যেন মাদ্রিদের রাজপথ বেয়ে ছুটে আসছে রিয়াল মাদ্রিদের বিজয়ীর বাস। গন্তব্য সান্তিয়াগো বার্নাব্যু, যেখানে অপেক্ষায় থাকবে হাজারো সমর্থকের উন্মত্ত উল্লাস। কিন্তু না, এটা মাদ্রিদ নয়, রিয়াল মাদ্রিদও নয়। এখানে বার্নাব্যুর ঐতিহ্য নেই, তবে আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে, একটুখানি ছুঁয়ে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে।
জায়গাটা বরিশাল। চলছে ফরচুন বরিশালের জয়যাত্রা। গন্তব্য বেলস পার্ক। রাজপথের দুই পাশে মানুষের ঢল, যেন একপলক দেখার জন্য ব্যাকুল এক সমুদ্র। ফরচুন বরিশালের টিম বাস কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে সেই স্রোতের। শিরোপার ছোঁয়া লেগেছে বলেই কি এমন উন্মাদনা? নাকি এ বরিশালের হৃদয়জুড়ে জমে থাকা ভালোবাসার বিস্ফোরণ?
এ এক অদ্ভুত দৃশ্য! যেন রাজ্য জয় করে ফেরা কোনো সম্রাটের আগমনী লগ্ন। চারপাশের মানুষজন তাঁকে দেখতে চায়, তাঁকে ছুঁতে চায়, তাঁকে কুর্নিশ জানাতে চায়। যে দলের অস্তিত্ব নিয়েই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলত, সেই দল আজ ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। যে আসরটাকে নিয়ে সন্দেহের দোলাচল ছিল, সেই বিপিএলই বরিশালের অলিগলিতে এনে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের রাজকীয় উৎসব।
তাহলে বিসিবি কেন বেলস পার্ককে বার্নাব্যু বানাতে পারে না? কেন এই আবেগের মূল্য নেই? বিপিএল যে মরে যায়নি, বরং হৃদয়ে গেঁথে গেছে—বরিশালের এই উন্মাদনাই তার বড় প্রমাণ! বিসিবি কি আসলেই বিপিএলকে নিয়ে ভাবছে? নাকি শুধু টেলিভিশনের পর্দায় খেলা চালিয়ে দায় সেরে ফেলতে চাচ্ছে?
একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের উদ্দেশ্য কী? ঘরোয়া ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করা, নতুন ভক্ত তৈরি করা, স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক আনা, দেশের প্রতিটি প্রান্তে ক্রিকেটের উত্তাপ ছড়িয়ে দেওয়া। অথচ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) বছরের পর বছর আটকে আছে একই ভুলের চক্রে। বিপিএল কি সত্যিই পুরো দেশের অংশগ্রহণ পাচ্ছে, নাকি শুধু গুটিকয়েক মাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ এক টুর্নামেন্ট হয়ে টিকে থাকছে?
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনায় আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম আছে। রাজশাহী ও বরিশালে ঘরোয়া ক্রিকেট হয়, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট হয়। একটু উন্নয়ন করলেই আন্তর্জাতিক মানের ভেন্যু বানানো সম্ভব। আর রংপুর রাইডার্সের তো ঢাকাতেই নিজস্ব স্টেডিয়াম আছে। এমনকি তাঁরাও রংপুরে স্টেডিয়াম বানানোর ক্ষমতা রাখে, এটা তাঁরা নিজেরাও অনেকবার বলেছে। তাহলে হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিক লিগ করার চিন্তাটা বিসিবির মাথায় আসে না কেন? সমস্যা কী?
আর্থিক অসঙ্গতি? না, সেটা তো হতে পারে না! বিসিবির ব্যাংকে এক হাজার কোটি টাকার এফডিআর পড়ে আছে, অথচ বিপিএলের ম্যাচ এখনো ঢাকার বাইরে গুটিকয়েক ভেন্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিসিবি কি আসলেই চায় এই লিগ বড় হোক? সত্যি এটা গ্লোবাল একটা ক্রিকেট মঞ্চ হয়ে উঠুক?
যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করার অবকাশ নেই। বরিশাল আর রাজশাহীতে বিমানবন্দর আছে, পাঁচতারকা মানের হোটেল আছে, সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। তাহলে টুর্নামেন্ট ছড়িয়ে দিতে সমস্যা কোথায়? বিসিবির কি রংপুরের উন্মাদনা মনে নেই? বরিশালের বেলস পার্কে মানুষের ঢল দেখেও কি বোর্ড টের পাচ্ছে না, বিপিএল নিয়ে দেশজুড়ে কেমন পাগলামি চলছে?
বরিশালে সমর্থকদের বিজয় উৎসব নিরাপত্তার অজুহাতে মাঝপথে বন্ধ হল। দর্শকদের এই উপচে পড়া ভিড় সামাল দেওয়ার অবস্থা ছিল না। বরিশালে নিয়মিত এই আয়োজন করে অভ্যস্ত না ফরচুন বরিশাল। অভ্যস্ত হতে দেয় না বিসিবি। এই দেশের ক্রিকেটে যে ক্রিকেটাররা রক্তঝরানো পরিশ্রম করেন, সেই ক্রিকেটারদের জয় উদযাপন করতে দেয় না নিজেদেরই বোর্ড! এই মানসিকতার কারণে বিপিএল আজও সেই ‘মিরপুর লিগ’ হয়ে পড়ে আছে।
এই মাইন্ডসেট ভাঙতে হবে। বিসিবি যদি সত্যিই বিপিএলকে বড় আসর বানাতে চায়, তাহলে এটাকে ঘরবন্দি না রেখে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। নয়তো বিপিএল হবে শুধু ঢাকার কিছু মানুষের জন্য, আর দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা থাকবে উপেক্ষিত। ক্রিকেটের প্রতি তাদের ভালোবাসা বিসিবির জন্য যেন বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়!