ওয়ানডে সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ দল এই মুহুর্তে অবস্থান করছে নিউজিল্যান্ডে। রস টেলর আর কেন উইলিয়ামসনের দুর্ভাগ্যজনক অনুপস্থিতিতিতে বাংলাদেশের সামনে এবার সুযোগ তাসমানপাড়ে প্রথমবারের মত কোন ম্যাচ জেতার। কিন্তু সেখানে একটা ম্যাচ জেতা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়।
বিশেষত, বিগত কয়েক বছরে যেখানে ভারত ছাড়া আর কোন উপমহাদেশীয় দল এই অসাধ্য সাধন করতে পারেনি। তাছাড়াও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানও বেশ নাজুক। ব্যাটিংয়ে বেশ কিছু দুর্দান্ত ইনিংস থাকলেও বোলিংয়ে বেশিরভাগ সময়ই মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে ব্লাকক্যাপ্স ব্যাটিং অর্ডারের সামনে। তবে, এই ছাইয়ের মধ্যেও আছে বাংলাদেশি বোলারদের কিছু দুর্দান্ত স্পেল। অন্তত না থাকার মধ্যে সেগুলো তো সোনায় সোহাগাই!
- সাকিব আল হাসান (১০-০-৩৩-৪) – ক্রাইস্টচার্চ, ২০১০
২০১০ এর ১১ ফেব্রুয়ারি। তরুণ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের অধীনে সেবার নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম দুই ওয়ানডেতে রীতিমত বিধ্বস্ত হবার পর তৃতীয় ওয়ানডেতে টসে হেরে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। তা ক্রাইস্টচার্চের সেই ছোট মাঠে ইমরুল কায়েসের সেঞ্চুরির সুবাদে স্কোরবোর্ডে বেশ ভাল রানই তুলে ফেলে সফরকারীরা- ২৪১!
নিউজিল্যান্ডকে ২৪২ রানের টার্গেট দিয়ে ফিল্ডিংয়ে নেমে শুরুর ষষ্ঠ ওভারেই ম্যাককালামকে প্যাভিলিয়নে ফেরান রুবেল হোসেন। তবে এরপর বাংলাদেশ আরেকটা ব্রেক থ্রু পায় ইনিংসের ১১ তম ওভারে, পাওয়ারপ্লে শেষে। পিটার ইনগ্রামকে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়ে নিজের উইকেটের খাতা খোলেন সাকিব আল হাসান।
ইনগ্রাম প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলে ক্রিজে আসেন রস টেলর, তা তাকে ফেরাতেও সময় নেননি সাকিব। ১৪ তম ওভারের শেষ বলে সাকিবের স্পিন বুঝতে ভুল করে মুশফিকের স্ট্যাম্পিংয়ে আউট হন রস টেলর। তবে দ্রুত তিন উইকেট পড়ে গেলেও নিউজিল্যান্ড হেসেখেলেই এই ধাক্কা সামলিয়ে উঠছিল। মার্টিন গাপটিল তো রীতিমত ভয়ংকর হয়ে উঠছিলেন। সেই ভয়ংকর গাপটিলকেও ফেরান সাকিব, তবে ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
৩৫ তম ওভারে তামিমের ক্যাচ হয়ে ফেরার সময় গাপটিল খেলে ফেলেছেন ৯১ রানের ইনিংস। এরপর কিছু সময় বাদেই সাকিব তুলে নেন নিল ব্রুমের উইকেট। বাংলাদেশ অবশ্য সে ম্যাচ হেরছিল পাঁচ ওভার আগেই, কিন্তু সাকিব আল হাসানের এই ম্যাচে চার উইকেট নেওয়া এখন অব্দি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের সেরা কোন বোলিং ফিগার!
- সাকিব আল হাসান ( ৮.৫-১-৫৫-৪) – হ্যামিল্টন, ২০১৫
বাংলাদেশ অবশ্য এই ম্যাচ মনে রাখবে অন্য আরো অনেক কারণেই। ইতোমধ্যেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কোয়ালিফাই করে ফেলা দুই দলই ছিল বেশ নির্ভার। তবে বাংলাদেশের জন্যে এ ম্যাচের বিশেষ উপলক্ষ্য বলতে ছিল যে এই ম্যাচের ফলাফলের ওপর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রতিপক্ষ বাছাই হবে।
নির্ভার কিন্তু বিশেষ এই ম্যাচে হ্যামিল্টনে শুরুতেই টসে হেরে ব্যাটিংয়তে আসতে হয় বাংলাদেশকে। টসে হারলেও বাংলাদেশ খুব সম্ভবত এই ব্যাটিংকে বেশ উপভোগ্যই বলবে এখন, অন্তত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তো বলবেনই। বিশ্বকাপের এর আগের ম্যাচেও তিনি সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় নিউজিল্যান্ডের দুর্দান্ত বোলিং লাইনআপকে গুড়িয়ে দিয়ে আবারও তিনি সেঞ্চুরি তুলে নিলে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৭ উইকেট হারিয়ে ২৮৮।
২৮৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ধাক্কা খায় নিউজিল্যান্ড। নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার বিশ্রামে অধিনায়কত্ব করতে নামা সাকিব আল হাসান চতুর্থ ওভারের শুরুতেই নিউজিল্যান্ডের ‘বিগ ফিশ’ ম্যাককালামকে ফ্লাইটে বোকা বানালে দ্রুতই প্রথম উইকেট হারিয়ে ফেলে নিউজিল্যান্ড। শুরুর সেই ধাক্কা সামলাতে নিউজিল্যান্ডকে অবশ্য খুব বেশি সময় দেননি সাকিব। সেই ওভারের পঞ্চম বলেই তামিম ইকবালের ক্যাচ বানিয়ে কেন উইলিয়ামসনকে প্যাভিলিয়নে ফেরালে জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাংলাদেশ।
তবে পাঁচ ওভারের মধ্যেই দুই উইকেট হারিয়ে ফেললেও এবার সবকিছু গুছিয়ে নিতে শুরু করে নিউজিল্যান্ড। লম্বা সময় নিউজিল্যান্ডকে এগিয়ে নেওয়া গাপটিল যেভাবে আগাচ্ছিলেন তখন, বাংলাদেশি বোলাররা একদমই সুবিধা করতে পারছিলেন না। তবে ৩১ তম ওভারে সাকিব আল হাসানকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অনের ফিল্ডারের তালুবন্দী হয়ে গাপটিল ফিরে গেলে আরেকটু আশার আলো দেখে বাংলাদেশ। তবে শেষ অব্দি ঐটুকুই। ৪৫ ওভারে আবারও লুক রংকিকে ফেরালেও শেষ অব্দি ম্যাচটা জিতে নেয় নিউজিল্যান্ড। আর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে পাঁচ বছর পর আবারও চার উইকেটের দেখা পান সাকিব আল হাসান।
- শফিউল ইসলাম (১০-০-৬৮-৪) – নেপিয়ার,২০১০
২০১০ এর সেই নিউজিল্যান্ড সফর, নেপিয়ারের প্রথম ওয়ানডে। টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া নিউজিল্যান্ড সেবার ওপেনিংয়ে পাঠিয়েছিল ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আর পিটার ইনগ্রামকে। তা ম্যাচের চতুর্থ ওভারের প্রথম বলেই নাজমুলের বলে ম্যাককালাম ফিরে গেলে ওপেনিং জুটিতে নিউজিল্যান্ড সে ম্যাচে একেবারেই সুবিধা করে উঠতে পারেনি। নাজমুলের ব্রেক থ্রয়ের পর পাওয়ারপ্লেতেই আঘাত হানেন শাহাদাত হোসেন, ওয়াইডিশ ফুলার লেংথের এক ডেলিভারিতে ড্রেসিং রুমে ফেরান মার্টিন গাপটিলকে। আর এরপরই শুরু হয় লম্বা উইকেট বিরতি।
তবে লম্বা সেই বিরতি ভেঙে বাংলাদেশকে ব্রেক থ্রু এনে দেওয়ার কাজটা করেছিলেন শফিউল ইসলাম। ২১ তম ওভারের শেষ শফিউলের করা ডেলিভারিটা ডিপ পয়েন্ট দিয়ে উড়িয়ে মারতে গেলে ৬৯ রানেই মোহাম্মদ আশরাফুলের তালুবন্দী হন পিটার ইনগ্রাম।
ম্যাচে নিজের প্রথম উইকেট পেয়ে তখন শফিউল বল ছুঁড়তে থাকেন দ্বিতীয় উইকেটের খোঁজে। তা এই খোঁজে অবশ্য শফিউলকে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। এক ওভার পরেই ২৩ তম ওভারের দ্বিতীয় বলে মুশফিকের স্ট্যাম্পিংয়ে ফ্রাংকলিনকে সাজঘরে ফেরান তিনি। এরপর স্লগ ওভারের ৪৭ তম ওভারের প্রথম আর তৃতীয় বলে নিল ব্রুম আর টিম সাউদিকে সাজঘরে ফিরিয়ে নিজের চার উইকেটের কোটা পূরণ করেন তিনি।
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের চার উইকেটের কৃতিত্ব বলতে এই তিনটেই, পাঁচ উইকেটের মাইলফলক এখনও স্পর্শ করতে পারেনি কেউই। তবে এবার আবারও যখন নিউজিল্যান্ড সফরে আছে বাংলাদেশ, অনন্য আর না ছোঁয়া এই কীর্তি কেউ একজন ছুঁয়ে ফেলবেন এমন চাওয়া কোন একজন ক্রীড়ানুরাগী তো করতেই পারে।
সেটা আপনি হলেও ক্ষতি কি!