‘ক্রিকেট অবকাঠামোতেই সমস্যা’

১০ জানুয়ারি ২০০৫, ঘড়ির কাটা দুপুর একটা ছুঁইছুঁই।

সবার চোখ চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জেতার জন্য তুলে নিতে হবে জিম্বাবুয়ের আর মাত্র এক উইকেট। তখনই বাঁ-হাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়রের বলে পয়েন্টে দাঁড়ানো মোহাম্মদ আশরাফুলের হাতে ক্যাচ দিলেন ক্রিস্টোফর এমপফু। আশরাফুল ক্যাচ ধরার সাথে সাথেই উৎসবের রঙ ছড়ালো পুরো বাংলাদেশে। সমাপ্তি হলো ৫ বছর আর ৩১ পরাজয়ের বেদনার গল্পের। কিন্তু কে জানতো পরের ১৫ বছরেও সেই পরাজয়ের গল্প গুলোরই পুনরাবৃত্তি হবে বার বার। পরের ১৫ বছরে ৯০ টেস্ট খেলে বাংলাদেশ জিততে পারবে মাত্র ১৩ ম্যাচ। যে ভাবেই হোক এটাই এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের চরম বাস্তবতা।

কেনো আমাদের টেস্টে কাঙ্খিত উন্নতি হলো না, সমস্যটা কোথায়, টেস্ট জিততে কি করতে হবে; এই সব কিছু নিয়েই খেলা ৭১ এর সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলাদেশের সেই প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক, প্রথম টেস্ট জয়ের ম্যাচ সেরা এনামুল হক জুনিয়র।

আপনার হাত ধরে ২০০৫ সালে টেস্টে প্রথম জয় পেয়েছিলো বাংলাদেশ, এরপর কি ভেবেছিলেন পরের ১৫ বছরে মাত্র ১৩ টা টেস্ট জিতবে বাংলাদেশ?

অবশ্যই না, যে ভাবে উন্নতি হওয়ার কথা ছিলো সে ভাবে হয়নি। অবশ্যই হতাশাজনক, আমাদের আরো বেশী টেস্ট জেতা উচিত ছিলো।

প্রথম টেস্ট জয়ের পর থেকে টেস্টে আমাদের সার্বিক অবস্থাটা কোথায়। টেস্টে বাংলাদেশের উন্নতিটা আসলে কতটুকু হয়েছে?

আমাদের উন্নতির গ্রাফটা নিচের দিকে। আসলে আমরা টেস্ট ক্রিকেটকে কম গুরুত্ব দিয়েছি। যদি আমরা টেস্টকে গুরুত্ব দিতাম তাহলে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে একটা ভালো অবকাঠামো গড়ে উঠতো। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের অবকাঠামো গড়ে না ওঠার কারণেই আমাদের টেস্টে এই অবস্থা। সত্যি কথা বলতে আমরা সাদা বলের ক্রিকেটকে একটু বেশী গুরুত্ব দিয়েছি। সেটার কারণ হলো আমরা সাদা বলে কিছু সাফল্য পেয়েছি। যেটাকে আপনি কম গুরুত্ব দিবেন সেটার ফলাফল এমনই আসবে। আমরা টেস্টকে সে ভাবে প্রাধান্য দেইনি।

শুধু এ জন্যই কি আমরা টেস্টে ভাল করতে পারছি না?

হা এটাই মূল কারণ, আমরা অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। মূল কারণ সেটাই।

টেস্টে কাঙ্খিত উন্নতি না হওয়ার পিছনে ঘরোয়ার ক্রিকেটের দায় কতটুকু। ঘরোয়া ক্রিকেটের মান ও উইকেট নিয়ে তো প্রশ্ন ওঠে নিয়মিতই।

হা, ভালো মানের উইকেট হয়নি, এরপর চার দিনের ম্যাচ যে ভাবে হওয়ার কথা সেটাও হয়নি। চার দিনের ম্যাচ তো আমরা কমই খেলি। শেষ কয়েক বছরে অবশ্য চার দিনের ম্যাচ তুলনামূলক একটু বেশীই খেলা হচ্ছে। ক্রিকেটাররা মনোযোগ দিয়ে খেলছে। এখন সিরিয়াস ক্রিকেটই হচ্ছে শেষের তিন চার বছর ধরে। চার দিনের ম্যাচ যদি এভাবে চলতে থাকে, গত তিন বছর ধরে যে ভাবে হচ্ছে। এবং উইকেটকে যে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, আশা করি আগামী পাঁচ বছর পর টেস্টে ভালো খেলতে পারবে বাংলাদেশ।

আমরা সবাই জানি আমাদের স্পোর্টিং উইকেট দরকার, আবার কোথাও কোথাও ঘাসের উইকেটও খুব জরুরি, কিন্তু এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে না কেন?

ঘাসের উইকেট জরুরি অবশ্যই, মাঠেরও সমস্য। আর উইকেটের ধরণ নিয়ে সে ভাবে কাজ করা হয়না। এই সব বিষয়ে আসলে আমাদের ইচ্ছে থাকতে হবে। কি ভাবে উইকেট বানাবো, কি ভাবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকে প্রোমোট করবো।

জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলতেই চায়না। এদের মাঠে ফিরিয়ে কি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট আকর্ষণীয় ও প্রতিদ্বন্দ্বীতপূর্ণ করে তোলা সম্ভব?

জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা অনেক বিজি থাকে। ওদের দিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট চিন্তা করলে আগানো যাবে না। বাকি যারা আছে তাদের নিয়ে কি ভাবে উন্নতি করা যায় সেটা চিন্তা করতে হবে। এর ভিতর দুই একটা ম্যাচ সুযোগ পেলে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা খেলবে। ঘরোয়া ক্রিকেট ঘরোয়া ক্রিকেটের জায়গাতে। জাতীয় দল জাতীয় দলের জায়গাতে। এরকম ঠিক রেখে কি ভাবে উন্নতি করা যায় সেটা চিন্তা করতে হবে।

তাহলে ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি করতে বা আকর্ষণীয় ও প্রতিদ্বন্দ্বীতপূর্ণ করতে কোন কাজটা করা সবচেয়ে বেশী জরুরি?

ভালো মানের উইকেট, ভালো বেতন দেওয়া। ম্যাচ ফি বাড়ানো। স্পোর্টসিং উইকেটে খেলানো। এভাবে উন্নতি করা সম্ভব।

সাকিব-তামিম-মুশফিক এদের হাত ধরে আমরা একটা সোনালী প্রজন্ম পার করার পরেও টেস্টে কাঙ্খিত উন্নতি হয়নি। তাহলে এরা অবসরে গেলে কি টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থার আরো অবনতি হবে?

অবশ্যই স্ট্রাগল করবে। মুশফিক, সাকিব, তামিম তো এক দিনে হয়নি। আমরা যদি এখন বয়সভিত্তিক দলের খেলা বাড়াই, এ টিমের খেলা বাড়াই, প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ বেশী আয়োজন করি তবে দ্রুত ওদের গ্যাপটা পূরণ হবে। প্রতিটা দেশেরই এরকম হয়। কাজ হলো যত দ্রুত সম্ভব গ্যাপ পূরণ করা।

আপনি যেহেতু এখনো ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছেন সেহেতু পাইপলাইনের ক্রিকেটারদের খুব কাছ থেকেই দেখছেন। পরবর্তী প্রজন্মের দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট নিয়ে ভাবনা কতটুকু?

ওদের ভাবনার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিসিবি কি ভাবছে। বিসিবি ওদের কিভাবে প্রোমোট করছে। বিসিবি ওদের খেলা নিয়ে কি ভাবছে। যতো বেশী ওরা এইচপিতে ম্যাচ খেলবে, বাইরের দেশের সাথে খেলবে, ততোই উন্নতি হবে। এখন এ টিমে একটা গ্যাপ হয়ে গেছে আমাদের। এটা আবার চালু করতে হবে।

এখন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী! ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দিকে ঝুকছে তরুণ ক্রিকেটাররা। এটা কি টেস্ট ক্রিকেটের জন্য হুমকি?

মোটেও না, ফ্রাঞ্চাইজি খেললেও উন্নতি হবে। কারণ তখন বিভিন্ন দেশের বড় বড় ক্রিকেটারদের সাথে খেলবে। সহস বাড়বে ওদের। সাথে সাথে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটও ওরা গুরুত্ব দেবে। দুটোই খেলতে হবে। ইন্ডিয়া কিন্তু এভাবেই উপরে উঠে গেছে। আইপিএল আসার পর ওরা অনেক উন্নতি করেছে।

আমাদের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মানও তো প্রশ্নবিদ্ধ, তাহলে পুরো ক্রিকেট সিস্টেমের কি সমস্য?

আগেই তো বললাম, আমাদের মাঠের সমস্যা, উইকেটের সমস্যা, আমাদের কোন ধরনের ঘরোয়া ক্রিকেটেরই কালচার গড়ে ওঠেনি।

সমস্যা কি তাহলে শুধু কাঠামোরই নাকি প্রতিভাবান ক্রিকেটারেরও অভাব রয়েছে?

আমাদের প্রচুর প্রতিভাবান ক্রিকেটার আছে। আমাদের সমস্য কাঠামোতে। কাঠামো ঠিক হয়ে গেলে আর ক্রিকেটাররা ছিটকে পড়বে না। ওরা অবশ্যই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হবে।1

আপনার নিজের টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়েও নিশ্চয় আফসোস হয়। আর কত দিন ক্রিকেট চালিয়ে যেতে চান?

অবশ্যই আফসোস হয়, এখনো খেলছি টিমে ঢোকার জন্যই। আমি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে চাই যতো দিন ফিটনেস আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link