এক নীতিহীন, লাগামহীন ভালবাসা

‘ইউরোপ বিশেষ নজর দিচ্ছে না তাঁর দিকে। কিন্তু এই ছেলেটি স্কিলফুল, ট্যালেন্টেড। সাও পাওলোয় খেলছে, আর ২০০২ বিশ্বকাপ খেলতে আসছে।’

২০০২ বিশ্বকাপ শুরুর আগে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারের একটি ছোট্ট অংশে রিভালদো এই কথাটা বলেছিলেন। সুদূর ব্রাজিলে সদ্য ১৮-তে পা দেওয়া রিকার্ডো কাকা তখন চুটিয়ে খেলছে সাও পাওলোতে। বিশেষ নামডাক নেই, আর বয়সও উঠতি – সুতরাং ইউরোপ সেভাবে হাতছানি দিচ্ছে না।

সময়টাও এখনকার মত প্রথম বিশ্ব ঘেঁষা নয় যে ইউরোপে না খেললে যোগ্যতা প্রমাণ হবে না। অতএব, সাও পাওলো থেকেই জাপান-সাউথ কোরিয়া যাত্রা। সাকুল্যে একটা ম্যাচ খেললেও বিশ্বকাপ অর্জন, একেবারে বাল্য বয়সেই। কাকার জার্নি, অনন্য গল্পভাণ্ডারে ভরা।

প্রশ্ন হল, হোয়াই দিস প্লেয়ার। এতটা কী আকুল আর্তি এই কাকাকে ঘিরে যে ক্ষণে ক্ষণে সাত সমুদ্দুর পেরোনো ভারতবর্ষের এক জনপদে বসে দিনরাত কাকাকে স্মরণ করা! স্কিলফুল প্লেয়ার যে সেই সময় ছিল না তা তো নয়। আসলে, কিছু কিছু প্লেয়ার আসে, যাদের দেখলে অন্যকিছুর তোয়াক্কা করতে ইচ্ছে হয় না। অবশ্যই ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করবে ডিসিশন, কিন্তু ছোট বয়সের চোখে একবার ভুলবশত রিকার্ডো কাকা ধরা খেয়ে গেছিলেন, সেই চোখ আর দ্বিতীয় কাউকে এতটা ভালবাসার তাগিদ ভেতর থেকে অনুভব করেনি।

প্রথমত, এমবাপে-হালাণ্ড তো দূরস্থান, মেসি-যুগেরও আগে বল পায়ে পড়ামাত্র দৌড়! সে দৌড়ের সাথে যেন দৌড়চ্ছে আমার গোটা শৈশব। তামাম স্বপ্নের জালবোনার শুরুয়াদ ঐ দৌড় থেকে। কখনও দৌড়ের গতি শ্লথ করে একটা লম্বা থ্রু, যা নিমেষে তছনছ করে দিচ্ছে অপনেন্টের শক্তিশালী ডিফেন্স।

তিনটে ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে সে বল বেরিয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ডের পায়ে পৌঁছচ্ছে অথচ, ডিফেন্ডারদের করার কিছুই নেই! এই কাকা ২২ নম্বর জার্সি গায়ে ততদিনে শিল্পনগরী মিলানে। ব্রাজিল থেকে সদ্য আগত ইতালিতে।

এই কাকা প্রেমে ফেলছেন ফুটবলের। একটা টাচে ওয়াল খেলে বেরিয়ে সোলা রান ক্রিয়েট করছেন। শুধু সেটা করেই ক্ষান্ত নয়, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে গোল পর্যন্ত করেছেন ওভাবে। গিগস-স্কোলস-রন-রুনি-ফার্দিনান্দ-ভিদিচের সাবেক ম্যাঞ্চেস্টারের জন্য খেলা দেখতে বসেও বারবার চোখ ফিরে ফিরে দেখতে চাইছে তাকে।

এ প্রেম আশৈশবের। আশৈশবের ভালবাসা। সারল্যে, বিস্ময়ে ভরা এক নীতিহীন, লাগামহীন ভালবাসা – জীবনের পথে যত বড় প্রহেলিকা আসুক, কেউ ভোলাতে পারবে না।

বারবার তাই, ফিরে ফিরে চাই আমার ফুটবল প্রেমিককে। রিকার্ডো কাকা। তামাম ব্রাজিল সুপারস্টারদের ভীড়ে আলাদা করে চোখ টেনে নেওয়া এক শান্ত, স্থিতধী মিডফিল্ডার। কার্লো অ্যানচেলত্তিও বিস্মিত হতেন, ‘ওর পায়ে বল পড়লে, আমি চুপ হয়ে যাই। ঐ অনুভূতি কোন ভাষায় প্রকাশ করব, তা আমার জানা নেই…’

রিয়াল মাদ্রিদে চোটগ্রস্ত কাকাকে ক্রিশ্চিয়ানো অনেক পেনাল্টি মারতে দিতেন। শুধু অফফর্ম ফেরানোর জন্য। অথচ আজও মনে হয় প্রতিবার, রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়া কাকার জীবনে সবচেয়ে ভুল ডিসিশন। সেই তো ফেরত আসতেই হল মিলানে। সেই শেষ। যেমন শেষ হয়েছিল ডারবানে স্নেইডারের হেডে। ভাগ্যিস, বিপর্যয়ের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের টিমে কাকা অন্তত ছিলেন না!

কাকাকে নিয়ে এই প্রেম কাভি আলবিদা বলবে না। ফুলের কুঁড়ি ফোটার মূহূর্তে সামনে সূর্যালোক থাকলে, আজীবনের জন্য তাকেই নতমস্তকে ভালবাসতে হয়। যে মানুষটা ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে গিয়ে অঝোরে কাঁদেন, যার ফুটবলার হওয়ার কথাও সেভাবে ছিল না। হৃদয়মাঝে তার চিরকালীন বাস। আশৈশবের ভালবাসার নাম রিকার্ডো কাকা।

আর, ভালবাসা একতরফা তো হয়েই থাকে। ক’জন আর হৃদয় দিয়ে ভালবাসতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link