কোথায় যেন হারিয়ে গেল মানুষটা, পকেটে কটা খুচরো নিয়ে বেরিয়ে হারিয়ে গেল পাহাড়ে, পরনে একটা হাফশার্ট-পাজামা আর একটা উদাস মন।
ট্রেণ ছেড়ে দিল, কলকাতায় প্রকাশকের লেখা জমা করার তাড়া, নবীন কবিকে খিস্তি মেরে কেঁদে ফেলা,রাতের খালাসিটোলায় একা বসে গান গেয়ে ওঠা সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাইনের বনে বসে যেন কেমন উদাস হয়ে গেল পাগল বাউল- কুয়াশার ভেতর থেকে নিজেকে কী প্রশ্ন করলেন তিনি?
‘মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’ – এমন একটা মানবজমিনে আবাদে সোনা ফলানো যে বড় কঠিন- তামিলনাড়ুর খরার মতো ফেটে যাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটের মানবজমিনে সোনা ফলালেন ক্রিকেটের স্পর্ধা, যেভাবে কত বছর আগে সিগারেটের ফিল্টারে টোকা মেরে কেউ লিখে ফেলত – ‘বিষঘুমে আছি আমি জাগাও আমাকে’, কিছু ছিল না আমাদের, কটা শুকনো খড়কুটো আর তোমার খাঁচা ভরা স্পর্ধা দিয়ে বানালে বাবুই পাখির বাসা।
মাঝে কেমন যেন এলোমেলো ঝড় উঠল, যারা তোমাকে কোনোদিন চিনতেই পারে নি তারা বলে দিল তুমি মন্থর, তুমি অচল- তারা জানেনা টনটনের ইনিংসটা, তারা জানেনা ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালের ইনিংসটা, তারা জানেনা ওয়ান ডে ক্রিকেটে সৌরভ গাঙ্গুলি ঠিক কী জিনিস!
জানে না, তোমার কলজে দিয়ে আগলে রাখা যুবরাজ-হরভজন-কাইফ-জহির-নেহরারা প্রতিবাদ করতে চাইল, কিন্তু কেউ বলতে পারল না জোড় গলায়, তোমার স্পর্ধার চকচকে চাকুতে নিজের অজান্তেই লেগে গেল নিজের যন্ত্রণার শেষ রক্তবিন্দু,যে সৌরভ একদিন জোর গলায় কাঁপিয়ে দিত বিসিসিআই সিলেকশন রুম, যে দাদা ইংল্যান্ডের মাঠে নামলে ভুরু কুঁচকে যেত নাসের-ভনদের, যে সৌরভ একটা থাপ্পড়ে চুপ করিয়ে দিত গড়াপেটা চক্রের দালালদের, যে সৌরভ ভারতীয় ক্রিকেটকে নিজের চওড়া খাঁচায় বয়ে নিয়ে গেল এতগুলো দিন- সে যেন আর কিছু বলতে পারল না।
শেষবার টেস্ট ক্যাপ মাথায় নিয়ে যুবি-ভাজ্জি-জহিরদের কাঁধে চেপে মাঠে ঢুকলেন তাঁদের প্রিয় ‘দাদা’, ওই শেষবার হাতটা তুলে জানান দেওয়া, ওই শেষবার জাতীয় পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ শান্ত হয়ে থাকা।
গতকাল যখন বিরাট কোহলি বললেন ধোনি দলের সম্পদ, ধোনি যাই খেলুক ও জানে দলের কখন কী প্রয়োজন, ওর সমালোচনা করার আগে আমার সমালোচনা করুন- তখন মনে হচ্ছিল- দাদা! তোমার যন্ত্রণা কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য যে সেদিন একটা বিরাট কোহলি ছিল না, খুব তো দেরি হয়নি, একটাবার তো কেউ বলতে পারত ‘দাদা ইউ আর আওয়ার প্রাইড’- ভারতীয় ক্রিকেটের ভীষ্ম হতে পারলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, কৌরবরা শরশয্যায় তাঁর মাথার কাছে রইল, আর তুমি?
কত যন্ত্রণা নিয়ে চলে গিয়েছিলে, সেই কবিতা পাগল লোকটার মতো, আসমুদ্র হিমাচল স্পর্ধা নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি, পাইনের বনে হয়ত তোমাদের দেখা হবে, হয়ত এত রাজনীতির ভিড় থেকে দুজনে চলে গেলে নিজের পৃথিবীতে, কেউ আর লিখল না –
‘যাবার সময় হল, নিবে যাওয়ার আগে চলে যাওয়া ভালো’, কেউ আর কোনোদিন বলবে না ‘I want Harbhajan in the list, otherwise I’m not leaving the room’ – কোথাও যেন ভারতীয় ক্রিকেটে চলে এল বিনয়, মহেন্দ্র সিং ধোনির শান্ত উপস্থিতি বদলে দিল ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস, কিন্তু ক্রিকেটের বারুদের ঘ্রাণ নিয়ে তুমি চলে গেছ, শক্তি চাটুজ্জের কবিতার মতো – সেই স্পর্ধা গেছে, এসেছে বিনয়।