সেদিন ইতিহাসের অংশ হল বাংলাদেশ ক্রিকেট

সেদিন ক্যাম্পবেল ব্যাট হাতে নামেননি শুধু জিম্বাবুয়ের ভরসা হতে, হ্যারিস শেষ বলে চার মারেননি শুধু নিউজিল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করতে — তারা সবাই ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর করে গিয়েছিলেন, নিশ্চিত করেছিলেন বাংলাদেশের এক নতুন সূর্যোদয়ের!

স্ট্রাইকে অ্যালিস্টেয়ার ক্যাম্পবেল। বোলিংয়ের জন্য দৌড়ে আসছেন সাইমন ডউল। উত্তেজনায় কাঁপছে ঢাকা। ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ছে এক নতুন সূচনা—প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ আয়োজন করছে আইসিসির কোনো বৈশ্বিক ইভেন্ট!

সেই ১৯৯৮ সালের উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ —ক্রিকেট ইতিহাসে পরিচিত ‘মিনি বিশ্বকাপ’ নামে। ঢাকার মানুষ এই নামেই ডাক। উইজডেনের দেওয়া এই নামটিই পরে রূপ নেয় আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। কিন্তু, এই টুর্নামেন্ট শুধুই একটি ক্রিকেট আয়োজন ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরীক্ষা, প্রমাণ আর প্রতিষ্ঠার গল্প।

মিনি বিশ্বকাপ আয়োজনের পেছনে ছিলেন ক্রিকেট বানিজ্যের এক আধ্যাত্মিক গুরু। তিনি জগমোহন ডালমিয়া—ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের স্থপতি, আধুনিক ক্রিকেট বাণিজ্যের মহাপুরুষ। তাঁর পরিকল্পনাই প্রথম তিনটি সম্ভাব্য ভেন্যু ঠিক করা হয়েছিল — একেবারে অবিশ্বাস্য ছিল নাম গুলো! শারজাহ, ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ড, আর বাংলাদেশ!

আসলে উদ্দেশ্য সহজ আর খুব পরিস্কার। টাকা উপার্জন আর ক্রিকেটের বিস্তার। বিশ্বকাপের চার বছরের বিরতির ফাঁকে এমন একটা টুর্নামেন্ট দরকার ছিল যা একদিকে আইসিসির রাজস্ব বাড়াবে, অন্যদিকে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেবে টেস্ট খেলিয়ে দেশের বাইরে। ফলাফল—প্রথম আয়োজনেই ১০ মিলিয়ন ডলারের বিশাল লাভ!

কিন্তু কী অবিচার, স্বাগতিক হয়েও খেলতে পারল না বাংলাদেশ! তবু, এতকিছুর পরেও এই আয়োজন বাংলাদেশের গর্ব হয়ে থাকল, কারণ একবার যখন এই মঞ্চে উঠে গেছি, তখন পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই!

সংগঠকদের কল্পনাপ্রসূত ভাবনা—টুর্নামেন্ট শুরু হবে জিম্বাবুয়ে বনাম নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে। কে জানত, সেই ম্যাচটাই হয়ে যাবে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার এক অনন্য অধ্যায়?

জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ক্যাম্পবেলের দুর্দান্ত শতরান করলেন, দল তোলে ২৫৮। মনে হচ্ছিল, ম্যাচ তাদের দিকেই যাচ্ছে। কিন্তু ক্রিকেট দেবতা নাটক ভালোবাসেন!

শেষ তিন ওভারে নিউজিল্যান্ডের দরকার ৪০ রান। অবিশ্বাস্যভাবে তা সম্ভব করে ফেলেন ক্রিস হ্যারিস! শেষ বলে প্রয়োজন ৪ রান—সেই মুহূর্ত, যখন হাত কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে। কিন্তু হ্যারিস জানতেন, এটাই তার সময়! এক চিৎকারে ব্যাট চালিয়ে বল পাঠালেন এক্সট্রা কভারের উপর দিয়ে চার!

নিউজিল্যান্ড জিতে গেল শেষ বলে! ঢাকার উত্তাল গ্যালারি তখন বিস্ময় আর উল্লাসে ভাসছে। প্রথম ম্যাচেই এমন রোমাঞ্চ? এ যে শুরুর আগেই ইতিহাস!

কিন্তু এই আয়োজন সহজ ছিল না। ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, প্রায় তিন কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। ঢাকাও সেই দুর্যোগের কবলে, আর আশঙ্কা ছিল—এই আসর হয়তো বাতিলই হয়ে যাবে!

আইসিসির ভিতরেও ফিসফাস চলছিল—ঢাকার বদলে কলকাতায় টুর্নামেন্ট সরিয়ে নেওয়া হবে কিনা! ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ক্রিকেট পরিকাঠামো তখন কলকাতায়। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট লড়ল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে গেল। জিতে গেল, ট্রফিটা দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে উঠলেও জয় হল বাংলাদেশ ক্রিকেটের।

সেই লড়াইয়ের পুরস্কার? এই আয়োজন সফলভাবে শেষ হতেই বিশ্ব বুঝে গেল — বাংলাদেশ কেবল ক্রিকেট খেলে না, ক্রিকেট আয়োজনও করতে জানে! আর সেই ধারাবাহিকতায় মাত্র দু’বছরের মধ্যেই টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে গেল বাংলাদেশ।

সেদিন ক্যাম্পবেল ব্যাট হাতে নামেননি শুধু জিম্বাবুয়ের ভরসা হতে, হ্যারিস শেষ বলে চার মারেননি শুধু নিউজিল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করতে — তারা সবাই ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর করে গিয়েছিলেন, নিশ্চিত করেছিলেন বাংলাদেশের এক নতুন সূর্যোদয়ের!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link