মিলান পতনের নেপথ্যে

এই মৌসুমে মিলানের শুরুটা মনে আছে তো? জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের কাঁধে ভর করে মিলান হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। গত মৌসুমের মাঝামাঝিতে জ্লাতানের আগমণ পুরো বদলে দিয়েছিল মিলান স্কোয়াড। আর সেখান থেকেই স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল মিলান সমর্থকেরা। হবেই বা না কেন?

২০১১ সালে শেষবার মিলানকে স্কুডেট্টো এনে দিয়েছিলেন এই জ্লাতানই। সেই জ্লাতান ফিরে এসে আবারও ১০ বছর পর স্কুডেট্টো এনে দিবেন এমনটা ভাবা তো দোষের কিছু নয়। কিন্তু মৌসুমের চারভাগের তিনভাগ শেষ হয়ে মিলান এখন লড়াই করছে চ্যাম্পিয়নস লিগে স্থান পাওয়ার জন্য। তাদের অবস্থান এখন লিগ টেবিলের পাঁচে।

মৌসুমের শুরু থেকেই মিলান ছিল ইতালিয়ান লিগের শীর্ষে। ১৭ রাউন্ড পর্যন্ত মিলান ছিল ইতালিয়ান ফুটবলের সেরা দল। হয়েছিল উইন্টার চ্যাম্পিয়ন। মৌসুমের মাঝামাঝি অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে যে দল সবার উপরে থাকে তাদেরকে সাধারণত উইন্টার চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। যদিও কেউ সরাসরি বলে না কিন্তু দলেরা মনে মনে এটাই ধরে নেয়।

কারণ মৌসুমের মাঝামাঝি থেকে বদলে যেতে শুরু করে একটি দলের অবস্থা। আর সেখানেই বদলে যায় এসি মিলান। মিলানের পতন শুরু হয় ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ। ভালোবাসা দিবসে স্পেৎজিয়ার বিপক্ষে গেরেই শুরু হয় মিলানের পতন। আর ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখেই প্রথম প্রথম পজিশন থেকে নেমে যায় মিলান। এমনকি এপ্রিলের ২৩ তারিখ পর্যন্তও ইন্টারের পেছন পেছন ছিল মিলান। লাৎজিওর বিপক্ষে হেরে তিনদিনের মধ্যেই নেমে এসেছে ৫ নম্বরে। মিলানের এমন পতনের পেছনের কারণ কী?

  • কন্ট্রাক্ট ইস্যু

এসি মিলানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কন্ট্রাক্ট ইস্যু। মিলানের অন্যতম সিনিয়র খেলোয়াড় জিয়ানলুইহি ডোনারোমা। প্রায় ৭ মৌসুম ধরে মিলানের গোলবারের ভরসার পাত্র তিনি। এমনকি মিলান দলের অন্যতম কী প্লেয়ার তিনি। কিন্তু মৌসুম শেষেই তার চুক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য তাকে চুক্তির অফারও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি বিন্দুমাত্র। তার এজেন্ট মিনো রাইওলার প্রয়োজন আরো বেশি।

মিলানের দেওয়া ৮ মিলিয়নের অফারের বদলে তাদের দাবি ১২ মিলিয়ন। কিন্তু মিলানের পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব না, ইএসএল বাতিল হয়ে যাওয়ার পর মিলানের পুরো অবস্থাও বলার মতন না। ফলে ড্রেসিংরুমে পড়ছে তার প্রভাব।

শুধু তাই নয়, ডোনারোমার পাশাপাশি হাকান চালহানগ্লুর কন্ট্রাক্ট নিয়েও আছে ধোয়াশা। আর এই দুজনেই মিলান দলের ডিফেন্স আর অ্যাটাকের ভরসা। ফলে দলের দুই স্তম্ভই যখন নিজেদের চুক্তি নিয়ে তালবাহানা করে তখন দলের মোর‍্যাল কোথায় থাকে তা আর বলার অবকাশ থাকে না।

কি-প্লেয়াররা যখন সামনের সিজনে দলে থাকবে কি থাকবে না এটা নিয়ে লম্বা সময়ের নাটক করে, তখন সেটা গোটা দলের মানসিকতায় প্রভাব ফেলে। এবং সেটাই হয়েছে। এসি মিলানের মূল দুই খেলোয়াড়ের কন্ট্রাক্ট ইস্যু প্রভাব ফেলেছে দলের সবার উপরে, যা এখন দেখা যাচ্ছে মাঠেও।

  • ম্যানেজমেন্টের দূরদর্শীতার অভাব

জানুয়ারির শেষে লিগ টেবিলের শীর্ষে ছিল এসি মিলান। এমনকি দ্বিতীয় দলের সাথেও পার্থক্য ছিল ৫ পয়েন্টের। স্বভাবতই ম্যানেজমেন্ট নিজেদের উইন্টার চ্যাম্পিয়ন ভেবে কিছুটা আরাম আয়েশে মত্ত ছিল। ধরেই নিয়েছিল শেষপর্যন্ত যদি শিরোপা ঘরে নাও আসে অন্তত চ্যাম্পিয়নস লিগে তো নাম লেখানো যাবেই।

কারণ তখন দলের প্রায় সবাই ছিল ফর্মের তুঙ্গে। কিন্তু শীত থেকে গ্রীস্ম বড্ড বড় সময়। এই সময়েই শুরু হয় টাইট শিডিউল, বাড়তে থাকে খেলা, কমতে থাকে খেলোয়াড়দের বাড়তি সময়। আস্তে আস্তে যখন দলে ইনজুরির ঝড় উঠল, তখন দেখা গেল তাদের ব্যাকাপ দেওয়ার মতন কেউ নেই।

জানুয়ারিতে ইঞ্জুরির পর পর লম্বা সময় পর্যন্ত মিলান মিডের মূল তারকা ইসমাইল বেন নাসের বাইরে ছিলের দলের। অথচ তার বদলে জানুয়ারিতে একবারের জন্যেও একটা প্লেমেকিং মিডফিল্ডার আনার চেষ্টা করা হয়নি। স্ট্রাইকার হিসেবে দিনের পর দিন খেলে গিয়েছেন ইব্রাহিমোভিচ, অথচ তার ব্যাকআপ হিসেবে আনা হয়েছে ৩৫ বছর বয়সী মারিও মানজুকিচকে। যে কিনা গত ৬ মাস ধরে খেলার বাইরে। স্বাভাবিকভাবেই বয়সের ভারে চোটে পরেছেন ইব্রা, যখন তার ব্যাকআপকে মাঠে প্রয়োজন হলো তখন দেখা গেল তিনিও চোট নিয়ে হাসপাতালে।

উইংয়ে ব্যাকআপ নেই, উইংব্যাকও চলছে জোড়াতালি দিয়ে। এক ডিয়েগো দালোতকেই ব্যবহার করা হচ্ছে দুই উইংব্যাকের ব্যাকআপ হিসেবে। রাইট উইং চলছে অ্যালেক্স সালেমেকারস আর সামু কাস্তিলেহোকে দিয়েই জোড়তালি দিয়ে। এমনকি ডিফেন্সে অধিনায়ক এসিলিও রোমাগনোলির ইনজুরির পর পিয়েরে কালুলুকে খেলিয়ে পয়েন্ট হারিয়েছে মিলান। চেলসি থেকে তোমোতিকে ধারে এনে তাও সেটা সামাল দেওয়া গিয়েছে বটে, কিন্তু আখেরে ক্ষতি মিলানেরই হয়েছে।

  • কোচের ট্যাক্টিক্যাল অনভিজ্ঞতা

সত্যি বলতে মিলানের সবচেয়ে বড় সমস্যা এই জায়গাতেই। একটি দলের কোচের অভিজ্ঞতার ঝুলির পরীক্ষা হয় যখন দল তার সেরা অবস্থায় থাকে না। এসি মিলানের অবস্থা যখন ভালো ছিল তখন পিওলিও তার সেরা ফর্মেই ছিলেন। একের পর এক ম্যাচ জুতে যাচ্ছে, মিলানও তাদের খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যেই না সময় বদলে গেল, পিওলিও বদলে গেলেন।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মিলানের সেরা সময়টার পুরোটাই মিলান জিতেছে ব্যক্তিগত নৌপূণ্যের উপর ভর করে। হয় সেটা জ্লাতান, নইলে লিয়াও কিংবা বেননাসের। দলের ভালো সময়ে দলের সকলের মোরাল ভালো থাকে, দল মোটিভেটেডও হয়, কিন্তু কোচের পরীক্ষা শুরু হয় যখন দল গারের বৃত্তে ঘুরতে থাকে, মোটিভেশন খুঁজে পায় না তখন।

পিওলি এই পরীক্ষাতেই ডাহা ফেল মেরেছেন। যখন দলের সবাই ভালো খেলেছে, একাডেমি থেকে আসা খেলোয়াড়ও নিজের সেরা পারফর্মেন্স দিয়েছে, গোল করেছেন। কিন্তু যেই একের পর এক ইনজুরি আসতে লাগলো, আর সহজ ম্যাচে পয়েন্ট হারানো শুরু হলো সেই মোটিভেশন উবে যেতে থাকলো। ইব্রা, রোমাগনোলি যখন মাঠের বাইরে চলে গেল, তখন মাঠের ভেতরেও মোটীভেশন দেওয়া, লিডিং পাওয়ারের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠল। ফলে বেরিয়ে পরল দলের বাজে অবস্থা। পিওলির উদ্দেশ্যহীন ৪-২-৩-১ ফরমেশনও তখন অকার্যকর।

কোচ হিসেবে পিওলি কখনই তেমন সফল ছিলেন না। কিন্তু তার অধীনে মিলানের খেলা দেখে তার সাথে চুক্তি বাড়িয়েছিল মিলান বোর্ড, কিন্তু এখন দলের সামান্য পথ বিড়তাতেই বের হয়ে পরেছে  তার আসল রূপ। একক নৌপূণ্যতায় একের পর এক ম্যাচ জেতা পিওলি এখন তাদের ছাড়া একেবারেই ছন্নছাড়া।

বড় দল হওয়া যায় তখনই যখন টেবিলের ছোট দলগুলোর সাথে আপনি কখনই পয়েন্ট হারাবেন না। পিওলির মুখস্থ ট্যাক্টিস ঠিক সে জায়গাতেই আঘার গেনেছে। যে কারণে ছট দলের সাথে তো পয়েন্ট হারিয়েছেই, জুভেন্টাস-ইন্টারের সাথে ম্যাচেও তার প্রভাব পরেছে। সবমিলিতে আজ মিলানের এই অবস্থা।

মিলানের সামনে এখনও সুযোগ আছে টপ ফোর নিশ্চিত করার। আবার একটু এদিক সেদিক হলে ইউরোপা লিগ খেলার স্বপ্নও ধূলিস্বাৎ হতে পারে তাদের। সবমিলিয়ে এখন তক্কে তক্কে থাকা লাগবে কোচ স্তেফান পিওলির। নইলে চাকরিটা যে মৌসুম শেষে হারাতে হবে তাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link