শাস্ত্রী-সহানুভূতি-গৌরব-লক ডাউন

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ‘বায়ো সিকিউর বাবল’ বা ‘জৈব সুরক্ষা বলয়’ শব্দটার সাথে আমরা সবাই এখন পরিচিত। কিন্তু এই বলয়ে যে না থেকেছে, তাঁর কাছে এই শব্দটার পুরো অর্থ বোঝা একেবারেই অসম্ভব। তা অন্য সবার কাছে যেমনই হোক, এই শব্দটার পুরো অর্থ ভারতীয় ক্রিকেটারদের চাইতে ভাল মনে হয় আর কেউই বোঝেনা। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) পর বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি, আর এরপর এই ঘরের মাঠে সিরিজ- ভারতীয় খেলোয়াড়েরা অনেকটা অ্যাকুরিয়ামের ভেতরে রাখা মাছের মত হয়ে গেছেন।

এই জৈব সুরক্ষা বলয় নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। এই এতে অভ্যস্ত হতে পারছেন, কেউ কেউ তো মানিয়ে নিতে না পেরে দল থেকে নামও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু এই জৈব সুরক্ষা বলয়ের কিছু উপকারিতাও দেখছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ রবি শাস্ত্রী। যেমন, রবি শাস্ত্রী মনে করেন এই জৈব সুরক্ষা বলয়ের কারণে খেলোয়াড়েরা আরো কাছাকাছি থাকতে পারছে।

তিনি বলেন, ‘তাঁদের তো আর কোন সুযোগ নেই। পুরো এরিয়াই তাদের জন্যে রেসট্রিক্টেড। তাঁরা কেউ চাইলেও বাইরে বের হতে পারবেনা। যদি তাদের রুমের বাইরে আসতেও হয়, তাহলেও সেটা আসতে হবে টিমমেটদের মধ্যেই। তো যেটা হয়েছে, এটা খেলোয়াড়দের মধ্যে স্বাভাবিক সময়ের চাইতে বেশি যোগাযোগ ঘটাতে পারছে। আর আপনার যখন এত বেশি যোগাযোগ হবে, নিজেদের ক্রিকেট নিয়ে তো কথা হবেই। তো এই যে ক্রিকেট নিয়ে বেশি কথা হওয়া, এটা বেশ ভালই হয়েছে। অন্তত আমার তাই মনে হয়।’

এখন এটা ভারতকে আসলেই সাহায্য করেছে কিনা সেটা অবশ্য ভারতের গত কয়েক মাসের পারফরম্যান্সেই বোঝা সম্ভব। বিশেষ করে যে পরিস্থিতি থেকে বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সফরের কথাই ধরা যাক, ৩৬ রানে অলআউট আর ওয়ানডেতে পর পর দুই হারের পর কি দুর্দান্তভাবেই না ভারত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এরপর ঘরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেও হারের পর দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিরাট কোহলি অ্যান্ড কোং।

এখন করোনা পরবর্তী সময়ে অনেকটা সম্য ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার পর ক্রিকেটাররা মাঠে ফিরেছে। এমন পরিস্থিতিতে কোচের কিছু করণীয় আছে বলেও মনে করেন রবি শাস্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘সবার আগে আপনাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। আমরা অস্ট্রেলিয়াতে টানা দুটো ওয়ানডে হেরে শুরু করেছিলাম। যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকত, কোচ হিসেবে আপনি আক্রমণাত্মক হতে পারতেন। আপনি একেকজনের কাছে গিয়ে আলাদাভাবে বলতে পারবেন – নাও গুছিয়ে নাও। কিন্তু এখন সময়টা ভিন্ন, আমি জানি ক্রিকেটারদের অনেকে লম্বা সময় নিজেদের ফ্লাট ছেড়েও বের হয়নি। তাদের সাথে তাই আমার আচরণ অন্যরকম হতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ভারতে কেউ ফার্মহাউজে থাকে না। কারো কারো বাসাতে অবশ্য জায়গা ছিল, যেমন আমার। লকডাউনে আমি সেই জায়গায় হাটাচলা করেছি, ঘুরেছি। কিন্তু আমার দলে যারা আছে তাঁরা পেশাদার খেলোয়াড়, এদের অনেকেই লম্বা সময় ফ্লাট ছেড়েই বের হতে পারেনি। ভারতে ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় নিয়ম আরো কড়াকড়ি ছিল। লকডাউনেও অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরা অনুশীলন করেছে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তো একজন মানুষ হিসেবে আপনি যখন জানবেন, যে কাজটা আপনি সারাজীবন ধরে করে এসেছেন সেটাই ছয় মাস করতেই পারবেন না এটা আপনার জন্যে দুঃখজনকই।’

‘তো আমি ভালভাবেই জানতাম আমার দলের কিছুটা সময় লাগবে। এখন আমার প্রশ্ন ছিল, ঠিক কত সময় লাগবে? কিন্তু দেখা গেছে খেলোয়াড়েরা খুব বেশি সময় নেয়নি। আমি দেখেছি, এই দলটা জিততেই ভালবাসে। তাঁরা ম্যাচ হারলেও সেই অব্দি অপেক্ষা করতে জানে যতক্ষণ না তাঁরা জিততে পারছে। এছাড়াও যেটা বললাম, লকডাউনের পরেই বিশেষ কিছু করে দেখানো সবসময়ই কঠিন। কিন্তু খেলোয়াড়েরা সেটা পেরেছে। তবে কোচ হিসেবেও আমাকে ধৈর্য্য ধরতে হয়েছে।’ যোগ করেন তিনি।

কোয়ারেন্টিন নিয়ে ভারতীয় দলকে বারবারই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া গিয়ে তো রাহানেরা বলেই ফেলেছিলেন, তাঁরা চিড়িয়াখানার জন্তু নন।  কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতীয় দলই একমাত্র, যারা এই ইস্যুতে এ সময়ে কোন সিরিজ বাতিল করেনি। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও তাই রবি শাস্ত্রী আর তাঁর দল পয়েন্ট টেবিলের ওপরে ওঠার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে।

রবি শাস্ত্রীই যেমনটা বলেছেন, ‘লকডাউনে যখন আমরা বন্দী ছিলাম, আমরা ছিলাম পয়েন্ট টেবিলের মাথায়। কিন্তু আইসিসি হঠাৎ পার্সেন্টেজের নিয়ম করে দিল আর আমরা কোন ধরণের ম্যাচ খেলা ছাড়াই এক সপ্তাহে এক থেকে তিনে নেমে গেলাম। আচ্ছা, এটা মানা গেল যে এটা এ কারণে যে দলগুলো আর ভ্রমণ করতে চাইছিল না। কিন্তু এরপর? এরপর আমাদের বলা হল ফাইনাল খেলতে হলে তোমাদের অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে। অস্ট্রেলিয়া গিয়ে কি করতে হবে? জিততে হবে!’

তিনি আরো বলেন, ‘এখন আপনি আমাকে বলুন গত একশো বছরে, বা গত দশ বছরেও কয়টা দল এভাবে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে গ্যারান্টি নিয়ে জিততে পারে? আমরা তো ৩৬০ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের চূড়াতেই ছিলাম। কিন্তু এরপর পার্সেন্টের সিস্টেম চালু হল, আমাদের অস্ট্রেলিয়াকে হারানো বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। আমরা যদি অস্ট্রেলিয়াকে না হারাতাম, এরপর দেশে ফিরে ইংল্যান্ডকে ৪-০ তেও সিরিজ হারাতাম- আমাদের পয়েন্ট দাড়াত ৫০০ আর আমরা কোয়ালিফাই করতাম না। আমাদের তাই আরো গভীরে যেতে হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। কারণ আমরা ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে চাই – দ্য বিগেস্ট ট্রফি ইন দা ওয়ার্ল্ড।’

তবে রবি শাস্ত্রীর এই ‘বিগেস্ট ট্রফি’ জেতার মিশনে ভারতের সামনে কিন্তু বাধাও ছিল। এর একটা হল ইনজুরি বাধা। সেই ইনজুরি বাধা এতটাই প্রকট ছিল যে অস্ট্রেলিয়ার সাথে শেষ টেস্টটা ভারতকে খেলতে হয়েছিল দুই নবাগত আর আনকোরা এক বোলিং লাইনআপ নিয়ে। তবে এটাতেও বায়ো বাবলের সুবিধা দেখছেন রবি শাস্ত্রী, ‘বায়ো বাবলের আরেকটা সুবিধা হল এখানে একটা বড় স্কোয়াড নিয়ে আসা হয়। এতে করে অনুশীলনে সবাইকে পরখ করে নেওয়া যায়, আবার কেউ ইনজুরিতে পড়লে দ্রুত কাউকে দলে নিয়ে আসা যায়।’

যাক, জৈব সুরক্ষা বলয়ের উপকারিতা কিছু তো পাওয়া গেল!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link