চিত্ত যেথা ভয়শূন্য

ডগলাস অ্যান্থনি ম্যারিলিয়ার, এককালের সম্ভাবনাময় স্পিন অলরাউন্ডার। ডানহাতি অফ স্পিনের পাশাপাশি ব্যাট করতেন লোয়ার মিডল অর্ডারে। আর্লি টু থাউজেন্ডের জিম্বাবুয়ে দলটাকে যারা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাদের কাছে মোটেই অপরিচিত কোন নাম নয়। আন-অর্থোডক্স টেকনিক আর পিঞ্চ হিটিং দিয়ে অল্প ক’দিনেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তবে পাঁড় ক্রিকেটভক্তরা তাঁকে মনে রাখবে পার্থ ও ফরিদাবাদে খেলা দুটি অসাধারণ ক্যামিওর জন্য।

যারা জানেন না তারা হয়ত ভাবছেন, দুটো ক্যামিও ইনিংসে কীইবা এমন মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে শুনি? তো চলুন, আজ সেই গল্পই শোনাব আপনাদের।

১.

সময়টা ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। পার্থের ওয়াকায় চলছে অস্ট্রেলিয়া বনাম জিম্বাবুয়ের ওয়ানডে খেলা। টানটান উত্তেজনা আর নাটকীয়তায় ভরা সেই ম্যাচে মাত্র ১ রানে হেরে যায় জিম্বাবুয়ে। তবে এই ম্যাচটি মনে রাখার আসল কারণ হচ্ছেন ডগলাস ম্যারিলিয়ার!

গ্লেন ম্যাকগ্রার করা ইনিংসের শেষ ওভারে মাত্র ৫ বল খেলে দুটি বাউন্ডারিসহ ম্যারিলিয়ার অপরাজিত ছিলেন ১২ রানে। কিন্তু সেই ৫ বলের ইনিংসে তিনি এমন কিছু উদ্ভাবনী শট খেলেছিলেন যা ক্রিকেটে আগে কেউ দেখেনি।

৩০৩ রানের পাহাড়সম লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শেষ ওভারে যখন জয়ের জন্য দরকার ১৫ রান; তখন জীবনে প্রথমবার ম্যাকগ্রার মুখোমুখি হওয়া তেইশ বছরের তরুণ ম্যারিলিয়ার কিনা আশ্রয় নিতে গেলেন ইম্প্রোভাইজেশনের! অফ সাইডে সরে গিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় প্রায় ইয়র্কার লেন্থের একটা বলকে কাঁধের ওপর দিয়ে ফ্লিক করে অনায়াসে ফাইন লেগ সীমানা ছাড়া করলেন তিনি।

ম্যারিলিয়ার উদ্ভাবিত সেই ইম্প্রোভাইজড শটটিই ছিল আজকালকার দিনের জনপ্রিয় ‘স্কুপ’ কিংবা ‘র‍্যাম্প’ শট। প্রথমদিকে ম্যারিলিয়ারের নামেই শটটির নামকরণ করা হয় ‘ম্যারিলিয়ার স্কুপ’। অনেকের মতে ক্রিকেটে স্কুপ শটকে জনপ্রিয় করার পেছনে ম্যারিলিয়ারের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তাকে স্কুপ শটের জনকও বলেন কেউ কেউ। এ নিয়ে অবশ্য মতবিরোধ আছে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ব্যাটসম্যান রায়ান ক্যাম্পবেল নাকি ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত স্কুপ খেলতেন।

যাই হোক, ম্যাচে ফিরে আসি। ওভারের দ্বিতীয় বল থেকে আসলো দুই রান। তারপর তৃতীয় বলে যেন প্রথম বলের রিপ্লে দেখলাম! আবারও সেই ম্যারিলিয়ার স্কুপ! যার ফলাফল ফাইন লেগ দিয়ে বল চলে সীমানার বাইরে।

৩ বলে ৫! জিম্বাবুয়ে শিবিরে তখন অভাবনীয় এক জয়ের স্বপ্ন উঁকি দিতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু ম্যাকগ্রা সেটা হতে দিলে তো! পরের তিনটে বলই ছিল নিখুঁত ব্লক হোল ইয়র্কার, তা থেকে ম্যারিলিয়ার আর ভিলজোয়েন মিলে নিতে পারলেন কেবলই তিনটে সিঙ্গেল।

তবে একটা ব্যাপার, যারা ইউটিউবে ভিডিও দেখেছেন তারা হয়ত ভাবতে পারেন শেষ বলটিতে ম্যারিলিয়ার কেন স্কুপ অ্যাটেম্পট করলেন না? তার কারণ অজি ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়াহ ততক্ষণে ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে ফিল্ডার সেট করে দিয়েছেন।

২.

ম্যারিলিয়ার ম্যাজিকের এখানেই শেষ নয়। ঠিক পরের বছরই ভারতের ফরিদাবাদে খেলার অন্তিম মুহূর্তে আবারও দেখা মিলল ম্যারিলিয়ার স্কুপের। এবারে আর পরাজিত দলের খেলোয়াড় নন তিনি, মাঠ ছাড়লেন বিজয়ীর বেশে।

জিম্বাবুয়ের সামনে লক্ষ্য ছিল ২৭৪ রান। ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ম্যারিলিয়ার যখন ক্রিজে এলেন (হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, ১০ নম্বর!), আফ্রিকান দলটি তখন নিশ্চিত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। জয়ের জন্য চাই ৩২ বলে ৬৫! হাতে মাত্র ২ উইকেট।

এরপরই শুরু হলো টাটেন্ডা টাইবুকে নিয়ে ডগলাস ম্যারিলিয়ারের নিরন্তর লড়াই! কিছুক্ষণ পর টাইবু আউট হয়ে গেলেও থামেননি ম্যারিলিয়ার। ‘নাম্বার ইলেভেন’ গ্যারি ব্রেন্টকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান শেষ পর্যন্ত। ছিনিয়ে আনেন এক উইকেটের এক অবিশ্বাস্য জয়! জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসেই অন্যতম সেরা জয় বলতে হবে এটিকে।

ম্যারিলিয়ার সেদিন ফিফটি পূরণ করেছিলেন মাত্র ২১ বলে! ২৪ বলে অপরাজিত ৫৬ রানের ইনিংসে ছিল ১০টি চার ও একটি ছক্কা। ছক্কাটা মেরেছিলেন জহির খানের বলে সুইপ করে!

ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ‘ক্যামিও’ ইনিংসটিতে ইম্প্রোভাইজেশনের কোন কমতি ছিল না। স্কুপ, সুইপ, র‍্যাম্প, ইনসাইড আউট, লেট কাট কী ছিল না সেই ইনিংসে!

ওই ম্যাচেই চার উইকেট নেয়া পেসার জহির খানের করা ৪৭ ও ৪৯তম ওভারে ম্যারিলিয়ার যে অভিনব শটগুলো খেলেছিলেন তা হতবাক করে দিয়েছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে। চোখের নিমিষে একটার পর একটা বলকে যেভাবে সীমানাছাড়া করছিলেন, জহির খানের বিস্ময়ভরা মুখমন্ডলের অসহায় চাহনিই বলে দিচ্ছিল সব।

কেবল জহিরই নন, তখনকার দিনে বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলার অনিল কুম্বলের বলেও খেলেছেন দারুণ সব ড্রাইভ, কাট আর সুইপ। ম্যাচ শেষে যারপরনাই হতাশ ভারত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি বলেছিলেন, জীবনে কোনদিন কাউকে এমন অদ্ভুত শট খেলতে দেখেননি তিনি।

৩.

ডগলাস ম্যারিলিয়ার তার ছোট্ট ক্যারিয়ারে এরকম ইম্প্রোভাইজড শট অসংখ্যবার খেলেছেন। এমনকি ঢাকা টেস্টে মাশরাফির ১৪০ কিলোমিটার গতির বলেও স্কুপ খেলেছেন তিনি! পরবর্তীকালে ‘ম্যারিলিয়ার স্কুপ’-এর অনুকরণে মোহাম্মদ আশরাফুল, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, মাহেলা জয়াবর্ধনে, এবি ডি ভিলিয়ার্স, জশ বাটলার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলসহ অনেক ব্যাটসম্যানকেই নিয়মিত স্কুপ বা র‍্যাম্প শট খেলতে দেখা গেছে।

তিলকরত্নে দিলশানের ‘দিলস্কুপ’ অবশ্য ম্যারিলিয়ার স্কুপের চেয়ে অনেকটাই আলাদা, ইউনিক একটা শট। একটা সময় আমাদের সাকিব আল হাসানও রেগুলার স্কুপ খেলতেন, যার নাম দিয়েছিল ‘সুপার স্কুপ’।

৪.

সবশেষে ডগলাস ম্যারিলিয়ারের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু কথা না লিখলেই নয়।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর পথচলার সূচনাটা হয়েছিল ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রঙিন পোশাকের ওয়ানডে দিয়ে। যেটি থমকে গেছে মাত্র ৫ টেস্ট আর ৪৮ ওয়ানডেতেই।

মজার ব্যাপার হল, ক্যারিয়ারের শুরুতে ম্যারিলিয়ার ছিলেন একজন স্পেশালিষ্ট ওপেনার। ওয়ানডে অভিষেকেই অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের সাথে গড়েন ৮৩ রানের উদ্বোধনী জুটি। ২০০৩ সালের এপ্রিলে শারজায় ক্যারিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরিটিও হাঁকিয়েছিলেন ওপেনার হিসেবে, কেনিয়ার বিপক্ষে।

অনেকেই হয়ত জানেন না, ১৯৯৬ সালে জিম্বাবুয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সতীর্থ মার্ক ভারমিউলেনের সাথে ওপেনিং জুটিতে ২৬৮ রানের বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন ডগলাস ম্যারিলিয়ার।

ছোট্ট ক্যারিয়ারে স্মরণীয় মুহূর্ত আছে বল হাতেও। ২০০১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মারের চোটে জিম্বাবুয়ের বোলারদের যখন ‘ত্রাহি মধুসূদন’ দশা, তখন ডানহাতি অফ স্পিনে ৪ উইকেট তুলে নিয়ে দলকে ম্যাচে ফেরান এই ম্যারিলিয়ারই (১০-০-৩৮-৪)।

২০০৩ সালের জুলাইতে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে যেদিন ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেললেন, তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। ধারাবাহিকতার অভাব কিংবা ফর্মহীনতা নয়, এত অল্প বয়সে ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার আসল কারণটা ছিল অর্থনৈতিক। কারণ সে সময় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে আর্থিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। তাছাড়া স্বৈরশাসক মুগাবের বর্ণবাদী হস্তক্ষেপে শ্বেতাঙ্গদের ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়াটাই হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। ক্রিকেট ছেড়ে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিতে তাই দু’বার ভাবতে হয় নি ডগলাসকে।

৫.

শেষ করবো ম্যারিলিয়ারের ব্যক্তি জীবনে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনার গল্প দিয়ে। ম্যারিলিয়ারের বয়স যখন মাত্র ১৬, রাজধানী হারারেতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তাঁর বন্ধু ও বন্ধুর পরিবারের সদস্যবৃন্দ। ম্যারিলিয়ারও ছিলেন সেই গাড়িতে, কিন্তু অলৌলিকভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরেন তিনি। কোনো মতে প্রাণ বাঁচলেও দুর্ঘটনায় ম্যারিলিয়ারের দুটো পা’ই ভেঙে গিয়েছিল। প্রায় দুই বছর তাকে কাটাতে হয়েছে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ পঙ্গুজীবন। এরকম একটি রোমহর্ষক ও চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা যার জীবনে এসেছে সে তো সহজে দমবার পাত্র নয়। লম্বা বিরতির পর ফিরে এসে নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা করে নিতে তাই একদমই সময় নেন নি তিনি।

ম্যারিলিয়ারের মত ক্রিকেটারকে কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করলে ভুল করবেন। তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেনই মাত্র তিন বছর। পরিসংখ্যান বলবে তাঁর ওয়ানডে গড় মাত্র ১৮ কিন্তু বলবে না দলের প্রয়োজনে অদম্য সাহসী এই ব্যাটসম্যানকে প্রায়ই খেলতে হত লোয়ার অর্ডারে, এমনকি লোয়ার অর্ডারেও ম্যাচ জিতিয়েছেন একা হাতে। ভয়ডরহীন ‘নাথিং টু লুজ’ মানসিকতার এই ক্রিকেটারকে সবাই ভুলে গেলেও অন্তত আমি মনে রাখতে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link