প্রচলিত এবং বাস্তব ঘটনা এটাই যে দুর্গাপূজোর অষ্টমীর বিকেলে দশমীর বাজনা বাজিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। কিন্তু কোথাও খুব সূক্ষ্ম বিচারে মনে হয় যে তার বছর দশেক আগেই, আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই বেজে গিয়েছিল দশমীর বাজনা, তারপরে যেটা চলছিল সেটা সম্ভব হয়েছিল কারন, তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি আর লড়াই তাঁর মজ্জায়।
প্রায় সিঁকি শতাব্দী আগে যখন লর্ডসে তাঁর মহারাজসিক অভিষেক হলো তার পরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা হয়েছিল কিভাবে ভারী ইংলিশ কন্ডিশনে নতুন বলের সামনে তাঁকে ঠেলে দিয়েছিলেন অধিনায়ক আজহারউদ্দিন, উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তিনি সেই পরীক্ষায় কিন্তু সসম্মানে উত্তীর্ন হন। পেস এবং স্যুইং সামলেই এসেছিল জীবনের প্রথম দুই টেস্টে জোড়া শতরান। তারপরও কি সন্দেহ ছিল ছেলেটার ক্ষমতা নিয়ে? উল্টোদিকে একইসঙ্গে অভিষেক করে ভালোই এগোচ্ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়ও।
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দু’টো টেস্টের পরে দিল্লীতে অস্ট্রেলিয়া আর দেশের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপরে শচীন দল নিয়ে বসলেন দক্ষিণ আফ্রিকাগামী বিমানে। এই সময় পর্যন্ত নিয়মিত টেস্টে তিন নম্বরে নামা সৌরভের ব্যাটিং গড় কমবেশি ৫০ আর দ্রাবিড়ের ৪৫। এই অবস্থায় জোহানেসবার্গ টেস্টে অধিনায়ক শচীন, সৌরভকে সরিয়ে তিন নম্বরে পাঠালেন দ্রাবিড়কে আর এখানেই করলেন অসাধারণ ১৪৮ যেটা দ্রাবিড়ের প্রথম আন্তর্জাতিক শতরানও বটে।
এরপর তাঁকে পাকাপাকি ভাবে তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশনে রেখে দেওয়া হলো। কিন্ত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যেটা নজর এড়িয়ে যায় সেটা হলো ওই জোহানেসবার্গ টেস্টেই সৌরভের দুই ইনিংস মিলিয়ে প্রায় ১৪০ রান আছে ডোনাল্ড-পোলক-ম্যাকমিলান-ক্লুজনারকে ঠেঙিয়ে। অর্থাৎ এটা কোন ভাবে মানা যাবে না যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফাস্ট বোলিং খেলতে সৌরভের সমস্যা ছিল আর সেই কারনে তাকে তিন নম্বর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
দ্রাবিড়ের প্রতি কোনোরূপ নেতিবাচক মনোভাব না রেখেই বলা যায় সেই সময়, হ্যাঁ সেই সময় পারফমেন্সের বিচারে টেস্টেও সৌরভ দ্রাবিড়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু এই একটা সিদ্ধান্ত সৌরভের টেস্ট কেরিয়ারে এক বিরাট প্রভাব বিস্তার করলো। ২০০০ সাল পর্যন্ত টেস্টে এই দুজনের পারফরম্যান্স প্রায় সমান। সৌরভ অধিনায়ক হওয়ার আগে পর্যন্ত যদি বিচার করা হয় তো দুজনেই তখন ৫০ গড়ে টেস্টে ব্যাটিং করছেন, দ্রাবিড়ের ছয়টা শতরান তো সৌরভের সাতটা, রান সৌরভের ২৭০০ (প্রায়) তো দ্রাবিড়ের ৩০০০ (প্রায়)। কিন্তু এরপরে দ্রাবিড় নিজেকে একটা অন্য পর্যায় নিয়ে চলে গেলেন। আর এইখানেই ব্যাটিং পজিশনটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেল।
আজকের দিনে এটা প্রমাণিত সত্য যে ফাস্ট বলটা দ্রাবিড় অনেক অনেক ভালো খেলে গেছেন। আর লক্ষণ সেই সময় ভারতের একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি মিডল অর্ডারের যে কোনো পজিশনে সমান সফল। কিন্তু দ্রাবিড় সৌরভের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু আলাদা। পাঁচ নম্বরে রাহুলের গড় যদি ৩৮ হয় তো সৌরভের ৩৭। ছয় নম্বরে নেমে দ্রাবিড়ের খেলা ইনিংসের মধ্যে থেকে ইডেনের ১৮০ সরিয়ে নিলে তিনিও লোয়ার অর্ডারে খুব একটা সফল নন।
তাঁর যাবতীয় সাফল্য তিন নম্বরে ব্যাট করে। আর সৌরভ গাঙ্গুলি? বাস্তব এটাই যে ৪ নম্বরে সৌরভের ব্যাটিং গড় ৬৬, যা শচীনেরও নেই। আর তিন এবং চার নম্বরে যখন সৌরভ ব্যাট করেছেন তখন তাঁর গড় ৫৭। এই ব্যাটসম্যানটাই যখন পাঁচ এবং ছয় নম্বরে যখন ব্যাট করেছেন গড় নেমে ৪০-এ চলে গেছে। অর্থাৎ দুজনেই তখনই চূড়ান্ত সফল যখন তাঁরা উপরের দিকে ব্যাট করেছেন। কিন্তু কখনো দলের ভারসাম্যের প্রয়োজনে বা কখনো অন্যায় যুক্তিতে সৌরভকে ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়টা নিচের দিকে ব্যাট করতে হয়েছে।
১৯৯৭। সৌরভের টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা সময়। যদিও ততদিনে তাঁকে ছয় নম্বরে ব্যাট করানোটা নিয়ম হয়ে গেছে। কলম্বোতে এলো জীবনের তৃতীয় শতরান। সেরা ফর্মে ব্যাট করছেন। নিশ্চিত ডাবল সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে এলেন। সঙ্গীর অভাবে। নয় উইকেট পড়ে যাওয়ার পরে দ্রুত রান বাড়াতে গিয়ে ১৪৭ রানে আউট। পরের টেস্টেও একই গল্প। এবার আউট হলেন ৯৯ রানে। যখন আউট হলেন উল্টোদিকে ব্যাট করছেন তাঁর সঙ্গে আবে কুরুভিল্লা।
অধিনায়ক শচীন বাধ্য হলেন পরের টেস্টে তাঁকে নিজের জায়গায় ব্যাট করতে পাঠাতে। এবারে এলো ১৭৩। কিন্তু তাও নিয়মিত ভাবে উপরের দিকে ব্যাট করা হলো না। পরের টেস্টেই আবার পাঠিয়ে দেওয়া হলো ছয় নম্বরে। একই ঘটনা ২০০১-০২ এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও। বার্বাডোজ এবং পোর্ট অফ স্পেন মিলিয়ে পর পর চারটা ইনিংসের মধ্যে তিনটাতে নিজের ইনিংসটাকে বড় রান বা শতরানে পরিণত করতে পারলেন না শুধুমাত্র সঙ্গীর অভাবে।
সৌরভের টেস্ট ক্যারিয়ারে কলম্বো, ব্রিসবেন আর হেডিংলের ইনিংস ছাড়া সমস্ত স্মরনীয় ইনিংসই এসেছে উপরের দিকে ব্যাট করে। এমনকি চতুর্থ ইনিংসে বিদেশের মাঠে রান তাড়া করে ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ৯৮ বা হ্যামিল্টনে শেষদিন (এটাও চতুর্থ ইনিংস) ম্যাচ বাঁচানো শতরানটাও এসেছিল চার নম্বরে ব্যাট করে। কিন্তু দু:খের বিষয় নিজে অধিনায়ক থাকাকালীন যেমন দ্রাবিড় আর লক্ষ্মণকে প্রয়োজন এবং ফর্ম অনুযায়ী জায়গা পরিবর্তন করে খেলিয়েছেন সেটা তাঁর ক্ষেত্রে অন্য কোন অধিনায়ক করেননি।
সেটা করলে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারটাও হয়তো আরও আকর্ষণীয় হতো। আর এই উপরে ব্যাট করার বিষয়টা তিনি নিজেও জানতেন। আর জানতেন বলেই ২০০১-০২ এ যখন চূড়ান্ত অফ ফর্মে, কিছুতেই রান পাচ্ছেন না ঠিক সেই সময় দিল্লিতে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টে দ্রাবিড়ের সঙ্গে কথা বলে একটা ইনিংসের জন্য নিজে তিন নম্বরে ব্যাট করতে আসেন এবং ১৩৬ রান করে নিজের ফর্ম ফিরে পান।
খুব ভাল ভাবে বিচার করলে দেখা যাবে রাহুল দ্রাবিড়ের ‘দ্য ওয়াল’ এবং লক্ষ্মণের ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ হয়ে ওঠা সৌরভের অধিনায়কত্বের সময় থেকে। এই সময় এই দুজন নিজেদেরকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে চলে যান, যেখানে দাঁড়িয়ে অধিনায়ক থাকাকালীন সৌরভের পক্ষে সম্ভব হয়নি নিজে ৩ নম্বরে উঠে গিয়ে ব্যাট করার। কিন্ত তার আগের সময়টায় পারফরমেন্সের তুল্যমূল্য বিচারে তিনি বাকি দুজনের থেকে এগিয়ে ছিলেন।
এই সময় তাঁর পূর্বতন দুই অধিনায়ক তাঁকে আরও বেশি করে তিন নম্বরে ভাবতে পারতেন। বিশেষত আজহারউদ্দিন তো দ্বিতীয়বার অধিনায়ক হয়ে আসার পরে নিজে পাঁচ নম্বরে এসে দিনের পর দিন সৌরভকে ছয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। আর যে অধিনায়ক শচীন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সৌরভকে মিডল অর্ডার থেকে তুলে এনে ওপেন করালেন, তিনি পারফরমেন্স থাকা সত্বেও টেস্টে দ্রাবিড়ের অফ ফর্মের সময়ও কেন যে সৌরভকে নিচে খেলিয়ে গেলেন সেটা পরম আশ্চর্যের বিষয়।
এভাবেই ভারতীয় ক্রিকেটের প্রদেশিকতার বিষবাষ্প আর তার সঙ্গে কিছুটা ভাগ্যের পরিহাস ভারতীয় ক্রিকেটের ৮৮ বছরের ইতিহাসের সেরা বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানের থেকে খুব কম করে হলেও কেড়ে নিয়েছে গোটা দশেক টেস্ট শতরান আর দুই থেকে আড়াই হাজার টেস্ট রান। পরবর্তী প্রজন্ম গুগল সার্চ করে তাঁর ৪২ গড়ে করা সাত হাজারের সামান্য বেশি রান আর ১৬ টা সেঞ্চুরি দেখে তাঁকে অসাধারণ ব্যাটসম্যান হিসেবেই মনে রাখবে, মহানদের তালিকায় ফেলবে না।
ক্রিকেট ইতিহাসের কোথাও হয়তো ফুটনোট হিসেবেও লেখা থাকবে না যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের বিশ্ব ক্রিকেটের (টেস্ট) সেরা ব্যাটিং লাইনআপটা তৈরির পেছনে এক বাঙালি ক্রিকেটারের বিরাট আত্মবলিদান ছিল, যা যথেস্ট সম্ভবনা এবং ক্ষমতা থাকা সত্বেও টেস্ট ক্রিকেটের আসরে তাঁকে মহান ব্যাটসম্যান (যাঁদের গড় ৫০ বা তার বেশি) হতে দেয়নি।