সময়টা ২০০০ সাল, ইংল্যান্ডে শুরু হয় এক নতুন ত্রিদেশীয় সিরিজ। সেই সিরিজের স্পনসর ছিল ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ওয়েস্টমিনস্টার ব্যাংক। আর সেই সুবাদে সিরিজের নামকরণ হয় ‘দ্য ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ’।
এর সূচনা হয় ২০০০ সালে। ফরম্যাট ছিল ওয়ানডে। ২০০৫ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজ ফরম্যাট থেকে সরে আসা হয়। এই সিরিজের স্বাগতিক দল ইংল্যান্ড আর বিপক্ষ দল হিসেবে দু’টি আন্তর্জাতিক দল থাকে। টোটাল ১০টা ম্যাচ হয় সিরিজে এবং সেই দশটি ম্যাচ হয় সাতটা স্টেডিয়াম মিলিয়ে। আর সেগুলো হলো লর্ডস, এজবাস্টন, হেডিংলি, ওল্ড ট্রাফোর্ড, ওভাল, ট্রেন্ট ব্রিজ ও রিভারসাইড গ্রাউন্ডে।
প্রথম ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ হয় ২০০০ সালে। এর আগের বছর ইংল্যান্ড আয়োজন করেছিলো নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ৷ প্রথম ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে ভিজিটিং দেশ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ে। ফাইনাল ম্যাচ হয় ইংল্যান্ড আর উইন্ডিজের মাঝে। সেই ম্যাচে অ্যালেক স্টুয়ার্ট এর ৯৭ আর ড্যারেন গফের ২০ রানে ৩ উইকেটের বিনিময়ে জয় লাভ করে ইংল্যান্ড।
লর্ডসের মাঠে সেসময় একটা রীতি ছিলো যে, কোনো ম্যাচ শেষে দর্শকরা মাঠে নেমে যেত প্যাভিলিয়নের বারান্দায় অনুষ্ঠিত পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান দেখার জন্য। কিন্তু ২০০১ ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালের পর যখন এক ব্যাক্তি আহত হয় মাঠে তখন থেকে এই রীতি পরিবর্তন করা হয়।
এছাড়াও সেদিন প্রেজেন্টেশন অনুষ্ঠানের সময় প্যাভিলিয়নে থাকা মাইকেল বেভান দর্শকসারি থেকে ছুঁড়ে মারা এক বিয়ারের ক্যানের আঘাতে আহত হন। এরপর থেকে পোস্ট-ম্যাচ প্রেজেন্টেশন মাঠে হয় আর দর্শকরা গ্যালারিতে থাকে।
২০০২ এর ন্যাটওয়েস্টের ফাইনালকে বলা হয় ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ইতিহাসের সেরা ম্যাচ। সেদিন লর্ডসের প্যাভিলিয়নের ড্রেসিং রুমের বারান্দায় সৌরভ গাঙ্গুলির জার্সি খুলে উল্লাসের চিত্র কেউই ভূলবে না হয়তো। প্রথমে ব্যাট করে নাসের হুসাইনের ১১৫ আর মারকিউস ট্রেসকোথিকের ১০৯ রানে ভর করে ৩২৫ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড। জবাবে মোহাম্মদ কাইফের ৮৭ আর যুবরাজের ৬৯ রানে ভর করে তিন উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয় ভারত।
২০০৫, মোহাম্মদ আশরাফুলের কার্ডিফ কাব্য। সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া বধ করেছিলো বাংলাদেশ। তবে ফাইনালে খেলেছিলো অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। আর সেই ফাইনালের ফলাফল থাকে অমিমাংসিত। দুই দলকেই ঘোষণা করা হয় চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। আর ২০০৫ এর এই নেটওয়েস্ট সিরিজই ছিলো শেষ ত্রিদেশীয় সিরিজ।
- ন্যাটওয়েস্ট চ্যালেঞ্জ
২০০৩ থেকে ২০০৫। তিন সিজনে ট্রাই নেশন সিরিজের পাশাপাশি তিনটা বাড়তি তিনটা ওয়ানডে আয়োজন করা হয়। ২০০৩ সালে সেই তিন ম্যাচ খেলে পাকিস্তান, ২০০৪ সালে খেলে ভারত আর ২০০৫ এ খেলে অস্ট্রেলিয়া। ২০০৫ এর সেই ম্যাচে গুলোতেই আইসিসি সুপার সাব অর্থাৎ দ্বাদশ খেলোয়াড়ের রীতি শুরু করে সাথে পাওয়ার প্লে’র নিয়ম। ন্যাটওয়েস্ট চ্যালেঞ্জের তিনটি সংস্করণের দুটিতে জয়ী হয় ইংল্যান্ড, আরেকটাতে অস্ট্রেলিয়া।
২০০৬ ত্রিদেশীয় সিরিজের ফরম্যাট পাল্টানো হয়। ইংল্যান্ডের পরিবর্তে দু’টি আন্তর্জাতিক দেশকে স্বাগতিক করে তাদের বিপক্ষে আলাদা আলাদা সিরিজ খেলে৷ যেটা তারা করেছিলো ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত চলা ট্যাক্সেকো ট্রফিতে। তারা ফরম্যাট পরিবর্তন করলেও নাম রেখে দেয় ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ হিসেবে।
দুই সিরিজ মিলিয়ে মোট ১০ টি ওয়ানডে খেলা হয় সাথে টি-টোয়েন্টিও রাখা হয়। ২০০৬ সালে প্রথম সিরিজ খেলে শ্রীলঙ্কার সাথে যেখানে ইংল্যান্ড ৫-০ তে সিরিজ হারে এবং দ্বিতীয় সিরিজ খেলে পাকিস্তানের সাথে সেখানে ২-২ ড্র করে। ২০০৭ এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর কাছে তিন ম্যাচের সিরিজে ২-১ এ পরাজিত হয় আর ভারতকে ৭ ম্যাচের সিরিজে ৪-৩ এ পরাজিত করে ইংল্যান্ড।
- ২০০৮ সিরিজ
২০০৮ এর জুনে তারা নিউজিল্যান্ডের আতিথেয়তা পায় পাঁচ ম্যাচের সিরিজের জন্য। সেই সিরিজে ব্ল্যাক ক্যাপদের কাছে ৩-১ এ সিরিজ পরাজিত হয় ইংলিশরা আরেক ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। ম্যানচেস্টারে একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে জয় পায় ইংল্যান্ড।
সেই বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় যায় ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের জন্য। সেই সিরিজ ইংলিশরা ৪-০ এ জয়লাভ করে। বাকি এক ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়৷
২০০৯ সিরিজ
মে মাসে তারা আনে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। সেই সিরিজ ছিল তিন টি-টোয়েন্টি। উইন্ডিজদের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে ইংলিশরা, বাকি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। সেই সিরিজে কোনো ওয়ানডে ছিল না।
আগস্ট/সেপ্টেম্বরে তারা অস্ট্রেলিয়াকে টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য স্বাগত জানায়। কিন্তু, সেই সিরিজের কোনো ফলাফল হয়নি। তারপর সেপ্টেম্বরে সাত ম্যাচের সিরিজ খেলে অস্ট্রেলিয়ার সাথে যেখানে প্রথম ছয় ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া জিতে আর শেষ ম্যাচ ইংলিশরা। ফলাফল ৬-১ এ পরাজয় ইংল্যান্ডের।
- ২০১০ সিরিজ
২০১০ সালে তিনটি ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ হয়। প্রথমটি হয় জুনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের সিরিজ। সেই সিরিজ ইংল্যান্ড ৩-২ এ জিতে। এরপর জুলাইতে বাংলাদেশ যায় ইংল্যান্ডে এই সিরিজ খেলতে যেটা ছিলো তিন ম্যাচের একটা সিরিজ। সেই সিরিজ বাংলাদেশ ২-১ এ পরাজিত হয়। আর বাংলাদেশ যেই একটি ম্যাচ জিতেছিলো সেটি ছিলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়। এরপর সেপ্টেম্বরে তৃতীয় সিরিজটি হয় পাকিস্তানের বিপক্ষে। যেই সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে স্পট ফিক্সিংয়ের দায় উঠে। পাঁচ ম্যাচের সেই সিরিজ ৩-২ এ জিতেছিলো ইংল্যান্ড।
- ২০১১ সিরিজ
জুন-জুলাইতে পাঁচ ম্যাচের সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড যায় শ্রীলঙ্কা। যেই সিরিজ শ্রীলঙ্কা ৩-২ পরাজিত হয়েছিল। সেই সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল শ্রীলঙ্কান লিজেন্ড সনাথ জয়াসুরিয়ার ৪৪৫ তম ও ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ। সেপ্টেম্বরে আরেক ৫ ম্যাচ সিরিজের জন্য ভারত গিয়েছিলো ইংল্যান্ডে। যেটায় ইংল্যান্ড ৩-০ সিরিজ জিতেছিলো। বাকি দুই ম্যাচের একটা বৃষ্টি আইনে ড্র হয়েছিলো আরেকটা পরিত্যক্ত।
সেই সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে ভারতীয় ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড় নিজের শেষ ওয়ানডে খেলেন। এবং সেই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত টি-টোয়েন্টি ম্যাচটিও ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। আর ২০১২ সালে মাত্র একটি সিরিজ হয় সেটা উইন্ডিজের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের সিরিজ। যেখানে ইংল্যান্ড ২-০ সিরিজ জয় পায়। বাকী এক ম্যাচের কোনো ফলাফল আসেনি।
২০১২ সালেই শেষ ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ হয়। এরপর থেকে আর সিরিজ হয়নি। এটি এমন এক সিরিজ যেখানে জড়িয়ে রয়েছে ক্রিকেটের অনেক ইতিহাস। গাঙ্গুলির লর্ডসের ব্যালকনিতে টি-শার্ট খুলে জয়োল্লাস বা আশরাফুলের সেই অস্ট্রেলিয়া বধ বা পাকিস্তানের স্পট ফিক্সিং ইতিহাস একজন ক্রিকেটপ্রেমী আজীবন মনে রাখবে। ইংলিশ ক্রিকেটের এক ঐতিহ্য এই ‘ন্যাশনাল ওয়েস্টমিনস্টার ব্যাংক সিরিজ’, কিংবা ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ।