প্রজন্ম পরিবর্তনের একটা সময় পার করছে বাংলাদেশ দল। সাকিব থেকে শুরু করে তামিম, মুশফিক, রিয়াদরা রয়েছেন এখন ক্যারিয়ারের শেষ পথে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার মোক্ষম সময় তাই এটিই। সেই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বেশ এগিয়েছেও বটে। বিশ্বকাপের পর থেকেই তারুণ্য নির্ভর দল নিয়ে খেলছে টাইগাররা।
তাতে অবশ্য খারাপ করেনি বাংলাদেশ। উল্টো দেশের মাটিতে টেস্টে প্রথম কিউইবধ, আবার সেই কিউই দূর্গেই তাদেরকে ওয়ানডে হারানো- দুই ইতিহাসই গড়েছে তরুণ তুর্কিরা। দিন বদলের এ যাত্রায় অপার এক সম্ভাবনাই তাই উঁকি দিচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। তারুণ্য উদ্দামে ভরপুর সেই দলটার সেনানী হয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের পরবর্তী অধিনায়ক হিসেবে শান্তই কি সবচেয়ে যোগ্য?
পরিসংখ্যানের আঙ্কিক বিশ্লেষণে, অধিনায়ক শান্ত এখন পর্যন্ত অকৃতকার্যদের দলেই থাকছেন। ওয়ানডেতে ৬ বার বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়া শান্ত জয় পেয়েছেন মাত্র একটি ম্যাচে। অবশ্য টেস্ট অধিনায়কত্বের অভিষেকেই জয়ের দেখা পেয়েছিলেন এ ক্রিকেটার। অধিনায়ক হিসেবে শান্তকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য এই স্যাম্পল সাইজটা একদম ছোট।
তবে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, পরিসংখ্যানে পিছিয়ে থাকলেও অন দ্য ফিল্ডে কৌশলগত কিংবা অফ দ্য ফিল্ডে শান্ত যে মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন, তাতে এই মুহূর্তে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড হাতে তাঁকেই সবচেয়ে মানায়। শান্তর ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক কতটা তুখোড় তার নমুনা মিলেছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতেই।
নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কে কন্ডিশন বুঝে বোলিং পরিবর্তন থেকে শুরু করে ফিল্ডিং সাজানোয় অধিনায়ক হিসেবে শান্তকে একটা বাহবা দিতেই হয়। এ ক্ষেত্রে বোলিং পরিবর্তনের দৃশ্যপট সামনে আনলেই হয়। তানজিম হাসানের প্রথম স্পেলে হেনরি নিকোলস ও রাচিন রবীন্দ্র আউট হলেও উইল ইয়াং ও টম ল্যাথামের ৩৬ রানের জুটি নিউজিল্যান্ডকে সাময়িক বিপদ থেকে উদ্ধারের আভাস দিচ্ছিল। এমতাবস্থায় তিনি বোলিংয়ে আনেন শরিফুলকে। যার আবার প্রথম স্পেলটা মোটেই ভাল যায়নি।
তবে অধিনায়ক হিসেবে শান্তর এই আস্থাতেই বল হাতে রীতিমত কিউই মিডল অর্ডারের উপরে ত্রাস ছড়ান শরিফুল। নাজমুল হোসেন শান্ত জানতেন, ওই জুটি ভাঙতে না পারলে নিউজিল্যান্ডকে আর থামানো যাবে না। তাই নিজের মূল বোলার শরিফুলের ওপর আস্থা রেখে ড্রিংকস ব্রেকের পর দ্বিতীয় স্পেলের জন্য তাঁকে বোলিংয়ে ফিরিয়ে আনেন। শরিফুল সেই স্পেলে ল্যাথাম, ইয়াং ও মার্ক চ্যাপম্যানকে আউট করে অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দেন।
শুধু শরিফুল নয়, এ দিন পার্ট টাইম বোলার সৌম্য সরকারকেও তিনি দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। শরিফুলের মতো সৌম্যও নেন ৩ উইকেট। আর শুরুর দিকে সিম মুভমেন্ট থেকে নিউজিল্যান্ডের টপ অর্ডারে আঘাত হেনেছিলেন তানজিম হাসান সাকিব। যার নেপথ্যেও ছিল শান্তর কৌশলী সিদ্ধান্ত ও দুর্দান্ত ফিল্ড প্লেসমেন্ট।
শান্ত যে শুধুই ওয়ানডেতে এমন অধিনায়কত্ব করেছেন তা নয়। সিলেট টেস্টেও তাঁর নেতৃত্ব অনেকের নজর কেড়েছিল। দেশের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি অধিনায়কত্বেও তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বোলার পরিবর্তন, ফিল্ডিং সেটআপ ও কৌশলগত অনেক সিদ্ধান্তে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
সিলেট টেস্টে শান্তর নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহেও। সংবাদমাধ্যমে কোনোরকম রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন, ‘অধিনায়কত্ব ও নেতৃত্ব আলাদা জিনিস। শান্তর অধিনায়কত্ব দারুণ। কৌশলগতভাবে সে সেরা। তাঁর ফিল্ডিং সাজানো ছিল দারুণ। সে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করে। এটাই ওকে অনন্য করে তুলেছে। আর তাঁর নেতৃত্ব কার্যকরও হয়েছে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে সে। আমার মনে হয় সামনে তাঁর লম্বা সময় আছে। সামনে তাঁর নেতৃত্ব ও অধিনায়কত্ব দেখে বোর্ড একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
অধিনায়ক হিসেবে ক্ষণিকে শান্ত এখন পর্যন্ত আলোই ছড়িয়েছেন। ওয়ানডেতে ৪০ এর উপরে গড় রেখেছেন। আবার টেস্ট অধিনায়কত্বের অভিষেকে সেঞ্চুরিও হাঁকিয়েছেন। অর্থাৎ নেতৃত্বের চাপে নিজের ব্যাটিংটা এখন পর্যন্ত এলোমেলো করতে দেননি এ ব্যাটার। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দরকার এমন একজনই অধিনায়ক। যে অনেকটা দিন নেতৃত্ব দিতে পারবে। যার হাত ধরে এগিয়ে যাবে দেশের ক্রিকেট। কিন্তু শঙ্কা তো থেকেই যায়, নেতৃত্বের দারুণ সক্ষমতা থাকার পরও শান্ত সেই সুযোগটা পাবেন তো? সাময়িক ব্যর্থতায় অধিনায়ক ছাটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটে তো হরহামেশাই ঘটে। এমন কিছু হলে শান্ত তখন বোর্ডকে পাশে পাবেন তো?