তাঁর দর্শন খুব সোজা-আক্রমণ আর আক্রমণ।
তাঁকে চেনা একটু কঠিন। তিনি কখনো ফিটনেস ধরে রাখতে কিলিমাঞ্জারো পর্বতে ট্রেকিং করেন, কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা সাতার কাটেন। এই মানুষটিই আবার অলস রাত্রি কাটান ক্যাসিনোতে; বিয়ারের বোতল আর পোকারে কেটে যায় রাত। কখনো তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। আবার কখনো সামান্য চুল নিয়ে কথা বলতে চটে গিয়ে কেলেঙ্কারি করেন।
তাঁকে চেনাটা একটু কঠিন, তাই না?
তবে পরিচয়টা জটিল কিছু নয়। তিনি জার্মানির একটি যুগের কারিগর। জার্মানদের অস্থির মানসিকতার ব্যতিক্রম হয়ে ১৫ বছর ধরে জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্ব পালন করেছেন এক সময়। সহকারী অধ্যায় হিসাব করলে জার্মান ফুটবল দলে তার বয়স হলো ১৭ বছর।
একটা যুগের চেয়েও বেশি সময়। হ্যাঁ, ‘জোগি যুগ’। জার্মান ফুটবলের জোয়াকিম লো যুগ শেষ হয়েছে তাও অনেকদিন। গেল ইউরোর পর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। শেষ হয় এক ইতিহাসের। কিন্তু, তার রেশ এখনও আছে।
জোয়াকিম লো একেবারে চেহারা দেখিয়ে এই ১৫ বছর ধরে জার্মান দলের দায়িত্বে ছিলেন, তা নয়। শতকরা হিসেবে হিসেবে তিনি জার্মানির ইতিহাসের সবচেয়ে সফল কোচ। সে হিসেবের বাইরে বস্তুগত প্রাপ্তিও কম নয়। একটা বিশ্বকাপ এবং একটা কনফেডারেশন্স কাপ জিতে দিয়েছেন তিনি জার্মানিকে; রানার্সআপ হয়েছেন ইউরোতে।
আবার উল্টো পিঠও আছে। গত বিশ্বকাপে তারকাখচিত দল নিয়ে প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছেন লো। তারপরও জার্মান ফুটবল ফেডারেশন অবিশ্বাস্যভাবে তার ওপর আস্থা রেখেছে। এই বিশ্বাসই লোর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
ছোটবেলা থেকেই ফুটবল পাগল ছিলেন। স্কুলে দলের হয়ে খেলতে গিয়ে নিজেকে চেনাতে শুরু করেন। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ছিলেন। একটা ভালো সম্ভাবনাও ছিলো তার। ফ্রেইবার্গের হয়ে শুরু করেছিলেন। ঘুরেফিরে সেখানেই ফিরে এসেছেন বারবার। পশ্চিম জার্মানি অনুর্ধ্ব-২১ দলের হয়েও চারটি ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু একটা ইনজুরি শেষ করে দেয় লোর পরের স্তরে খেলার স্বপ্নটা।
২৯ বছর বয়সে কার্যত খেলা ছেড়ে দিতে হয়। তবে ফুটবলটা ছাড়তে চাননি। তাই ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাবে ছোটখাটো দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাত্ত্বিক পড়াশোনা, কোচিং কোর্স চালিয়ে গেছেন। এরই এক পর্যায়ে তাঁর পরিচয় হয়েছিলো ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের সাথে। এই পরিচয়পর্বটা মনে রাখা দরকার। কারণ এটাই পরে তাঁর জীবনের মোড় বদলে দেয়।
কোচ হিসেবে স্টুটগার্ড, ফেনারবাচের দায়িত্ব পালন করেছেন। অস্ট্রিয়াতেও কোচিং করিয়েছেন। কিন্তু এগুলো তাকে হাই প্রোফাইল কোচে পরিণত করতে পারেনি।
২০০৪ সালে তার ভাগ্য বদলে যায়। রুডি ফোলারের বদলে জার্মানি জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন ক্লিন্সমান। আর দায়িত্ব নিয়েই তিনি নিজের প্রধাণ সহকারী হিসেবে বেছে নেন লোকে। ২০০৫ কনফেডারেশন্স কাপ ও ২০০৬ বিশ্বকাপে তৃতীয় হয়ে সন্তুষ্ট থাকে ক্লিন্সমান-লোর দল। কিন্তু তাদের আক্রমনাত্মক স্টাইল সারা দুনিয়ার নজর কাড়ে। ক্লিন্সমান ব্যক্তিগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেও এই স্টাইলটা ধরে রাখার জন্য জোয়াকিম লোকে দায়িত্ব দেয় জার্মান ফুটবল ফেডারেশন।
খুব দ্রুতই লো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। পরের ইউরোতেই তার দল রানার্সআপ হয়। ২০১০ বিশ্বকাপে ভয়াবহ গতি ও পাল্টা আক্রমণের ফুটবল খেলার পরও তৃতীয়। ২০১৪ সালে তার দলের সেরা রূপটা দেখে বিশ্ব। প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দেওয়ার ভয়াবহ এক অভ্যেস তৈরী করে ফেলে মুলার, ক্রুস, খেদিরাদের দলটা। ব্রাজিলকে সেমিফাইনালে ৭-১ গোলে উড়িয়ে দেয় তারা এবং ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয়।
এরপর ২০১৭ সালে এসে কনফেডারেশন্স কাপ জেতে লোর জার্মানি। গত বিশ্বকাপে অবশ্য পারফরম্যান্স ছিলো যাচ্ছেতাই। তারপরও তাঁকে বিদায় করার কথা ভাবেনি জার্মান ফেডারেশন।
জার্মানির ইতিহাসে এর আগে কোনো কোচ এক টানা চার হাজার দিনের ওপরে জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করেননি। সেখানে লো ইতিমধ্যে পাঁচ হাজার দিনের ওপরে কাজ করে ফেলেছেন। এটাই তাঁর সামর্থের সেরা সাক্ষ্য। এখানেই তাঁর কোচিং জীবনের সার্থকতা!