রাতের আকাশে উঁকি মারলে চোখে পড়ে লক্ষ কোটি তারকার আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে আমাদের এই পৃথিবী। এই লক্ষ কোটি তারকার মাঝে একটির নাম ‘সাইরিয়াস’, যেটি পৃথিবীর আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম তারা। সৌরমন্ডল থেকে প্রায় ৮ দশমিক ৬ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই তারকাটি তার আপন আলোয় পৃথিবীর আকাশকে আলোকিত করে।
১৯৭৩ সালে ভারতের আরব সাগর তীরবর্তী শহর মুম্বাইয়ের আকাশে একটি তারকার আবির্ভাব হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে মুম্বাই, ভারত ছাপিয়ে সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বকে আলোকিত করেছিলো। না, এই তারকাটির নাম সাইরিয়াস নয়, এই তারকাটির নাম শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।
১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল পিতা রমেশ টেন্ডুলকার এবং মাতা রজনী টেন্ডুলকারের ঘর আলোকিত করে এই পৃথিবীতে আসেন শচীন টেন্ডুলকার। বিখ্যাত সুরকার শচীন দেব বর্মনের নামানুসারে তার নাম রেখেছিলেন তার বাবা। শচীনের বাবা হয়ত ভেবেছিলেন তার ছেলে বড় হয়ে শচীন দেব বর্মনের মতো সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখবে গোটা দেশ।
কিন্তু, বিধাতা তার গল্পটা যে অন্যভাবে লিখে রেখেছিলেন। তাইতো শচীন সঙ্গীত জগতে না আসলেও ক্রিকেট মাঠ ভরিয়েছিলেন তার ব্যাটে তৈরী সুরের মূর্ছনায়। বাবা রমেশ টেন্ডুলকারের তাই হয়ত এটা নিয়ে কোনো আফসোস থাকারই কথা নয়।
কিন্তু যেই শচীনের ব্যাটে হাজার হাজার রান শত শত রেকর্ড নূইয়ে পড়েছে একদম ছোটবেলায় সেই শচীনই হতে চেয়েছিলেন একজন টেনিস খেলোয়াড়। যদিনা তার ভাই অজিত টেন্ডুলকার তাকে শিবাজি পার্কের বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ রমাকান্ত আচরেকারের কাছে নিয়ে না যেতেন তাহলে হয়ত ২২ গজের বদলে শচীন তার অমরত্মের গল্প লিখতেন কোনো টেনিস কোর্টে, উইলোর বদলে র্যাকেট হাতে ছড়াতেন রেকর্ডের ফুলঝুরি । তাইতো একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে শচীনের ভাই অজিত আপনার কাছ থেকে একটি ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
ক্রিকেটে শচীনের শুরুটা হয়েছিলো বিস্ময় বালক হিসেবে, ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে অসাধারন পারফর্মেন্স এবং ১৯৮৮ সালে স্কুল ক্রিকেটে বন্ধু বিনোদ কাম্বলীর সাথে ৬৬৪ রানের পার্টনারশিপ এই সবকিছুই নির্বাচকদের বাধ্য করেছিলো ১৯৮৯ সালের সেই সিরিজে মাত্র ১৬ বছরের কিশোর শচীন টেন্ডুলকারকে পাকিস্তানে উড়িয়ে নিতে।
২৪ বছরের অবিস্মরণীয় ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিলো ওয়াকার ইউনুসের এক বাউন্সারে করাচির মাঠে লুটিয়ে পড়ে, সবাই ভেবেছিলো এই ছেলে হয়ত রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়বেন কিন্তু ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান সহ সবাইকে তাক লাগিয়ে তিনি আবার উঠে দাঁড়ালেন আর আভাস দিলেন সামান্য বাউন্সারের আঘাতে তিনি দমে যেতে আসেন নি, দুর্গম গিরি কান্তার-মরু পাড়ি দিতেই তিনি এসেছেন।
সেই থেকে শুরু, পরের ২৪ টা বছর শচীনের উইলোকে রুখতে পারেনি কেউই, ওয়াশিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস থেকে শুরু করে ওয়ালশ, অ্যামব্রোস, ম্যাকগ্রা, অ্যালান ডোনাল্ড কিংবা শোয়েব আখতার, ব্রেট লি, এন্ডারসন অথবা ডেল স্টেইন সময়ে সময়ে কত কত সেরা বোলার এসেছে কিন্তু শচীন তার জায়গায় ছিলেন অবিচল। শচীনের ব্যাটিং ছড়াতো মুগ্ধতা, শচীনের ব্যাটিং জাগাতো মায়া, যেই মায়ায় মোহাবিষ্ট থাকতো দর্শক, সমর্থক, প্রতিপক্ষ সবাই। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানেরও অধিকাংশ ক্রিকেটার একবাক্যে শচীনের শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নেয়।
অজি গ্রেট মার্ক ওয়াহ তাই একবার বলেছিলেন ‘প্রতিপক্ষ হলেও শচিনের বিরুদ্ধে যখন খেলবেন, আপনি চাইবেন যেন ও কিছু রান করে। যাতে আপনি ওঁকে ব্যাটিং করতে দেখতে পারেন।’ এখানেই শচীনের বিশেষত্ব আলাদা। কেউ চাইলেও তাকে ঘৃণা কিংবা অপছন্দ করতে পারবে না, খেলোয়াড় কিংবা মানুষ দুই জায়াগাতেই শচীনের তুলনা শচীন নিজেই।
এমনকি প্রবাদপ্রতিম স্যার ডন ব্র্যাডম্যান শচীনের খেলায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘টিভিতে ওর খেলা দেখে আমি স্ত্রীকে বলেছিলাম, এই ছেলেটা প্রায় আমার মতোই খেলে।’
যাকে তার সময়ে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবা হতো সেই ব্রায়ান লারা শচীনের সঙ্গে তার তুলনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘শচীন জিনিয়াস। আমি তো সামান্য মানুষ মাত্র।’
আসলে শচীনের গ্রেটনেস আর অর্জনের পাল্লা এতটাই ভারী যে, এইসব উক্তি গুলো নিতান্তই সামান্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৪০০০ এরও বেশি রান, ১০০ খানা সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান, ৬৬৪ টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ এমন আরো অসংখ্য অগনিত রেকর্ড আর অর্জন তো সমগ্র ক্রিকেট ইতিহাসে আর কারো নামের সঙ্গেই নেই।
অপূর্নতা ছিল শুধু একটি বিশ্বকাপের, ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে নেমে সেই আক্ষেপও ঘুচিয়েছেন ২০১১ সালে। তাইতো ক্রিকেট আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম তারকা হিসেবে “সাইরিয়াস” নামটা শচীনের নামের সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া যায়।
১৯৮৯ থেকে ২০১৩, টানা ২৪ বছর ফর্ম আর ফিটনেস ধরে রেখে খেলে যাওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়, শচীন পেরেছিলেন। প্রতিভা, পরিশ্রম, একাগ্রতা আর অধ্যাবসায় এর সংমিশ্রণে শচীন হয়েছেন লিটল মাস্টার, মাস্টার ব্লাস্টার। বাবার উপদেশ ভীষণ মেনে চলতেন শচীন, তার বাবাই তাকে শিখিয়েছিলেন ‘সাফল্যের কোনো শর্টকাট হয় না’ এই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন ক্যারিয়ারের শেষ দিন পর্যন্ত।