ঐতিহাসিক ভাবে ফুটবল মাঠের দুর্বলতম অবস্থান বিবেচনা করা হত ফুলব্যাকদের। ধরেই নেয়া হত এই অবস্থানের খেলোয়ারেরা কম সবল ও স্কিলের ঝুলি ফাকা। তাই তারা কেন্দ্রীয়রক্ষণ বা উইংয়ে খেলার অনুপযোগী। তবে আধুনিক ফুটবল এ ঘরানার বিপরীতে এগিয়েছে। বর্তমানে পজিশন হিসেবে ফুটবলের অন্যতম বৈচিত্রময় জায়গা ফুলব্যাক।
তবে কীভাবে এই বিবর্তন এল। আসলে আধুনিক ফুটবলের অন্যতম প্রধান ধর্ম গতিময়ভাবে এগোনো। ফলে পুরো রক্ষণেরই প্রধান দায়িত্ব আক্রমণের ও মাঝমাঠের গল্প বলা। তবে ইতিহাসের পাতায় ফুলব্যাকেরা কীভাবে এই ধারায় এল?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে আমরা বেশ পিছে যাচ্ছি। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দল স্যান্তোসের দুই ফুলব্যাককে নেয়। নাম যাদের নিল্টন ও জালমা।
স্যান্তোসের এই জোড়া ফুলব্যাক সফলভাবে রক্ষণ ও আক্রমণে অংশ নেয়। তবে ব্রাজিলিয়ানরা ১৯৫০ থেকেই পরীক্ষিতভাবেই আক্রমণাত্মক ফুলব্যাক খেলানোর দিকে মনোযোগ দেয়। যেটাকে বলে ওভারল্যাপিং ফুলব্যাক। খেলাকে প্রশস্ত করতে এ ধরনের খেলোয়াড়দের বারবার উপরে নিচে খেলতে হয়।
ব্রাজিল এর ফলও পেয়েছে হাতে-নাতে। ২০০২ সালে ব্রাজিল দলে রবার্তো কার্লোস বা কাফুই এর সবথেকে সফল নিদর্শন। তবে এতেই ব্রাজিলিয়ানরা থেমে থাকেনি। পরের প্রজন্মেও দিয়েছে এমনই আরও প্রজন্ম সেরা সব ফুলব্যাক।
মার্সেলো বা দানি আলভেসের কথা কে না জানে। ২০০৭-১৮ গ্যালাকতিকোস শিবিরে আলো ছড়িয়েছেন লেফট ব্যাক মার্সেলো। পায়ে কেবল গতি দিয়েই বিধাতা ক্ষান্ত দেননি। সাথে ছিল ফার্স্ট টাচের অনন্য দক্ষতা। সাথে ছিল তার ফ্লেয়ার। পরিসংখ্যান বিবেচনায় ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা দিয়েছেন লা লিগায়। যেখানে ৩৮৬ ম্যাচে তাঁর ২৬ গোল সাথে ৭২ অ্যাসিস্ট।
এসবের বাইরে বল ড্রিবলিং বা বল পায়ে স্কিল কাব্য রচনায়ও পটু ছিলেন তিনি। বার্সেলোনা জার্সিতে তার সতীর্থ দানি আলভেসও রাইট ব্যাক হিসেবে খেলেছেন ২০০৮-১৬ সময়টায়। যাতে ছিল ৮৩ গোলে অবদান।
ওভারল্যাপিং ধারার আধুনিক ফুটবল পটের সফলতম জুটি সম্ভবত লিভারপুল দলে। যেখানে এন্ড্রু রবার্টসন ও ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নোল্ড খেলে।
প্রিমিয়ার লিগে ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আর্নোল্ডের ২৩৩ ম্যাচে ১৫ গোল ও ৫৯ অ্যাসিস্ট। রবার্টসনেরও প্রিমিয়ার লিগে রয়েছে ৫৯ এসিস্ট সাথে ১১ গোল।
মজার ব্যাপার ইউর্গেন ক্লপের সিস্টেমে তারা এ পজিশনে খেলার আগে আর্নোল্ড ছিলেন রাইট উইংগার। আর রবার্টসন খেলতেন গতানুগতিক লেফটব্যাকে।
ফুলব্যাক পজিশনে লাতিনদের পর ইউরোপীয়রাও নিয়ে আসে বৈচিত্র্য। পেপ গার্দিওলার বায়ার্ন মিউনিখে বিশ্বফুটবল প্রথম দেখতে পায় একজোড়া ইনভার্টেড ফুলব্যাক।
হোয়াইড উইং খেলানোর জন্য তার সিস্টেমে নিয়ে আসেন মাঝমাঠধর্মী ফুলব্যাক।যেখানে দেখা যেত ফিলিপ লাম ও ডেভিড আলাবাকে। যারা একই সাথে রক্ষণ ও মাঝমাঠের খেলায় অবদান রাখতেন।
সেই ধারার বর্তমান উত্তরসূরি বায়ার্নেরই জসুয়া কিমিখ। সাথে একসময়কার নিয়মিত বার্সা তারকা সার্জি রবার্তোকে প্রায়েই ইনভার্টেড রাইট ব্যাকে পাওয়া যেত।
তবে বর্তমানে সব থেকে সফল বোধহয় এ ধারায় গার্দিওলা আমলের সিটির কাইল ওয়াকার-হোয়াও কান্সেলো জুটি। যারা একত্রে প্রিমিয়ার লিগ জেতে। সাথে রানার্স আপ হয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। কান্সেলো প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচ প্রতি ৭০ এর বেশি পাস ও ২৮১ লঙ্গবল খেলেছেন।
ফুটবল খেলার এই ধারাকেও একেবারে বদলে ফেলেন অনেক ম্যানেজার। জন্ম হয় উইংব্যাকের। ১৬-১৭ প্রিমিয়ার লিগে অ্যান্তোনীয় কন্তে এধারার একজন সফল জাদুকর। যেখানে উইং থেকে ভিক্টর মোজেসকে করেন উইংব্যাক। যার একাধারে ওঠা নামা। আর আক্রমণে সাহায্য করা। ১ বনাম ১ আক্রমণেও তাকে দেখা গেছে।
তার বিপরীতে দাড় করেন আরেক উইংব্যাক মার্কোস আলোনসোকে। যিনি ক্রসিং ও ফ্রিকিকে পটু। তাছাড়া ক্রসের জবাবে বক্সে দেরিতে পৌছে গোল করতেও সাহায্য করতেন।
একসময় এই ফুলব্যাকেরা ছিলেন কেবল মাত্র রক্ষনের অংশ। পুজি ছিল কেবল গতি আর স্বল্প ট্যাকলের ক্ষমতা। কিন্তু আধুনিক ফুটবল মাতা যে তার সব সন্তানের জন্যই মমতাময়ী। তাই তো আশীর্বাদ করেছেন তাদের অঢেল দক্ষতা আর বৈচিত্র্য দিয়ে। যা তাদের করে তুলেছে অনন্য।