মুনাফ প্যাটেলের সহজ একটা ক্যাচ নিলেন চামিন্দা ভাস। শত কোটি ভারতীয়র স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হল। টিভি ক্যামেরায় ভেসে উঠলো রাহুল দ্রাবিড়ের চেহারা, বিষন্ন-ব্যর্থ এক নেতা উত্তর খুঁজছেন। ড্রেসিংরুমে বসে তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। অথচ, সেই ম্যাচেও রান তাড়া করার লড়াইয়ে তিনি চেষ্টা করেছিলেন একাই।
২০০৭ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচ দিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে ভারত। রাহুল দ্রাবিড়ও তাঁর অধিনায়কত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেননি। তবে, রাহুল দ্রাবিড়ের অধিনায়কত্ব বিষয়ক সকল আলোচনা আজকাল সেই বিশ্বকাপ থেকে শুরু হয়, অথচ ওটা ছিল তাঁর শেষ সময় – চূড়ান্ত ব্যর্থতা। নেতা রাহুলের পুরো গল্পটা আদৌ জানা হয় না।
রাহুলে অধিনায়কত্ব ভাল নয় – সেই মিথটা ভাঙা যায় কি না দেখা যাক।
- রঙিন পোশাক
ওয়ানডেতে ৭৯ টি ম্যাচে অধিনায়ক ছিলেন দ্রাবিড়। ভারত ৪২ টিতে জিতেছে, ৩৩ টিতে হেরেছে। জয়ের রেট এখানে ৫৩.২%, আর এটা স্বয়ং সৌরভ গাঙ্গুলির চেয়েও ভাল যিনি নি:সন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, রাহুলের প্রায় দ্বিগুণ পরিমান ম্যাচে নেতৃত্ব দেন সৌরভ।
শুধু জয়ের হার নয়, দ্রাবিড়ের প্রাপ্তি আছে আরো। তিনি রান তাড়া করার মানসিকতাটা গড়ে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর অধীনে রান তাড়ায় ভারতের রেকর্ড ছিল ২৩-১৪, যেটা সৌরভের যুগের চেয়ে এগোনো ছিল। সৌরভের সময় এই রেকর্ডটা ছিল ২৩-৩২।
রাহুলের সময় মহেন্দ্র সিং ধোনি ও যুবরাজ সিংয়ের মত ক্রিকেটাররা নিজেদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভাল সময়ে ছিলেন বলে কেউ কেউ বলেন। তবে, এটা ঠিক যে দু’জনই কম বেশি প্রিন্স অব ক্যালকাটার আবিস্কার।
দ্রাবিড়ের অধীনে যুবরাজ সিংয়ের ওয়ানডে ব্যাটিং গড় ৪৪, আর গোটা ক্যারিয়ারে গড় ৩৬। ধোনির আস্তে আস্তে ম্যাচ ফিনিশার হওয়ার শুরুটাও রাহুলের অধীনে। রাহুলের নেতৃত্বে ভারত টানা ১৪ টা ম্যাচ রান তাড়া করে জেতার অনন্য কীর্তি গড়ে। এই পুরো প্রক্রিয়াতে অধিনায়কের একদম ভূমিকা নেই – সেই ভাবনা ভাবা ঠিক না।
বলা হয়, ২০১১ বিশ্বকাপে জয়ের ভিত্তিপ্রস্তরটা সৌরভের হাতে গড়া। সেটা অবশ্যই ঠিক। তবে, সেই বিশ্বকাপে খেলা গৌতম গম্ভীর, সুরেশ রায়না ও মুনাফ প্যাটেল ধারাবাহিক ভাবে পারফর্ম করেন রাহুলের নেতৃত্বেও। ফলে, এখানে সামান্য পরিমানে হলেও কৃতীত্ব কিছুটা রাহুল দ্রাবিড়েরও প্রাপ্য।
- সাদা পোশাক
কাগজে কলমে দেখলে, এখানে দ্রাবিড়ের জয়ের হার কম। বিশেষ করে দেশের মাটিতে তাঁকে ব্যর্থই বলতে হয়। কারণ, ভারতে বসে কেবল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ জিততে পারেন ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ওয়াল’।
তবে, বিদেশের মাটিতে দেখলে চিত্রটা একটু হলেও পাল্টায়। দেশের বাইরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড – মোট চারটি দেশে ভারতের টেস্ট অধিনায়কত্ব করেন দ্রাবিড়। সেখানে ১২ টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র দু’টিতে হারে ভারত।
বিদেশের মাটিতে খেলানোর জন্য আলাদা টেস্ট দলের ভাবনাটা দ্রাবিড়ের মস্তিষ্কপ্রসুত। যদিও, ২০০৭ বিশ্বকাপের ব্যর্থতা সেই ভাবনায় পানি ঢেলে দেয়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ভারত তো বটেই, আজকাল যেকোনো টেস্ট দলের জয়কেই খুব স্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে। তবে, রাহুল দ্রাবিড় যখন ভারতকে জেতান, তখন সেটা ১৯৭১ সালের পর যেকোনো ভারতীয় দলের প্রথম সিরিজ জয় ছিল। আর সেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ওই দ্রাবিড়ই। শেষ টেস্টের দুই ইনিংসে করেন যথাক্রমে ৮১ ও ৬৮ রান।
এরপর ভারত যায় দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। তখনও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ভারতের কোনো জয় ছিল না। তবে, প্রথম টেস্টেই জোহানেসবার্গে ১২৩ রানে স্বাগতিকদের হারিয়ে নতুন ইতিহাসে গড়েন রাহুল দ্রাবিড়রা। সেই সিরিজে ২-১ ব্যবধানে জিতে ভারত। ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য সেটা নি:সন্দেহে খুব গর্বের একটা সময়।
তবে, এর চেয়েও দারুণ সময় ছিল ২০০৭ সালের ইংল্যান্ড সফর। ওই বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পরই ইংল্যান্ডে যায় দ্রাবিড় বাহিনী। ২০০৭ সালের আগে যে ১৪ টা টেস্ট ইংল্যান্ডের মাটিতে খেলেছিল ভারত, তাতে জিতেছিল মাত্র দুটিতে। ইংল্যান্ড জিতেছিল ১১ টিতে।
ইংলিশ আধিপত্য সেবার রাহুল দ্রাবিড়ের দল ভাঙতে পেরেছিল। প্রথম ও শেষ টেস্ট ড্র হয়, মাঝের টেস্টটা ভারত জিতে সাত উইকেটের বড় ব্যবধানে। অজিত ওয়াদেকারের পর দ্বিতীয় ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জেতেন রাহুল দ্রাবিড়। পতৌদি ট্রফিটা হাতে নিয়েই অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ার শেষ করেন দ্রাবিড়।
দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়নি দ্রাবিড়ের। সেখানে গেলে তাই কি হতে পারতো, সেটা বলা যায় না!
পরিসংখ্যান কিংবা অর্জন – যেকোনো বিবেচনাতেই হয়তো রাহুল দ্রাবিড় ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের কাতারে আসবেন না। তবে, তাঁর অর্জনের খাতাটা একেবারে শূন্য নয়। তাই, অধিনায়ক হিসেবে একদম ফেলে দেওয়ার মতও কেউ নন তিনি । সৌরভ গাঙ্গুলি, মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট কোহলি কিংবা মনসুর আলী খান পতৌদিদের হৃদয়ে ধারণ করা হয় নেতা হিসেবে, সেই হৃদয়টা একটু হলেও ছুঁয়ে দিতে পারেন ‘নেতা রাহুল দ্রাবিড়’ও!