আধুনিক ক্রিকেটের অগ্রদূত

অবশ্যই আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের শেষ কথা ভিভিয়ান রিচার্ডস।

কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ওয়ানডে ক্রিকেট, আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের কথা এলে এই মানুষটার কথাও বলতে হবে। অনেকে তো তাকে ওয়ানডে ব্যাটিংয়ের অগ্রদূত বলে থাকেন। এই যে ফাস্ট বোলারকে মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা মারা, ঝড়ের গতিতে উইকেটে দৌড়ানো; এসব ব্যাপার তাঁর হাত ধরেই শিখেছে ক্রিকেট বিশ্ব।

হ্যাঁ, ডিন মারভিন জোন্স।

আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের প্রতীক, অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট এবং হালে জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ডিন জোন্স। গত কয়েক বছর ধরে ধারাভাষ্যের কল্যানে নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এই মানুষটি। মুম্বাইতে গত বছর আইপিএলের ধারাভাষ্য দিতে এসেছিলেন। সেখানেই আকস্মিক ভয়ানক হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ৫৯ বছর বয়সী জোন্স।

ডিন জোন্সকে অনেকে অবশ্য মনে রাখবেন তার বিখ্যাত সেই ডাবল সেঞ্চুরির জন্য। চেন্নাইতে ভারতের বিপক্ষে ১৯৮৬ সালে ২১০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন টাই হওয়া টেস্টে। ভয়ানক গরম আর আর্দ্রতা আক্ষরিক অর্থে শেষ করে দিচ্ছিলো জোন্সকে। উইকেটে একাধিকবার বমি করেছেন। এক পর্যায়ে জোন্স অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারকে বলেছিলেন যে, আর পারছি না।

বোর্ডার বলেছিলেন, ‘তুমি যদি না পারো, তাহলে আমি একজন কুইন্সল্যান্ডারকেই ডেকে আনবো কাজটা করতে।’

জোন্স একজন ভিক্টোরিয়ানহিসেবে মোটেও পছন্দ করতেন না যে, বোর্ডারের মত কোনো কুইন্সল্যান্ডারের কাছে হেরে যেতে। ফলে নিজের সাথে লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। এবং ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংসটা খেলেছিলেন।

এর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও একটা ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। তার টেস্ট ব্যাটিংটাও খুব শান্ত ছিলো না। তবে ক্রিকেট ইতিহাস জোন্সকে মনে রাখবে মূলত ওয়ানডে ব্যাটিংয়ের জন্য।

ফাস্ট বোলারের ডেলিভারিতে উইকেট ছেড়ে বের হয়ে আসা কিংবা বাউন্ডারির ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে হুক করে বল পাঠিয়ে দেওয়া; এসব ছিলো তার ট্রেডমার্ক। দুর্দান্ত অ্যাথলেট ছিলেন। ফিল্ডিং আর রানিং বিটউইন দ্য উইকেটে তার প্রভাব পড়তো।

জোন্স তার প্রথম শ্রেনীর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন শেফিল্ড শিল্ডে ভিক্টোরিয়ার হয়ে। এরপর নব্বই দশকে ডারহাম ও ডার্বিশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলেছেন। ১৯৯৬ সালে ডার্বিশায়ারকে কাউন্টিতে রানার্সআপ করেছিলেন; আগের ৬০ বছরে যেটা ডার্বিশায়ার কখনো করতে পারেনি। সেই মৌসুমে জোন্স সর্বোচ্চ ১৩৩৮ রান করেছিলেন।

জাতীয় দলে যে নিজের এই রূপটা দেখাবেন, সেটা তখনও ঠিক প্রমাণ হয়নি।

১৯৮৩-৮৪ গ্রীষ্মের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়া দল মূলত গ্রেগ চ্যাপেলের একজন বদলী খুজছিলো। অবসরে যাওয়া এই কিংবদন্তীর ফাকা চেয়ারে বসার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিলো ভিক্টোরিয়ার তরুন প্রতিভা জোন্সকে।

তবে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারটা নাটকীয় ছিলো। গ্রাহাম ইয়ালপের ইনজুরিতে দলে ডাক পেলেন। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একাদশে তার থাকার কথা ছিলো না। একেবারে খেলা শুরুর আগে স্টিভ স্মিথ অসুস্থ হয়ে পড়লেন; সে আরেক স্টিভ স্মিথ। জোন্স নিজে আগের রাতে খুব অসুস্থ ছিলেন। তারপরও সুযোগ নিতে মাঠে নেমে যান। ৪৮ রানের একটা ইনিংস খেলেন। যেটাকে জোন্স প্রায়শ তার ক্যারিয়ারের সেরা নক বলতেন।

অস্ট্রেলিয়া তার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলো।

এই বিশ্বাাসের দারুন প্রতিদান দিয়েছেন তিনি। ৫২ টেস্টে ৪৬.৫৫ গড়ে ৩৬৩১ রান করেছেন। ১৬৪ ওয়ানডেতে ৪৪.৬১ গড়ে রান করেছেন ৬০৬৮। সেই আমলে ৭২-এর ওপরে স্ট্রাইক রেট ছিলো।

ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়াকে দারুন একটা রূপ দেখিয়েছিলেন ১৯৮৭ বিশ্বকাপে। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন। সেই বিশ্বকাপে ৩১৪ রান করেছিলেন।

আবার মুদ্রার অন্য পিঠও দেখেছেন জোন্স। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দলের সর্বোচ্চ গড়ে ব্যাটিং করার পরও দল থেকে বাদ পড়েছিলেন।

অবসরের পর বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন, কোচিং করিয়েছেন, বিশ্লেষক হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পিএসএল দল ইসলাবাদের কোচ ছিলেন। ২০১৭ সালে আফগানিস্তানের কোচ ছিলেন স্বল্প সময়ের জন্য। আর ধারাভাষ্য তো দিয়েছেনই।

ধারাভাষ্যকার হিসেবে অবশ্য কয়েক বার বেফাঁস কথা বলে বিতর্ক তৈরি করেছেন। সেটা তাঁর পুরো ক্যারিয়ারের সাথে কিছুটা মানাসইও বটে। আমৃত্যু ক্রিকেটের সেবক ছিলেন। যে ক্রিকেট দিয়ে মানুষ তাকে চেনে, সেই ক্রিকেটের কাজ করতে করতেই চলে গেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link