথারটন এবং মার্ক টেইলর ছাড়া ব্যাটসম্যান জুটি টেস্ট ক্রিকেটে ছয় হাজারের বেশি রান করতে পারে নি। এটা প্রমাণ করে তারা ছিলেন অন্যদের চেয়ে বেশ ভালো ব্যাটসম্যান।

মাইক আথারটনের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় ১৯৮৯ সালে অ্যাশেজের পঞ্চম টেস্টে। জাতীয় দলে অভিষেকের আগে তিনি ছিলেন ক্যামব্রিজ ব্লুজ এবং ল্যাঙ্কাশায়ারের নিয়মিত ওপেনার। মাইক আথারটনের জাতীয় দলে অভিষেক এমন সময়ে যখন কিছু ইংলিশ ক্রিকেটার বিদ্রোহী দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিল এবং ইংল্যান্ড ৩-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হেরে পঞ্চম টেস্ট খেলতে নেমেছিল। জাতীয় দলে অভিষেক হবার আগের মৌসুমে কেমব্রিজের হয়ে করেছিলেন ৪১১ রান এবং ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে করেছিলেন ৬০২ রান। এই মোট ১০১৩ ছিলো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর মোট রান।

এরপরেও সময়ের সাথে সাথে অনেক উপরে উঠে গিয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও বেনসন এবং হেজেস কাপে সন্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাইক আথারটন। এর ফলে সবাই তাকে জাতীয় দলের ভবিষ্যত অধিনায়ক হিসেবে ভাবতে শুরু করেন।

আথারটনের টেস্ট অভিষেক হয় টেন্ট ব্রিজে। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে যখন আথারটন ব্যাটিংয়ে নামেন তখন ইংল্যান্ডে রান ছিল এক রানে এক উইকেট। এর পর মাত্র তিন বল পরেই লেগ বিফোরের ফাদে পড়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন মাইক আথারটন। দলের দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি ছিলেন দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন। করেছিলেন ৪৭ রান। তারপরও ইনিংস এবং ১৮০ রানের বিশাল ব্যবধানে ম্যাচ হেরে যায় ইংল্যান্ড।

এরপরের ওভাল টেস্টেও খুব বেশি ভালো করতে পারেননি তিনি। এই টেস্টে তাঁর জন্য সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের স্লেজিং। তাঁর মত অন্তর্মুখি ব্যক্তির জন্য স্লেজিং সামলিয়ে খেলা ছিল খুব কঠিন। এরপরেই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন তিনি।

এর পরে আবারো জাতীয় দলে ফিরে আসেন মাইক আথারটন। পরের গ্রীষ্মে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দলে ফেরেন তিনি। বৃষ্টি বিঘ্নিত এই ম্যাচে ২০৮ রানে গুটিয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। ব্যাটিং করতে নেমে শুরুতেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান তাঁর সঙ্গী গ্রাহাম গুচ। উইকেটের এক প্রান্ত আগলে রেখে ১৫১ রান করেন আথারটন। যা কিনা ইংল্যান্ড দলকে সন্মানজনক এক লিড এনে দেয়।

এর পরের ইনিংসে আবারো শুন্য রানে আউট হন তিনি। যদিও পরের তিন ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি করেন মাইক আথারটন। এজবাজটনে সিরিজের শেষ টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গ্রাহাম গুচের সাথে ১৭০ রানের জুটি গড়েন তিনি। এই জুটিতে তাঁর অবদান ছিল ৮২ রান। এই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ৭০ রান। যা কিনা ইংল্যান্ডকে ১১৪ রানের জয় এনে দিতে সাহায্য করে।

আথারটনের এই দুর্দান্ত পারফর্মেন্স তাকে জাতীয় দলে নিজের অবস্থান পাকা করতে সাহায্য করে। এই সিরিজের পরও তাঁর দুর্দান্ত পারফর্মেন্স অব্যাহত থাকে। এর ফলাফল স্বরুপ তিনি উইজডেনের বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের পুরস্কার পান। সাথে তিনি পান উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার।

এরপরেও নিজের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স বজায় রাখেন তিনি। তিনি খেলছিলেন গ্রাহাম গুচের অধিনায়কত্বে। গ্রাহাম গুচ অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেয়ার পর হঠাৎকরেই অধিনায়ক হন মাইক আথারটন।

অধিনায়ক হিসেবেও বেশ সফল ছিলেন তিনি। অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই জয়ের দেখা পায় ইংল্যান্ড। টানা ১৮ অ্যাশেজ ম্যাচ হারার পর এই জয় ছিল ইংল্যান্ডের জন্য স্বস্তির। অধিনায়ক হিসেবে দল গুছিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। দল গুছিয়ে নেবার পর বেশ সাফল্য পান মাইক আথারটন।

অধিনায়ক হিসেবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর বল টেম্পারিংয়ের জন্য অভিযুক্ত হন তিনি। যদিও তিনি বলেছিলেন তিনি মাঠ থেকে নেয়া ময়লা বলের মধ্যে ঘষেছিলেন যাতে বলের আকৃতি পরিবর্তন না হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় তিনি বলের উপর এমন কিছু ঘষেছিলেন যাতে বলের কিছু পরিবর্তন হয়।

ম্যাচের মাঝখানে দেখা যায় ইংল্যান্ডের ড্রেসিংরুমে ইংলিশ কোচ তাকে বল টেম্পারিংয়ের জন্য এক হাজার ডলার এবং ম্যাচ রেফারিকে মিথ্যা বলার জন্য ক’হাজার ডলার জরিমানা করেন। এই ঘটনার পর সংবাদ মাধ্যমের রোষানলে পড়েন তিনি। আথারটন সংবাদমাধ্যমের থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। বল টেম্পারিংয়ের কারণে তাঁর ম্যাচ ফির ৫০ শতাংশ জরিমানা করা হয়। এই সময় সংবাদ মাধ্যম তাঁর সমালোচনা করেলও তিনি অধিনায়ক হিসেবে পদত্যাগ করেননি। তাঁর মত একজন অন্তর্মূখি ব্যক্তির জন্য এটা ছিল বেশ আশ্চর্যজনক এক বিষয়।

বল টেম্পারিং ঘটনার চাপ মাথায় নিয়ে অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় যান মাইক আথারটন। ৯০ এর দশকে যেকোনো ইংলিশ অধিনায়কের জন্য অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ মানেই ছিল হার। এই সিরিজে ২-২ সিরিজ ড্র করে ইংল্যান্ড। দুই জয়ের মধ্যে সিরিজের চতুর্থ ম্যাচের পারফর্মেন্স ছিল বেশ দুর্দান্ত। অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্টে দুর্দান্ত এক জয় পায় ইংল্যান্ড। এই সিরিজে আথারটনের ব্যক্তিগত পারফর্মেন্স ছিল বেশ উজ্জ্বল। চার হাফ সেঞ্চুরিতে ৪০.৭ গড়ে করেছিলেন ৪০৭ রান। তাঁর এই পারফর্মেন্স টেনে নিয়ে যান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে। সেখানে ২ হাফ সেঞ্চুরি এবং ১ সেঞ্চুরিতে করেন ৪৮৮ রান।

১৯৯৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বেশ দুর্দান্ত পারফর্ম করেন মাইক আথারটন। বল টেম্পারিংয়ের ঘটনার পর থেকে বেশ সমালোচনার মুখে ছিলেন তিনি। দক্ষিন আফ্রিকার মাটিতে দুর্দান্ত পারফর্ম করে আবারো ইংলিশ সমর্থক এবং বৃটিশ মিডিয়ার মুখ বন্ধ করে দেন মাইক আথারটন।

ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা দুই সিরিজে এগিয়ে থেকেও সিরিজ হারার পর আকস্মিকভাবে অধিনায়কত্ব হারান মাইক আথারটন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন অ্যালেক স্টূয়ার্ট। অধিনায়কত্ব হারানোর পর ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন তিনি।

অধিনায়কত্ব হারানোর পর থেকে নিজের ফর্মও হারাতে শুরু করেন মাইক আথারটন। অধিনায়কত্ব হারানোর পর তিনি অ্যালেক স্টুয়ার্ট এবং নাসের হুসাইনের অধিনায়কত্বে খেলেন তিনি।

২০০০-০১ মৌসুমে অ্যাশেজ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় যায় ইংল্যান্ড। সেখানে প্রথম টেস্টে আঙ্গুলের ইনজুরির কারণে নিয়মিত অধিনায়ক নাসের হুসাইনের পরিবর্তে অধিনায়কত্ব করেন তিনি। এই সিরিজেই নিজের ক্যারিয়ারে শেষ টেস্ট খেলে ফেলেন মাইক আথারটন। নিজের শেষ ইনিংসে আউট হয়েছিলেন গ্লেন মাকগ্রার বলে।

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সময় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়ের পর পাকিস্তানী সাংবাদিক আসগর আলি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চায়। কিন্তু তাঁর ইংরেজী উচ্চারণ বুঝতে না পেরে তাকে আর সাক্ষাৎকার দেননি। তাকে যথেষ্ট পরিমাণ অপমান করেন।

ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে মাইক আথারটন একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এছাড়াও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের হয়ে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। মাইক আথারটন ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের সেরা ক্রীড়া সাংবাদিক নির্বাচিত হন।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link