১.
১৮ মে, ১৯৩১।
হেডিংলির এক বসন্তের বিকেল। ইয়র্কশায়ার বনাম ওয়ারউইকশায়ারের খেলা চলছে।
হার্বার্ট সাটক্লিফ আর পার্সি হোমসের ৫৯তম ‘সেঞ্চুরি জুটি’র সুবাদে ইয়র্কশায়ারের লিড গিয়ে ঠেকেছে ৯৭ রানে। একটু পরই আবার ব্যাটিংয়ে নামবে ওয়ারউইকশায়ার। মাঠে দর্শক খুব বেশি নেই, মেরে-কেটে হাজার চারেক হবে। বসন্তকাল হলেও এদিকটায় ঠান্ডা পড়েছে খুব, প্রায় সবার গায়েই ওভারকোট, গলায় মাফলার।
যাই হোক, দ্বিতীয় ইনিংসের খেলা শুরু হল। নবম ওভার শেষে ওয়ারউইকশায়ারের স্কোর যখন বিনা উইকেটে ১৬ রান, তখন বোলিং আক্রমণে আনা হল বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার হেডলি ভেরিটিকে। কাউন্টিতে ভেরিটির মাত্র দ্বিতীয় মৌসুম এটি।
তো নিজের প্রথম ওভারেই ভেরিটি বুঝিয়ে দিলেন কেন তাঁকে ইয়র্কশায়ার কিংবদন্তি উইলফ্রেড রোডসের উত্তরসূরি মনে করা হয়। ফ্লাইট-লুপের মুন্সিয়ানা দেখিয়ে ধরাশায়ী করলেন ওপেনার আলফ্রেড ক্রুমকে। মিড অফে অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক গ্রিনউড নিলেন এক অসাধারণ রানিং ক্যাচ।
স্পিনে কাজ হতে পারে ভেবে দুই প্রান্ত থেকেই স্পিনার লাগালেন ইয়র্কশায়ার ক্যাপ্টেন। ভেরিটির সাথে জুটি বাঁধলেন অফ স্পিনার জর্জ ম্যাকৌলে।
২.
ইনিংসের ১৪তম ওভারে হেডলির একটি ঝুলিয়ে দেওয়া বলকে সোজা গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিলেন ‘ইনফর্ম’ ওপেনার বব উইয়াট। বলাবাহুল্য, আগের বছরই উইজডেন বর্ষসেরার পুরস্কার জিতেছেন এই ডানহাতি।
ছক্কা খেয়েও আত্মবিশ্বাসে এতটুকু চিড় ধরল না ভেরিটির, বরং পরের বলে ফ্লাইটের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিলেন। এদিকে অতি আত্মবিশ্বাস থেকেই কিনা, ভেরিটির ওপর আবারও চড়াও হতে চাইলেন উইয়াট। কিন্তু গড়বড় করে ফেললেন টাইমিংয়ে; উড়িয়ে মারতে গিয়ে ধরা পড়লেন ডিপ এক্সট্রা কাভারে, ফিল্ডার পার্সি হোমসের হাতে।
৩৩/২।
৩.
নতুন ব্যাটসম্যান নরমান কিলনারের অতিরিক্ত ‘কাট’ খেলার প্রবণতা দেখে দলের সেরা ফিল্ডার আর্থার মিচেলকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে (গালি) নিয়ে আসলেন অধিনায়ক গ্রিনউড। চা বিরতির ঠিক আগমুহূর্তে সেই মিচেলের হাতেই তালুবন্দী হলেন কিলনার।
চা বিরতির পরপরই ফিরে গেলেন মিডল অর্ডারের স্তম্ভ জ্যাক পারসন্স, ক্যাচ দিলেন মরিস লেল্যান্ডের হাতে।
বেশিক্ষণ টিকলেন না উইলিয়াম বেটসও, কুপোকাত হলেন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে আর্থার মিচেলের দুর্দান্ত ডাইভিং ক্যাচে।
৩৯ ওভার শেষে স্কোর ৫৯/৫।
১৫ ওভারের বিরতিহীন স্পেলে ৫টা উইকেটই নিজের ঝুলিতে পুরেছেন হেডলি ভেরিটি!
৪.
এদিকে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। দিনের খেলা শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। বাস-ট্রেন ধরার তাড়ায় স্টেডিয়াম ছাড়তে আরম্ভ করে দিয়েছেন অনেকে। সন্ধ্যে নামার আগেই গন্তব্যে ফিরতে হবে তো!
অবশ্য ভেরিটির আগের ওভারেই একটি উইকেট পড়ায় কেউ কেউ ভাবলেন, আর একটা ওভার দেখেই যাই! কী বলো? তো সেই ‘আর এক ওভারে’ কী ঘটেছিল জানেন?
ভেরিটি স্ট্রাক ফোর টাইমস! অর্থাৎ এক ওভারেই তুলে নিলেন চার-চারটি উইকেট! তবে দু-দুবার ‘অন হ্যাটট্রিক’ হয়েও হলো না হ্যাটট্রিক! ৫৯/৫ থেকে এক ঝটকায় ৫৯/৯!
হেডলি ভেরিটি কি পারবেন দশে-দশের কীর্তি গড়তে?
৫.
মাঠে উপস্থিত সকলের চোখেমুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। বাস-ট্রেন ধরার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে রীতিমতো নড়েচড়ে বসেছে সবাই।
ওদিকে টানা বোলিং করে চলেছেন অফ স্পিনার ম্যাকৌলেও। ম্যাকৌলের বলেই ফিল্ডিং করতে গিয়ে হাতে চোট লাগে ভেরিটির। শর্ট মিড উইকেটে একটি দুরূহ ক্যাচ নেয়ার জন্য ডাইভ দিয়েছিলেন, কিন্তু ধরতে পারেন নি। উলটো বাঁ হাতের কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত বেশ খানিকটা জায়গার চামড়া ছড়ে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক ক্ষতের। ইনিংসের বাকি সময়টা তাঁকে বোলিং করতে হয়েছে হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে!
এই ‘বাকি সময়’ অবশ্য খুব বেশি সময় না। মাত্র তিন ওভার। নিজের ১৯তম ওভারেই জর্জ পেইনকে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ‘কট অ্যান্ড বোল্ড’ করে ১০ নম্বর উইকেটখানা ঝুলিতে পুরলেন ভেরিটি।
হেডলি ভেরিটি ১৮.৪-৬-৩৬-১০
জর্জ ম্যাকৌলে ১৮-১১-২০-০
ইয়র্কশায়ার জিতেছিল এক ইনিংস ও ২৫ রানের ব্যবধানে।
৬.
হেডলি ভেরিটির তরুণী স্ত্রী ক্যাথলিন ভেরিটি সেদিন মাঠেই ছিলেন। পতিদেবতার ২৬তম জন্মদিনে ‘সারপ্রাইজ’ দিতে এসেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেই এভাবে ‘সারপ্রাইজড’ হবেন তা কে জানত? এক সাক্ষাৎকারে ক্যাথরিন জানান, ‘একজন ক্রিকেটারের বউ হয়ে আজ ভীষণ গর্ববোধ হচ্ছে আমার।’
হেডলি ভেরিটি যখন ইনিংসে ১০ উইকেট পেলেন, ছোটবোন গ্রেস ভেরিটি তখন স্কুলে, কিছুই জানে না এসবের। স্কুলের হেডমাস্টার মশাই নাকি ছুটতে ছুটতে ক্লাসে ঢুকে বলেছিলেন, ‘গ্রেস, তুমি কি জানো, আজ কী হয়েছে? তোমার ভাই ছত্রিশ রানে দশ উইকেট পেয়েছে!’
এক প্রত্যক্ষদর্শী দর্শকের ভাষ্য শুনুন, ‘আজ ভেরিটির জন্য ট্রেন মিস করলাম। পরের ট্রেনের জন্য বসে থাকতে হবে পাক্কা দুই ঘন্টা! কিন্তু তারপরও আমি খুশি, এমন একটা কীর্তি স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি সারাজীবনও অপেক্ষা করতে পারি!’
তা ভেরিটি সাহেব কী বলেছিলেন ম্যাচ শেষে? বলেছিলেন, ‘আজ পর্যন্ত জন্মদিনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার।’
নিজের পারফরম্যান্স প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিনয়ের অবতার। ‘আসলে আজকের দিনটাই আমার ছিল। সবকিছুই আমার পক্ষে এসেছে। অন্যপ্রান্ত থেকে ম্যাকৌলের স্পেলটা ভীষণ সাহায্য করেছে। এত ভাল বোলিং করল, অথচ দেখুন ওর কপালে একটা উইকেটও জোটে নি! এটাই ক্রিকেট।’
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই ভেরিটির বাবা বলেছিলেন, ‘কিরে, তুই তো দেখছি একদিনেই বিখ্যাত হয়ে গেলি।’
হ্যাঁ, সিনিয়র ভেরিটি সেদিন ঠিকই বলেছিলেন। এ তো সবে শুরু, হেডলি ভেরিটির কীর্তির খবর কেবল কাউন্টিতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, তিনি বিখ্যাত হয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও।
৭.
নটিংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে পরের মৌসুমে আবারও ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে হইচই ফেলে দেন হেডলি ভেরিটি। দিস টাইম ফর জাস্ট টেন রান্স!
১০ রানে ১০ উইকেট! ভাবা যায়?
১৯.৪-১৬-১০-১০!
একটি ‘হ্যাটট্রিক মেইডেন’সহ শেষ ৭ উইকেট নেন মাত্র তিন রান খরচায়!
ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা বোলিং ফিগারের এই বিশ্বরেকর্ড আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারে নি, ভবিষ্যতেও কেউ পারবে বলে মনে হয় না।
উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, শেষ সেশনে ইয়র্কশায়ারের বিখ্যাত সাটক্লিফ-হোমস জুটি ১৩৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করেছিল মাত্র ৯০ মিনিটে!
হেডলির টেন-ফার নিয়ে পরবর্তীতে একটি বইও লেখা হয়েছে। ক্রিস ওয়াটার্সের লেখা ‘10 for 10: Hedley Verity and the Story of Cricket’s Greatest Bowling Feat’ বইটির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০.১০ ব্রিটিশ পাউন্ড!
৮.
ভেরিটি ম্যাজিকের এখানেই শেষ নয়।
১৯৩৩ সালে এসেক্সের বিপক্ষে ৯১ রানের বিনিময়ে নেন ১৭ উইকেট। প্রথম ইনিংসে ৯/৪৪, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮/৪৭!
১৯৩৪ সালের ঐতিহাসিক লর্ডস টেস্টে ১০৪ রানে ১৫ উইকেট নেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। তিনি একদিনেই নিয়েছিলেন ১৪ উইকেট, ব্র্যাডম্যানকে আউট করেছিলেন দুবার!
মহামতি ব্র্যাডম্যানকে একদিনেই দুবার আউট করার প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে অগাথা ক্রিস্টির অমর সৃষ্টি বেলজিয়ান গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে বানানো টিভি ধারাবাহিকের একটি পর্বে।
৯.
তিরিশ দশকের গোটাটা জুড়েই ভেরিটি ছিলেন বিধ্বংসী ফর্মে। তাঁকে বলা যেতে পারে একটি ‘উইকেট মেশিন’, যার কাছে চাইলেই উইকেট পাওয়া যেত।
ক্রীড়াসাংবাদিক ডাডলি ক্যারিউর ভাষায়, ‘Verity on a day of success is the personification of hostility.’
১০ বছরে ইয়র্কশায়ারকে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতিয়েছেন ৭ বার! ১৯৩০ বাদে প্রতিটি কাউন্টি মৌসুমেই তাঁর উইকেটসংখ্যা ছিল দেড়শ’র ওপর!
সর্বোচ্চ শিকার ছিল ১৯৩৯ সালে ১৯১ উইকেট, মাত্র ১৩.১৩ গড়ে! ভেরিটির বয়স তখন মাত্র ৩৪। সাসেক্সের বিপক্ষে মৌসুমের শেষ ম্যাচেও মাত্র ৯ রান খরচায় নেন ৭ উইকেট!
এরপর আর কোনদিন বল হাতে নেন নি ভেরিটি। আরও অনেকের মত তাঁকেও অংশ নিতে হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
১৯৪৩ সালের ১৯ জুলাই, সিসিলির এক রণাঙ্গনে বুকে শেলবিদ্ধ হন ‘ক্যাপ্টেন’ হেডলি ভেরিটি। গুরুতর আহত অবস্থায় ধরা পড়েন জার্মান সেনাবাহিনীর হাতে। ধরা পড়ার আগমুহূর্তে সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য তাঁর শেষ অর্ডার ছিল, ‘কিপ গোয়িং’!
টানা ১২ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার পর অবশেষে মারা যান তিনি। তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়েছিল পূর্ণ সামরিক মর্যাদায়।
অনেকেই হয়ত শুনে থাকবেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি বিখ্যাত যুদ্ধজাহাজের নামকরণ করা হয় ভেরিটির নামে, ‘HMS Verity’.
ভেরিটির মৃত্যুর খবর পেয়ে এক শোকবার্তায় স্যার ডন ব্র্যাডম্যান লিখেছিলেন, ‘I cannot ever recall hearing Verity utter a word of complaint or criticism … he maintained this example right to the end. His final sacrifice will never be forgotten.’
১১.
৪০ টেস্টের ক্যারিয়ারে ভেরিটির শিকার ২৪.৩৭ গড়ে ১৪৪ উইকেট। ১৭ বারের দেখায় সবচেয়ে বেশি ৮ বার আউট করেছেন ব্র্যাডম্যানকে! প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অর্জন ১৯৫৬ উইকেট, মাত্র ১৪.৯০ গড়ে! ইনিংসে ৫ উইকেট ১৬৪ বার, ম্যাচে ১০ উইকেট ৫৪ বার।
হেডলি ভেরিটিকে সর্বকালের সেরা বাঁ-হাতি স্পিনার মানেন অনেকেই। সমসাময়িক ক্রিকেটবোদ্ধাদের মতে তাঁর সাফল্যের মূলে ছিল লাইন-লেন্থ এবং অ্যাকুরেসি। বলে খুব বেশি টার্ন ছিল না; মূলত ফ্লাইট-লুপের বৈচিত্র্য, বাউন্স-স্কিডের তারতম্য আর বুদ্ধিদীপ্ত চেঞ্জ অব পেস দিয়েই ফাঁদ পেতে উইকেট শিকার করতেন তিনি। তাঁর আরও একটি কার্যকর ডেলিভারি ছিল ইনসুইঙ্গিং আর্ম বল।
বৃষ্টিভেজা স্টিকি উইকেটে ভেরিটি ছিলেন কার্যত আনপ্লেয়েবল। তবে ফ্লাট ব্যাটিং পিচেও ভেরিটিকে সামলানো বেশ কঠিন ছিল, এ কথার সঙ্গে একমত হয়েছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, লেস অ্যামিস, ডগলাস জার্ডিনসহ অনেকেই।
স্কটিশ লেখক রবার্টসন গ্লাসগোর ভাষায়, ‘He was the best of his kind. His delivery had a grace which mathematics can’t explain.’
ক্রিস ওয়াটার্সের মতে, ‘He spun the ball just enough and, allied to his ability to make it lift, a skill intensified in wet conditions and a weapon known as his perching ball.’
ব্র্যাডম্যানের সাথে নিজের দ্বৈরথটা ভীষণ উপভোগ করতেন তিনি। কম যেতেন না ব্র্যাডম্যানও, ভেরিটিকে তাঁর দেখা সেরা বাঁহাতি স্পিনার বলে রায় দিয়েছেন অনেকবার। সত্যি বলতে দুইজনই একে অপরকে খুব হাইলি রেট করতেন।
শেষ করব একটি পরিসংখ্যান দিয়ে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানকে সর্বাধিক ১০ বার আউট করেছেন দুজন বোলার; ক্ল্যারি গ্রিমেট আর হেডলি ভেরিটি।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাডম্যান একবার মজা করে বলেছিলেন, ‘গ্রিমেটের বিপক্ষে প্রচুর খেলেছি আমি, ওর খুঁটিনাটি সবকিছুই আমার জানা। কিন্তু ভেরিটির ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। ওর কোন দুর্বল দিক খুঁজে পাইনি আমি।’ একজন বোলারের জীবনে এর চাইতে বড় কমপ্লিমেন্ট আর কী হতে পারে?