‘বাবা, অর্জুন টেন্ডুলকারের কী সৌভাগ্য! গাড়ি, আইপ্যাড থেকে সব রকম বিলাসিতা আছে ওর জীবনে। তবে কিন্তু আমি ওর চেয়ে সৌভাগ্যবান। কারণ, আমার বাবা পুরো দিনটা আমার সঙ্গে কাটাতে পারে, যেটি অর্জুনের বাবা পারে না।’ বাবা নওশাদ খানকে এই কথাটাই একবার বলেছিলেন সরফরাজ খান। মুম্বাই থেকে বেড়ে ওঠা সরফরাজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার তখনও পূর্ণতা পায়নি।
তবে ক্রিকেটার হয়ে বেড়ে ওঠার প্রতিটি মহূর্তেই যে জড়িয়ে ছিল তাঁর বাবা। সরফরাজের সাথে বাবা নওশাদের পরিচয় যে শুধু পিতা-পুত্রের গণ্ডিতে আটকে নেই। তিনি একজন কোচ এবং একই সাথে মেন্টরও। নেটে ছেলেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থ্রো-ডাউন করে গেছেন। নিজে একসময় মুম্বাইয়ের হয়ে খেলতেন। কিন্তু ছেলেকে চেয়েছিলেন মুম্বাইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের জার্সিতে দেখতে।
অবশেষে সেই চাওয়া, স্বপ্ন কিংবা অপেক্ষা- সবটাই পূর্ণ হয়েছে। সরফরাজ খানের টেস্ট অভিষেক হয়েছে। অভিষেকটাও কী দুর্দান্ত! প্রথম ইনিংসে ৬২, দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ৬৮।
ভোরে উঠে প্রতিদিন নেটে বাবার থ্রো-ডাউন, ম্যাচ না থাকলেও নওশাদের সাথে তাঁর ছয় সাত ঘন্টার সেশন, সব কিছুরই একটা ফল পাচ্ছেন সরফরাজ খান। ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে একটা গল্প লেখার পথে এগিয়েছেন তিনি। যে গল্পের নেপথ্যের নায়ক নওশাদ খান।
বাবাকে আজীবন নায়ক ভেবে আসা ছেলে সরফরাজ খানের প্রতিদান দেওয়া হয়তো অসম্ভবই বটে। তবে নিজের টেস্ট জার্সি নাম্বারেও বাবাকে ধারণ করেছেন তিনি। বাবার জন্যই সরফরাজের জার্সির নম্বর ৯৭। ৯ এবং ৭ এই দুই নম্বরের সঙ্গে সরফরাজের বাবার যোগ রয়েছে। নও মানে নয় আর সাত (৭) আসলে নওশাদের নামের সঙ্গে মিল থাকায় সরফরাজ বেছে নিয়েছেন ৯৭ নম্বর জার্সি।
এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে ৯৭ নম্বর জার্সিতে দেখা গিয়েছে আরো এক ক্রিকেটারকে। তিনি মুশির খান। যিনি নওশাদ খানের আবার কনিষ্ঠ পুত্র। অর্থাৎ সরফরাজ-মুশির সম্পর্কে দুই ভাই।
বাবা নওশাদ খান, দুই ছেলে সরফরাজ-মুশির, গোটা পরিবারটাই যেন এক ক্রিকেট পরিবার। মুশির খান নিজেও এবারের যুব বিশ্বকাপে ছিলেন ভারতের অন্যতম আস্থাভাজন ক্রিকেটার। টুর্নামেন্টে উদয় শাহরনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬০ রান এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকেই। একই সাথে দুটি শতকও হাঁকিয়েছিলেন তিনি।
২০২২ এর শেষ দিকে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়েছিল মুশির খানের। মুম্বাইয়ের হয়ে সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে সে ম্যাচে একসাথে খেলেছিলেন বড় ভাই সরফরাজ খানের সাথেও।
ভারতের সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট লিগে একই সাথে, একই ম্যাচে খেলছে দুই ভাই। মেন্টর কিংবা কোচ হিসেবে বাবা নওশাদ খানের এটাই তো পরম প্রাপ্তি। তবে সেই প্রাপ্তি নিশ্চয়ই ছাড়িয়ে গেছে সরফরাজের টেস্ট অভিষেক কিংবা অনূর্ধ্ব-১ই বিশ্বকাপে মুশির খানের দুটি সেঞ্চুরিতে।
এক জীবনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং তারপরও যখন স্বপ্ন পূরণ হয় না, তখন হয়তো পুড়ে যায় অনেকখানি। তবে বাবারা ব্যতিক্রম হয় ঠিক এই জায়গাতেই। দলে সুযোগ না পেয়ে সরফরাজ যখন হতাশায় জর্জরিত, তখন বাবা নওশাদ শুধু তাঁকে নিজের কাজটা করে যেতে বলেছিলেন। সরফরাজ করেছেন। তার সুফলটাও এখন পাচ্ছেন।
একদম নিজ যোগ্যতাবলে সুযোগ পেয়েছেন লাল বলের ক্রিকেটে। অপেক্ষায় ধৈর্যের শেষে এখন শুধু প্রয়োজন সেই স্বপ্নটাকে আরো পরিণত রূপ দিতে। সরফরাজ নিশ্চয়ই সেটা করে যাবেন। কারণ তিনি যে নওশাদ খানের পুত্র।
টেস্ট অভিষেকে বাবার অশ্রু দেখতে পারার সৌভাগ্য কজনই বা দেখতে পারেন। সরফরাজ সেটা দেখেছেন। নিজের প্রথম টেস্টের দুই ফিফটিতে যেভাবে বাবার দিকে ইঙ্গিত করে ‘চুমু’ একেছেন, এমন কিছুর ধারাবাহিকতা নিশ্চয়ই ধরে রাখবেন তিনি।