আমিও তোমাদেরই একজন

একজন ক্রীড়াবিদের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সময় তাঁর তরুণ বয়সটা।

ফুটবলারদের ক্ষেত্রে তো এর সত্যতা আরো তীব্র। ফুটবলাররা তাঁদের ক্যারিয়ারের সেরা সময় পাড় করেন ২০-৩০ বছর বয়সে। এই দশটি বছরই তাঁদের সারা জীবনের পোস্টারের মত কাজ করে। অথচ এই দশটি বছর কোনো দেশকে দেয়ার পরেও একজন ফুটবলারকে অনুভব করতে হয় তিনি বাইরের কেউ, ভিনদেশি কিউ। তিনি যখন গোল করেন, তখন যতটা না আনন্দিত হন তারচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হন। এই বুঝি কেও বলবে, ফরেনার গোল করেছে।

অথচ এই মানুষটাই নিজের সবকিছু ছেড়ে বাকিটা জীবন কাঁটাতে চান এই দেশে। কেননা তিনি ভালোবেসে ফেলেছেন এই লাল-সবুজকে, এখানকার মানুষকে। তিনি এলিটা কিংসলে; বাংলাদেশের নতুন নাগরিক কিংসলে।

একটা মহাদেশ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে খেলতে এসেছিলেন এলিটা কিংসলে। আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া থেকে মাত্র ২১ বছর বয়সে এই ব-দ্বীপে এসেছিলেন আরামবাগের হয়ে খেলবেন বলে। এরপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। তবে ছাড়তে পারেননি এই বাংলার মায়া। এই বাংলাতেই খুঁজে পেয়েছেন প্রথম প্রেম, ভালবাসা ও প্রেয়সী। এখন এই বাংলাদেশই তাঁর নিজের দেশ।

২১ বছরের টগবগে তরুণ এখন ক্যারিয়ারের প্রায় শেষের দিকে। আর হয়তো কয়েকটা বছর। তবে এই কয়েকটা বছরই তিনি লাল-সবুজের হয়ে খেলতে চান। এই দেশটার হয়ে খেলবেন বলে গত পাচ-ছয় বছর ধরে রীতিমত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ঈদের দিন তাঁর ভাই-বোনদের জন্য মা কিনে আনতেন নতুন জামা-কাপড়। আর কিংসলের জন্য মা আনতেন ওই গোল বলটা। সেই মার থেকে এতটা দূরে থাকতেও রাজি তিনি।

ইউরোপের ফুটবলে যদিও এটা বেশ চেনা চিত্র। আফ্রিকার অনেক ফুটবলারই দেশগুলোতে গিয়ে খেলতে যান। তারপর একটা সময় সেই দেশের হয়েও খেলেন অনেকে। সেখানে অবশ্য বেশ শক্তিশালী ফুটবল কাঠামো, অনেক বেশ অর্থ এই ব্যাপারগুলোও থাকে। কিংসলের বেলায় কী আর এসব ছিল? দেশের ফুটবলের কাঠামো কিংবা ফুটবলারদের উপার্জন কোনোটাই কী খুব বেশি আকর্ষনীয়? তবে ভালবাসা কী আর এত সব মানে। ২০১১ সালে আরামবাগের হয়ে খেলতে এসেছিলেন। তারপর মাঝেমাঝে নাইজেরিয়ায় মায়ের কাছে যান,পরিবারের কাছে যান। তবে একেবারে বাংলাদেশ ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেও পারেননা।

এরমধ্যে একবার রামপুরায় এক হোটেলে খেতে গিয়ে খুঁজে পান তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ মানুষটাকে। সেখানেই লিজাকে প্রথম দেখেছিলেন কিংসলি। তারপর হোটেলের এক ওয়েটারকে দিয়ে একটা চিরকুটে নাম আর নাম্বার লিখে দিয়েছিলেন। তবে কয়েকদিন অপেক্ষার পরেও ফোন না আসায় মন খারাপ করে ছিলেন।

এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন একটা ফোন আসে। ওপাশ থেকে একটা মেয়ে বলেন ,’আমি লিজা, হোটেলে যাকে নাম্বার দিয়েছিলেন, চিনতে পারছেন?’

তারপর থেকে কিংসলিকে আর কে পায়। কথা বলতে বলতে আর দশটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মত  অনন্য সাধারণ লিজার প্রেমে পড়ে গেলেন। এরপর দুজনে কিছুদিন চুটিয়ে প্রেম করলে ছিল এক বড় দুশ্চিন্তা। একজন নাইজেরিয়ানকে কী লিজার পরিবার এত সহজে মেনে নিবে। তবে হাল ছাড়েননি লিজা। যেমনটা কিংসলে হাল ছাড়েননি বাংলাদেশের জন্য। শেষমেশ পরিবারের সম্মতিতে দুজনের বিয়ে হয়। ওদের ঘর আলো করে আসে মেয়ে সাফিরা। ওদের ছোট্ট সংসার, ভালবাসার সংসার।

তবে অনেক চেষ্টা করেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাচ্ছিলেন না কিংসলে। তারপর তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেতে হলে নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে। কিংসলে আর কিছু ভাবেননি, দুবার কোনো প্রশ্ন করেননি। নাগরিকত্ব ছেড়ে এসেছেন নিজের মাতৃভূমির। মাকে বলেছেন , ‘যখনই মনে পড়বে টিকিট করে তোমায় দেখতে চলে আসব।’

২০১৫ সালে যেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন তা প্রায় ছয় বছর পর পেয়েছেন। কিংসলের প্রেমিকা, স্ত্রী লিজাও এত বছর ধরে অপেক্ষা করেছেন এই দিনটার জন্য। লিজা স্বপ্ন দেখেন কিংসলে বাংলাদেশের হয়ে মাঠে নামবেন। তাঁদের ছোট্ট মেয়েও চায় বাবা বাংলাদেশের হয়ে খেলুক। বাংলাদেশের ফুটবলেও তো কিংসলের মানের একজন স্ট্রাইকার বড্ড প্রয়োজন। দেশের ফুটবলে স্ট্রাইকার খরা কাঁটাতে কিংসলে হতে পারেন আশীর্বাদের মত। তবে কিংসলে খুব ভালো করে জানেন যে চাইলেই একটা দেশের হয়ে মাঠে নামা যায় না। তাঁকে ঘরোয়া ফুটবলে প্রমান করে তবেই জাতীয় দলে আসতে হবে।

তবে কিংসলি এখন ভীষণ নির্ভার। বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য আর কোনো আইনি জটিলতা নেই। দশ বছর ধরে এখানে খেলার পর নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ,মেয়ে দুজনই জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। তবুও হয়তো কোথাও না কোথাও কিংসলে একটু ভয় পান। লাল-সবুজের হয়ে গোল করার পরেও যদি কেউ বলে উঠে, ‘ওই দেখো ,বিদেশি গোল করেছে।’

অথচ কিংসলে মোটেও আর বিদেশী নন। এই আমার-আপনার মতোই আবেগে ভরা একজন বাংলাদেশী।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link