আইসিএল টু আইপিএল; ভায়া আইসিএল!

এখন ওয়ানডে ক্রিকেটেও আপনি স্ট্রাইক রেটের হিসাব কষেন। এখন টেস্ট ক্রিকেটেও আপনি ডট বলে খুশী হয়ে ওঠেন।

ক্রিকেটের ধারণাটাই বদলে গেছে।

দেড় দশক আগের ক্রিকেট আর এখনকার ক্রিকেট এক নয়। মোটা দাগে এই ক্রিকেটকে বদলে ফেলার কাজটা করেছে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট। তবে মানুষের চোখ ও মনকে এই কব্জা করে নেওয়ার কাজটা আসলে করেছে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট; আরও ভালো করে বললে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল।

একটু সাহস করে বলে ফেলা যায় যে, ক্রিকেট বিশ্বকে আপনি দুই ভাগে বিভক্ত করতে পারেন-আইপিএলের আগে ও আইপিএলের পরে।

ডব্লু জি গ্রেস থেকে ডন ব্র্যাডম্যান হয়ে শচীন টেন্ডুলকারদের যে ক্রিকেট, সেখানে ইউরোপিয়ান ফুটবল বা বাস্কেটবলের মতো টাকার ঝনঝনানি ছিলো না। কিন্তু আজকে ক্রিস গেইল, রোহিত শর্মারা যে ক্রিকেট খেলছেন, তা কেবল রান-উইকেটে মাপা যায় না। এখনকার ক্রিকেটের বড় পরিমাপক – ডলার। আইপিএলে কে কত ডলার পাচ্ছেন, তাই দিয়ে ক্রিকেট আর ক্রিকেটারের স্ট্যাটাস তৈরী হচ্ছে।

ফোর্বসের তালিকায় চলে আসছে ক্রিকেটারদের নাম!

আর এই ভয়ানক পরিবর্তনের কাজটা করেছে আইপিএল। আইপিএলকে আপনি পছন্দ করতে পারেন, অপছন্দ করতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন, ভালো বাসতে পারেন; কিন্তু অস্বীকার আর করতে পারবেন না। একবিংশ শতাব্দির ক্রিকেটের নতুন সিম্বল আইপিএল।

সাধারণ ধারণা হলো, সুভাষ চন্দ্রের ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগকে (আইসিএল) দমন করতেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) জন্ম।

সাদা চোখে ব্যাপারটা তাই। কিন্তু এর পেছনে অন্য অনেক বড় একটা গল্প আছে। অন্তত আইপিএলের ‘জনক’ লোলিত মোদি দাবি করেন, সেই নব্বই দশক থেকে একটু একটু করে তৈরী হয়েছে আইপিএলের ধারণা। সে ব্যাপারটা কেমন?

নব্বইয়ের দশকে সাধারণ একজন ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে প্রথমে হিমাচল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হন শিল্পপতির বখে যাওয়া পূত্র লোলিত মোদি। সেখান থেকে বহিষ্কার হলে রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে। সে সময় বিসিসিআইতে চলছে জগমোহন ডালমিয়ার রাজত্ব।

মোদি এসে হাত মেলান কংগ্রেস নেতা ও বিসিসিআই কর্তা শরদ পাওয়ারের সাথে। সেই সময়ই মোদি প্রথম ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ’ নামে একটি ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্টের সুপারিশ করেন। নামটা ঠিকই লেখা হয়েছে। মোদি তখন আইসিএলই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ছিলো ওয়ানডে টুর্নামেন্টের প্রস্তাব।

মোদির প্রস্তাবনা ছিলো যে, বেশ কিছু মালিকানা ভিত্তিক দল এই টুর্নামেন্টে অংশ নেবে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল বা যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএ-এর মত করে কাঠামো হবে। দলবদল, উইন্ডো; এসব থাকবে। ডালমিয়া নিজে অত্যন্ত অর্থমুখী মানুষ ছিলেন। তারপরও ক্রিকেটের এই সংষ্কার মেনে নিতে পারেননি। ফলে লোলিত মোদির এই প্রস্তাব পড়ে থাকে ফাইলবন্দী হয়ে।

এর মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু ভারতীয় বোর্ড এই ফরম্যাটের খেলায় আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি ২০০৬ সালে আর্ন্তজাতিক টি-টোয়েন্টি শুরু হলেও ভারতের তাতে খুব আগ্রহ ছিলো না।

২০০৭ সালেও ভারত এই ফরম্যাটে বিশ্বকাপ খেলতে পাঠায় তাদের তখনকার ‘দ্বিতীয়সারির’ একটা দলকে; প্রায় অপরিচিত এক মহেন্দ্র সিং ধোনিকে অধিনায়ক করে। কিন্তু পুরো চিত্রটাই বদলে যায় ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে মিসবাহ-উল-হক ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হয়ে গেলে; ভারত বিশ্বকাপ জিতে যায়। এক শ কোটি মানুষের দেশে নতুন এক ফরম্যাটের জনপ্রিয়তা শুরু হয়।

এটাকে কাজে লাগাতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আইপিএলের নিবন্ধন সম্পন্ন করে রাখে।

এর মধ্যে আরেকটা ঘটনা ভারতকে কাপিয়ে দেয়। বিসিসিআইয়ের সাথে টিভি স্বত্ত নিয়ে গোলমাল লেগে যায় এসেল গ্রুপের। এসেল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জি এন্টারটেইনমেন্ট আশা করছিলো তারা ভারতীয় ক্রিকেটের প্রচারস্বত্ত পাবে। কিন্তু নানা অজুহাতে টেন্ডারে যোগ্যতম প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও তাদের এই স্বত্ত থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি এসেল গ্রুপের কর্ণাধারণ সুভাষ চন্দ্র। তিনি ঠিক করেন, ক্রিকেটের প্রচার তিনি করবেনই।

আর এ জন্য কয়েকটা দল বানিয়ে তিনি ২০০৭ সালে একটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট চালু করেন-আইসিএল বা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ। এটা ঠিক ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক টুর্নামেন্ট ছিলো না। তবে মডেলটা আইপিএলের মতো শহরভিত্তিক ছিলো।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এই টুর্নামেন্টের সাথে জড়িত সকল ক্রিকেটার, কর্মকর্তাকে নিষিদ্ধ করে। আইসিসির এখানে কিছু বলার ছিলো না। তারা চুপ থাকে। কিন্তু ভারতের প্রবল চাপে বাকী সব বোর্ডও আইসিএল সংশ্লিষ্টদের নিষিদ্ধ করে বসে। ফলে কোনো অন্যায় না করেও আইসিএলের খেলোয়াড়রা ‘নিষিদ্ধ’ বলে তকমা পেয়ে যান।

এই নিষেধাজ্ঞা আসলে যথেষ্ঠ ছিলো না। কারণ, সুভাষ চন্দ্রের যে প্রবল টাকার ঝলকানি তাতে অন্য সব দেশ তো বটেই, ভারতের পক্ষেও তারকা ক্রিকেটারদের ধরে রাখা মুশকিল হতো। এই সময় সমাধান হিসেবে লোলিত মোদি বোর্ডকে বললেন আইপিএল শুরু করতে।

অবশেষে অনেকটাই ইংলিশ প্রিমিয়াল লিগের মডেলে ২০০৮ সালের ১৮ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে আইপিএল। আকাশে উড়তে থাকে টাকা।

এটা এখন সোজা কথা যে, আইপিএল ক্রিকেটের চিত্রটাই বদলে দিয়েছে। আইপিএলের পথ ধরে প্রায় সব দেশে শুরু হয়েছে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট। ক্রিকেটে জোয়ারের মতো ঢুকছে ডলার, রূপী।

হ্যা, ক্রিকেটের অনেক ইতিবাচক বদলও হয়েছে। সারা পৃথিবীতে এখন ভয়ডর হীন ক্রিকেটের একটা জোয়ার তৈরী হয়েছে। ১৮-১৯ বছর বয়সী ছেলেরা এখন গ্যাবায় দাড়িয়ে মাথা উচু করে ছক্কা মারে। তারা এখন বোলারের নাম, গতি কোনো কিছুকে পাত্তা দেয় না। কোয়ালিটি অব ক্রিকেট, বিশেষ করে ক্রিকেটের আক্রমনাত্মক চেহারাটায় অনেক বদল এসেছে।

সেই সাথে উপদ্রব হিসেবে অনেক কিছু এসেছে।

যেখানে যত সহজ টাকার ঝলকানি, সেখানেই অন্যায়ের হাতছানি বেশী। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট, আইপিএল হয়ে উঠেছে তাই স্পট ফিক্সিংয়ের স্বর্গরাজ্য। এটা ঠিক যে আইসিসির ও বিভিন্ন দেশের বোর্ডগুলোও এখন ফিক্সিংয়ের বিপক্ষে অনেক বেশী তৎপর। ফলে ম্যাচ ফিক্সিং ব্যাপারটা উঠে গেছে। আর ম্যাচ পাতানোতে বাজিকরদের লাভও বেশী না। লাভ বেশী স্পট ফিক্সিং, মানে ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে বাজি। আর এখন চলছে সেই স্পট ফিক্সিংয়ের মহামারি।

আইসিসি এ নিয়ে রোজ অভিযান চালাচ্ছে। ভারতীয় পুলিশ একেবার অভিযান চালিয়ে বড় বড় মাছ ধরে ফেলছে। তারপরও থেমে নেই অন্যায়ের তৎপরতা। ফলে আইপিএল ক্রিকেট দুনিয়াকে আরও বেশী বাজিকরদের আকর্ষনে পরিণত করেছে, তাতেও সন্দেহ নেই।

তবে ব্যাপারটা ডায়নামাইটের মতো। এ দিয়ে বিস্ফোরন ঘটিয়ে মানুষও মারা যায়; আবার পথও তৈরী করা যায়। কোনটা করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।

আইপিএল আমাদেরকে সেই প্রশ্নের সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে। ক্রিকেটকে আমরা কোন পথে চালাতে চাই। ক্রিকেট সে পথেই চলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link