খেলোয়াড়দের বয়স পড়তির দিকে থাকলে আমরা খুব সহজেই বাতিলের খাতায় চলে যান। আর সেই বাতিলের খাতায় নাম লেখাতে থাকা খেলোয়াড়েরা চমক দেখালে? খুব সহজেই একটা কথা চলে আসে, ‘এ যেন বুড়ো হাড়ের ভেলকি’।
কিন্তু গতকাল এফএ কাপের ম্যাচে যা দেখা গেল, তাকে কোনোভাবেই বুড়ো হাড়ের ভেলকি বলা যাবে না, বরং বুড়ো মাথার ভেলকি। জোসে মোরিনহো আর কার্লো আনচেলত্তি, যাদের বড় বড় ফুটবল পন্ডিতেরা ফেলে দিয়েছেন হিসেবের বাইরে, তারাই উপহার দিলেন এফএ কাপের অন্যতম সেরা ম্যাচ। যযেমনটা দেখা যায়নি গত ৬০ বছরে।
আজ থেকে ১০ কেন, ৫ বছর আগেও যদি কেউ বলতো কার্লো আনচেলত্তি আর জোসে মোরিনহো মুখোমুখি হবেন এফএ কাপে, তবে তাদের দল হিসেবে ধরা হতো কোনো হেভিওয়েট দলকে। তাদের হাতে থাকবে অফুরন্ত খরচ করবার সুযোগ, দলকে নিয়ে ফাইট দেবেন প্রিমিয়ার লিগ কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগের জন্য। ৫ বছর আগেও দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ স্পেশালিস্ট’ আর ‘স্পেশাল ওয়ান’ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন টুর্নামেন্টে মুখোমুখি হবেন দুই মিড-টেবিল দলকে নিয়ে।
দল হয়তো মিড টেবিল হয়েছে, কিন্তু তাতে করে ভাবনা চিন্তায় তো ভাটা পড়েনি। সান সিরো, সান্তিয়াগো বার্নাব্যু কাঁপানো কোচ গুডিনসন পার্কে আসলেই একই মানুষ থাকেন। স্থান-কাল-পাত্র বদলালেও মস্তিষ্ককে সেই পুরোনো ধার এখনও আছে বৈকি।
কিংবা ‘স্পেশাল ওয়ান’খ্যাত জোসে মোরিনহো; ইংলিশ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ লিগ জয় করে আসা হেভিওয়েট কোচের জন্য টটেনহ্যাম নামটা বড় নয়। পোর্তোর মতন দলকে নিয়ে যিনি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন, তার কাছে সঠিক খেলোয়াড় থাকলেই হয়। ট্যাক্টিকাল ব্যাটেলে তাদের সমতূল্য এখনও খুব কম মানুষই আছেন। আর সেটারই দেখা মিলল গতকাল।
সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই প্রান্তের দুই ফিলোসফির দুই কোচ যখন মুখোমুখি হন, তখন যেমনটা আশা করছেন, তেমনটাই হয়। সে ম্যাচ ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে থাকে। কার্লো আর জোসের খেলোয়াড়েরাও হতাশ করেননি, গত ৬০ বছরে এফএ কাপ যা দেখেনি, তাই উপহার দিয়েছেন ফুটবল বিশ্বকে।
কার্লো আর জোসে পুরোপুরি দুই প্রান্তের কোচ। যেখানে আনচেলত্তি অ্যাটাকিং ফুটবলের মাস্টার, সেখানে মোরিনহোর পছন্দ বাসপার্ক। এক গোল করেই পুরো ম্যাচ নিজের ডিফেন্স সামলানোর ট্যাক্টিস তার। অন্যদিকে আনচেলত্তি ম্যাচের শেষ মিনিটে এগিয়ে থাকলেও অ্যাটাক করার ট্যাক্টিস তার। আর দুই প্রান্তের দুই কোচ মুখোমুখি হলে যেটি হয়, সেটিই করেছেন তারা।
গুডিসন পার্কে আতিথ্য গ্রহণ করতে এসেছিলেন মোরিনহোর দল। আজীবন টইটুম্বুর রক্ষণে খেলা মোরিনহো আনচেলত্তির বিপক্ষে রণকৌশল সাজিয়েছিলেন ভেবে চিন্তেই। ম্যাচের তিন মিনিটেই ডেভিনসন সানচেসের গোলে এগিয়ে যায় সফরকারী দল। এরপর পুরো ম্যাচই যেন ‘বাসপার্ক’ ডিফেন্সিভ ফুটবল খেলার চিন্তা। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষের দিকে মাত্র ৭ মিনিটের মাথায় ৩ গোল হজম করে বসে ‘স্পেশাল ওয়ান’-এর দল। ৩৬ মিনিটে ডমিনিক কালভার্ট–লুইন গোল করে সমতায় ফেরান এভারটনকে। এরপর ৩৮ মিনিটে রিচার্লিসন আর ৪৩ মিনিটে সিগার্ডসন এগিয়ে নেন এভারটনকে ৩–১ গোল। আনচেলত্তির অ্যাটাকিং ফুটবলের সম্পূর্ণ সৌন্দর্য্য দেখা গিয়েছে গতকাল।
প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে এরিক লামেলা এভারটনের জালে বল ফেলে ব্যবধানটা কমান (৩–২)। সানচেজ টটেনহামকে সমতায় ফেরান ৫৭ মিনিটে। কিন্তু রিচার্লিসন ৬৮ মিনিটে ৪–৩ গোলে এগিয়ে নেন এভারটনকে। হ্যারি কেইন আবার সমতায় ফেরান ৮৩ মিনিটে। পুরো ৯০ মিনিট শেষ হয়েছিল সমতায়। মোরিনহো চেষ্টা করছিলেন ম্যাচ পেনাল্টিতে নেওয়ার। কিন্তু এক্সট্রা টাইমে ট্রাম্প কার্ড বের করা বাকি ছিল আনচেলত্তির। ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার বার্নার্ডই হয়ে উঠেন ইতালিয়ান ডনের ট্রাম্প কার্ড। আর ৯ গোলের ম্যাচ শেষ হয় ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ স্পেশালিস্ট’-এর জয় দিয়ে।
এই জয় শুধু কার্লো আর জোসের মুখোমুখি লড়াই ছিল না বরং টটেনহ্যাম আর এভারটনের পথও নিশ্চিত করে দিলো। অনেক বছর ধরেই মিড টেবিলে ঘুরপাক খাচ্ছে তারা। প্রায় জিতবে জিতবে করেও শিরোপার ছোঁয়া পাওয়া হচ্ছিল না তাদের। যে কারণে পয়সা খরচ করে হেভিওয়েট কোচ, তাদের মনমতো খেলোয়াড় কিনতে বেরিয়েছে তারা। এফএ কাপের এই রাউন্ড জিতে কার্লো প্রমাণ করে দিয়েছেন, এতোদিন পরে এসেও এখনও ট্যাক্টিক্যাল ব্যাটেলে টেক্কা দিতে সক্ষম তিনি।
অন্যদিকে শেষ পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই হারের স্বাদ পেয়েছে স্পার্স। সন-কেইন জুটিও রক্ষা করতে পারেনি হার থেকে। তীব্র সমালোচনার মুখেও পরেছেন জোসে। এমন ম্যাচের পর হয়তো ফুটবপ্ল দুনিয়া খুশি হতে পারেন, কিন্তু মোরিনহো নয়। এই নিয়ে ক্যারিয়ারে তৃতীয়বারের মতন এক ম্যাচে ৫ গোল হজম করলেন মোরিনহো। এমনিতেই পণ্ডিতেরা তাকে সরিয়ে দিচ্ছেন সাইডলাইনে, তার উপর এমনসব ম্যাচে হার তার রেপুটেশনেও ধাক্কা দিতে বাধ্য। যত ইদুর-বিড়ালের গল্প শোনান না কেন, ৫৮ বছর বয়সী পর্তুগিজ কোচের পেছনে লেগে থাকা লোকের কিন্তু অভাব নেই।
২০০৮ সালে ৫-৪ গোলের ম্যাচকে হকি ম্যাচ বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন মোরিনহো। বলেছিলেন, ‘যদি দুই দল ২২ জন খেলোয়াড় নিয়েও ৫-৪ গোলে ম্যাচ শেষ করে তবে কোচেদের লজ্জা পাওয়া উচিত’। মোরিনহো আর এই বয়সে এসে লজ্জা-টজ্জা কিছু পাননা। পেলেও বা কী? কোচেদের এমন দ্বৈরথ যে ফুটবলের বড় উপহার তা আবারও প্রমাণ হলো এই এফএ কাপে।